সোমবার, ৩০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

কাছ থেকে দেখা শহীদ জিয়া

অ্যাডভোকেট মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন

কাছ থেকে দেখা শহীদ জিয়া

৩০ মে, ১৯৮১ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের প্রায় সপ্তাহখানেক আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য চট্টগ্রামের প্রথিতযশা চিকিৎসক ডা. এ এফ এম ইউছুফ আমাকে তার চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। বললেন আগামী ২৯ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম আসবেন এবং বিকাল ৪টায় তিনি চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হবেন।

প্রেসিডেন্ট উক্ত বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা ও দাওয়াত প্রদানের দায়িত্ব ওনার ওপর অর্পণ করেন। এই অনুষ্ঠানে কাকে কাকে দাওয়াত দেওয়া যায় তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। সে ব্যাপারে আমার মতামত নিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করতে চান। তিনি আরও বললেন, আমন্ত্রিত অতিথি ৩০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং তিনি এও বললেন যে, এই মতবিনিময় শেষে চট্টগ্রাম বিএনপির কোন্দল নিরসনে রাতে বিএনপির বিবদমান নেতাদের সঙ্গে তিনি আলোচনায় মিলিত হবেন। আমি এবং উনি, উনার চেম্বারে বসে তালিকা প্রস্তুতকালে প্রথমেই জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি (অব.) জেলা জজ অ্যাডভোকেট আবু আহমেদ, সিনিয়র আইনজীবী বদিউল আলম, অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হুদা, অ্যাডভোকেট আবু ছালেহ চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবদুল আজিজ খান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মতাদর্শের সম্মানিত শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও নগরীর খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি          তালিকা প্রস্তুত করি। ডা. ইউসুফের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি গাড়িতে করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত প্রদান করি। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল আইনজীবীদের নিয়ে সার্কিট হাউসে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া। মতবিনিময় সভার দুই দিন আগে স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক একরামুল হক (মরহুম) চট্টগ্রামে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। তাকে নিয়েও আমরা প্রস্তুতকৃত তালিকা মোতাবেক দাওয়াত দেওয়া শুরু করি। নির্ধারিত মতবিনিময় সভা সার্কিট হাউসে বিকাল ৪টায় শুরু হওয়ার আগেই আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়ে নিজ নিজ আসনে আসন গ্রহণ করেন। উক্ত মতবিনিময় সভায় আমি ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠতম সদস্য, ডা. ইউছুফ সাহেব তার হৃদয়ের বিশালতা নিয়ে ঢাকা থেকে আগত স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন, আমরা ওই হলরুমে প্রেসিডেন্ট যে চেয়ারে বসবেন তার ডান পাশের চেয়ারে ডা. বি চৌধুরী এবং বাম পাশের চেয়ারে ডা. এ এফ এম ইউছুফ এবং তার পেছনের সারিতে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, অধ্যাপক একরামুল হক, আমেনা বেগমসহ অন্যরা বসলেন। আমাকে ডা. ইউছুফ সাহেব তার পাশের একটু পেছনের চেয়ারে বসতে বললেন এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা টেবিলের দুই পাশে বসলেন। সবাই অধীর আগ্রহে মহামান্য প্রেসিডেন্টের অপেক্ষায়। আমিও উত্সুক ভরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা হবে অত্যন্ত কাছ থেকে, যদিও এর আগে তার সঙ্গে আমার তিনবার সরাসরি সাক্ষাৎ এবং আলাপ হয়েছিল যা পরবর্তীতে আলোচনা করব। ঠিক নির্ধারিত সময়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্কিট হাউস হলে প্রবেশ করলেন। তার গায়ে পরিহিত ছিল ফুলস্লিভ সাদা শার্ট এবং সাদা প্যান্ট। তিনি হলে এসে চেয়ারে বসলেন। চেয়ারে বসেই সবাইকে বললেন, ‘প্রথমে আপনারা বলবেন, নাকি আমি বলব? আসলে আমি আজকে আপনাদের কাছ থেকে শুনতে এসেছি।’ উপস্থিত সবাই সমস্বরে বললেন, স্যার আমরা সবাই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ যে, আপনি আমাদের ডেকেছেন এবং আমাদের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছেন। তবে আমরা প্রথমেই আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। এর প্রত্যুত্তরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার বক্তব্য শুরু করলেন। বক্তব্য প্রদানকালে প্রফেসর বি চৌধুরী এবং ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে বিভিন্ন পয়েন্ট রেফার করছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই বলে শুরু করলেন, ‘আপনারা সবাই মেধায় সমৃদ্ধশালী, আপনারা আমাকে মেধা দিয়ে সহযোগিতা করলে আপনাদের প্রদত্ত পরামর্শ আমি গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে দেশকে উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব, ইনশাল্লাহ। তালপট্টি আমাদের হবে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আপনারা দেখবেন আমাদের প্রতি মুসলিম বিশ্বের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা।’ এভাবে তিনি বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বিরোধের সম্মানজনক সমাধানে উপস্থিত বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে পরামর্শ আহ্বান করেন। তার এই গুরুত্বপূর্ণ              বক্তব্য রাখার সময় উপস্থিত সভায় পিনপতন নীরবতা বিরজ করছিল।

ইতিমধ্যে মাগরিবের আজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সার্কিট হাউসের বাইরে জাতীয় পতাকা নামানোর আনুষ্ঠানিকতা চলে। সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের স্যালুট দেওয়ার সময় জুতার আওয়াজ যখন আমাদের কানে আসছিল মহামান্য রাষ্ট্রপতি তখন বললেন, ‘এখানে বসে আপনারা যারা সামরিক বাহিনীর বুট জুতার আওয়াজ শুনছেন তার আগে এদের পায়ে ছিল ক্যামবিসের জুতা, আমি তাদের বুট জুতার ব্যবস্থা করিয়েছি, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে এবং আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি সামরিক বাহিনীকে একটি যুগোপযোগী অত্যাধুনিক বাহিনীতে পরিণত করতে চাই, শত্রুর মোকাবিলা করতে যেন সক্ষম হয়।’

এভাবে তিনি অনেকগুলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুর ওপর আলোকপাত করেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বক্তব্য শেষ করলেন, বক্তব্য শেষে উপস্থিত সবাই একে একে বক্তব্য রাখা শুরু করলেন। যা একপর্যায়ে প্রাণবন্ত আলোচনা এবং মিলনমেলায় পরিণত হয়। আলোচনা শেষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট বদিউল আলম যিনি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তিনি আমাকে বললেন, আজকের এই দাওয়াতে না এলে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আসল মেধা এবং রাষ্ট্র-নায়কোচিত একজন জাতীয়তাবাদী নেতাকে চিনতে পারতাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলীরা বললেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে গেল। আলোচনা শেষে সামান্য চা আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল সল্টেস বিস্কুট দিয়ে, প্রেসিডেন্ট জিয়া সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ-আলোচনায় সবার মাঝে একান্ত আপন হয়ে গেলেন। সেই ফাঁকে ডা. ইউছুফ আমাকে প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, স্যার দাওয়াতের ব্যাপারে নাসির আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। প্রেসিডেন্ট স্মিত হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, জজগিরি ভালো না রাজনীতি ভালো? কোনটা উপভোগ করছেন। আমি তার জবাব দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে না পেয়ে চমকে উঠলাম। হঠাৎ মনে পড়ল সিলেট সার্কিট হাউসে আমাকে তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী মরহুম জামাল উদ্দীনের উপস্থিতিতে জজগিরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসার যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটা আমার কাছে চিরভাস্বর হয়ে ফুটে উঠল। স্বভাবতই আবেগে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। এটাই ছিল তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকার। সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী মরহুম জামাল উদ্দিনসহ অনেকের উপস্থিতিতে শুধু বললাম— স্যার, আমি চায়ের সঙ্গে আরও ভালো কিছু আইটেম দিতে চেয়েছিলাম। ডা. ইউছুফ বললেন, এতে মহামান্য প্রেসিডেন্ট নারাজ হতে পারেন। তিনি স্মিত হাসলেন, তার সেই হাসিটা যে জীবনের শেষ হাসি হবে এবং তার ঐতিহাসিক বক্তব্য যে জীবনের শেষ বক্তব্য হবে কিংবা বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার আলোচনা ও হৃদয়ের মিলনমেলা যে জীবনের শেষ মিলনমেলা হবে, আর উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে তার সেই হৃদয়গ্রাহী আলাপ এবং ভাবের আলিঙ্গন যে জীবনের শেষ আলিঙ্গন হবে, তার আকর্ষণীয়, স্নিগ্ধ উজ্জ্বল মায়াবী ভরা, আকর্ষণীয় মুখমণ্ডল আর জীবনে কোনো দিন দেখতে পাব না, কেউ সেদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। আলোচনাকালীন ফ্যানের বাতাসে বামপাশের টেবিলের কোনার চাদর ওপরে উঠে গেলে প্রেসিডেন্টের জীবন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্নেল মাহফুজ অতিভক্তি ও সতর্কতার সঙ্গে টেবিলের নিচে ক্রলিং করে এসে চাদর ঠিক করে দিয়েছিলেন। আর সেই রাতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ঘাতকের ভূমিকায়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রেসিডেন্ট যখন রাতের খাবারের জন্য ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছিলেন আমি ডা. ইউছুফের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে বললেন, স্যার নাছির চলে যাচ্ছেন বাসায় তার স্ত্রী একা। আমি প্রেসিডেন্টকে সালাম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে ডিনার করে যেতে বললেন। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে আসি। এ বিদায় যে শেষ বিদায়, এ দেখা যে শেষ দেখা হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। বাসায় ফিরে গিয়ে আমি ও আমার স্ত্রী ডালিয়া রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে প্রচণ্ড ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছিল। সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠে বাসার বারান্দা থেকে দেখি রাস্তাঘাট ফাঁকা নির্জন। আমি ডিসি হিলের উত্তরে মোমিন রোডের বাসায় থাকতাম। নিচ থেকে দু-একজন লোক এসে বললেন স্যার গত রাতে সার্কিট হাউসে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। শুনতে পাচ্ছি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। সামরিক বাহিনী চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং জেনারেল মঞ্জুর প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে। এ খবর শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রথমে টেলিফোন করলাম আমাদের অত্যন্ত আপনজন জাগদল-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা রাজনীতিবিদ মরহুম অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হুদাকে। ভাগ্যক্রমে টেলিফোন তাকে পেয়ে গেলাম। তিনি কম্পিত কণ্ঠে আমাকে বললেন তুমি তাড়াতাড়ি করে কোর্ট ড্রেস পরে কোর্টের লাইব্রেরিতে চলে যাও। সেখানে অন্যদেরও আসতে বলেছি। কোর্টেই আমাদের দেখা হবে। আমি বার লাইব্রেরির ছোট রুমে গিয়ে দেখতে পেলাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি মরহুম অ্যাডভোকেট আবু সালেহ চৌধুরীকে। বিমর্ষ আবু সালেহ আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললাম হুদা ভাই এবং ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কিও আসবেন। তারা আসা পর্যন্ত আমরা দুজন ছোট কামরায় অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণ পর বার সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মরহুম বদিউল আলম রুমে ঢুকতেই আমি বললাম— দেখুন না, আপনিও গতকাল সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন। আজ হায়েনারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তিনি ওই রুম থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, ‘খবরদার নাসির সাহেব আমি যে গতকাল সার্কিট হাউসে মতবিনিময় সভায় গিয়েছিলাম সেটা কাউকে বলবেন না’। আমি তার এ কথায় শুধু হতাশ হইনি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। ইতিমধ্যে সেখানে মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ফারুকী আমাদের দেখে বললেন, আপনাদের অবস্থান এখানে নিরাপদ নয়। এটা শোনার পর আমি আবু সালেহ চৌধুরী কোর্টের দ্বিতীয় তলায় দক্ষিণ-পশ্চিম বারান্দার কোনায় গেলাম অ্যাডভোকেট হুদা ভাইয়ের আগমন অপেক্ষায়। তিনিও খুব দ্রুতগতিতে আমাদের সঙ্গে কোর্টের বারান্দার কোনায় একত্রিত হলেন।

হুদা সাহেব আসার পর আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, কোর্টবিল্ডিংয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তার সঙ্গে দেখা করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হব। এ কে এম শামশুল হুদার এ প্রস্তাবে আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে রাজি হলাম। আমি অ্যাডভোকেট আবু সালেহ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মিল্কি ও অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমান (মমতাজুল মোহদ্দেসীন) জেলা প্রশাসকের দফতরে গেলাম। তখন বেলা প্রায় সাড়ে ১০টা-১১টা হবে। সমস্ত কোর্টবিল্ডিংয়ের চত্বর ফাঁকা। দু-একটি আর্মি জিপ দ্রুতগতিতে কোর্টবিল্ডিংয়ে আসা-যাওয়া করছিল। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি না পেয়ে পায়ে হেঁটে আমরা কোর্টবিল্ডিং থেকে নেমে যেতে লাগলাম। চারদিকে ভয়াল রাতের ঘটনায় নগরজীবন প্রায় স্তব্ধ, নিথর, নীরব হাহাকার জনশূন্য। আমরা কোর্টবিল্ডিংয়ের পাহাড় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে যখন এলাম তখন হুদা ভাই হঠাৎ করে আমাদের থামতে বললেন। তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ দাবি করার প্রস্তাব দিলেন। আমরা আবার পায়ে হেঁটে কোর্টবিল্ডিং পাহাড়ে জেলা প্রশাসকের দফতরের সামনে হাজির হলাম। এরই মধ্যে আমরা এক অনাকাঙ্ক্ষিত আতঙ্কে ভুগছিলাম। সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের কয়েকটি গাড়ি কোর্টবিল্ডিংয়ের সামনে জড়ো হওয়া দেখে আতঙ্ক ভর করে। এবারও আগের ন্যায় আমাদের সবাই অ্যাডভোকেট এ কে এম সামশুল হুদা, আমি, অ্যাডভোকেট আবু সালেহ চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমানের নাম লিখে সাক্ষাৎ প্রাপ্তির জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে স্লিপ পাঠালাম। স্লিপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসক এম জিয়াউদ্দীন আমাদের সবাইকে ডাকলেন। আমরা তার অফিস চেম্বারে ঢুকেই চেয়ারে বসার আগেই হুদা ভাই জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ কোথায়, কীভাবে আছে, কোন কর্তৃপক্ষের কাছে আছে তা জানতে চাইলেন এবং এও বললেন, আমরা সবাই এসেছি আমাদের প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়ার লাশ গ্রহণ করতে। জেলা প্রশাসক মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটিবারও মাথা উঁচু করে আমাদের মুখোমুখি হলেন না। মাথা নিচু করে শুধু বললেন, প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ আমার দায়িত্বে হস্তান্তর হলে আমি নিশ্চয়ই আপনাদের জানাব। বললেন, আপনারা দ্রুত চলে যান, আমরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে যার যার বাসার দিকে চলে যাচ্ছিলাম। হুদা ভাই তার আদি স্বাভাবিক স্নেহভরা কণ্ঠে আমাকে বললেন, ‘নাসির আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব তোমাকে আমি একা ছেড়ে দিতে পারি না কারণ আমার বোন ডালিয়া তোমার কিছু হলে আমাকে দায়ী করবে।’ তারপর তিনি আমাকে আমার মোমিন রোডের বাসায় পৌঁছে দিয়ে পায়ে হেঁটে তার চন্দনপুরার বাসভবন ‘রিটা কোট’ এ চলে গেলেন। আমি বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রী ডালিয়াকে অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় দেখি এবং আমার ঘরের টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়াতে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে আমার এক রাজনৈতিক সহকর্মী এসে আমাকে বাসা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যেতে বললেন। আমি বাসা থেকে নেমে কোথায় যাব ভাবছিলাম। ইতিমধ্যে সন্ধ্যাও নেমে আসে। পুরো নগরী ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। আমি চিন্তা করলাম শ্বশুরবাড়ি দোভাস বাড়িতে যাব, নাকি হুদা ভাইয়ের বাসায় যাব। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম হুদা ভাইয়ের বাসায় যাব। আর আমার স্ত্রী ডালিয়াকে পাঠিয়ে দিলাম দোভাস বাড়িতে। নিজ বাসা মোমিন রোড থেকে হাঁটা শুরু করলাম চন্দনপুরার হুদা ভাইয়ের বাসার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন দুর্লভ স্মৃতি ও তার সাহচর্যের  ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কোনোমতে অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না। হায়েনার দলের বুলেটে ঝাঁজরা করে দিল বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনায়ককে। যাকে ঘিরে এ দেশের ১০ কোটি মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল একটি সার্বভৌম ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ এক শোষণহীন সমাজ। মনে পড়ছিল ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারণার সময়কার নানা স্মৃতির কথা।

আজ থেকে আটত্রিশ বছর আগে ১৯৭৮ সালে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’-এর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণাকালে শহীদ জিয়া রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম শহর অভিমুখে বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী সভায় বক্তব্য রেখে হাটহাজারী থানার পার্বতী হাইস্কুল ময়দানে এক বিশাল নির্বাচনী সভায় যোগদান করেন। আমি হাটহাজারী থানার জাগদলের আহ্বায়ক ও হাটহাজারী থানার জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের আহ্বায়ক হিসেবে উক্ত ঐতিহাসিক নির্বাচনী প্রচারণা সভায় সভাপতিত্ব করছিলাম। এ যেন আমার জন্য এক দুর্লভ মুহূর্ত। রাষ্ট্রপতি জিয়া মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সফরসঙ্গী সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী মরহুম জামাল উদ্দিন প্রথমে বক্তব্য রাখছিলেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়ার বামপাশের চেয়ারে বসে আমি উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করার সময় প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানকার খবর কী, আমি এখানে কত শতাংশ ভোট পাব। আমি প্রতিউত্তরে বললাম, স্যার এখানে আপনি ৭০ শতাংশ ভোট পাবেন। তখন তিনি বললেন, আপনি আমাকে সত্য কথাটি জানালেন। রাঙামাটি থেকে এখানে আসা পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচনী সভায় বক্তব্য রেখেছি প্রতিটি সভার সভাপতি আমাকে জানিয়েছেন যে, ওইসব এলাকায় আমি নাইনটি পার্সেন্ট ভোট পাব। তারা বুঝতে পারেনি যে, I am no. fool’।

লেখক : সাবেক প্রতিমন্ত্রী, মেয়র, রাষ্ট্রদূত ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর