বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিএনপিকে অপেক্ষাই করতে হবে

বিভুরঞ্জন সরকার

বিএনপিকে অপেক্ষাই করতে হবে

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, ‘কোনো স্বৈরশাসকই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে সক্ষম হয়নি’। একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন জরিপে পাঠকদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, আপনি কি তার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত? ৪৮ শতাংশ পাঠক হ্যাঁ এবং ৫০ শতাংশ পাঠক না জবাব দিয়েছেন। ২ শতাংশ পাঠক কোনো মন্তব্য করেননি। দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠক বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। অর্থাৎ স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেন বলে পাঠকদের বড় অংশই মনে করেন। ইতিহাসও কিন্তু এর পক্ষেই সায় দেয়। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা, লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা সুযোগ পেলেই উচ্চারণ করে থাকেন যে, স্বৈরশাসকদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টাটাই দেখা যায়। একটি নির্বাচিত সরকার প্রতি পাঁচ বছরে পরিবর্তন ঘটতে পারে, ঘটেও। এক নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনে সক্ষম হয়, পরের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। এটাই গণতান্ত্রিক শাসনে সাধারণত ঘটতে দেখা যায়। পরপর কয়েক নির্বাচনে জয়লাভের ঘটনাও ঘটে। তবে গণতান্ত্রিক শাসনের সাধারণ নিয়ম হলো, একটি নির্বাচিত সরকার পাঁচ বছর (কোথাও কোথাও চার বছর) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা দখলের পাঁচ বছরের মাথায়ই ক্ষমতা ছেড়ে বিদায় হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত যেমন আমাদের দেশে নেই, তেমনি বিদেশেও নেই। তারপরও আমরা কেন যে বলি স্বৈরশাসকের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না!

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করেছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন সামরিক একনায়ক, স্বৈরশাসক। তাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে এক দশকের বেশি সময় লেগেছিল। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান সামরিক ক্ষমতাবলেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিলেন, স্বৈরশাসকই ছিলেন তিনি। চট্টগ্রামে সেনাসদস্যদের হাতে নিহত না হলে তার শাসনকাল হয়তো দীর্ঘই হতো। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন সামরিক ক্ষমতাবলে। তার শাসনকালও প্রায় এক দশকই স্থায়ী হয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে  স্বৈরশাসকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সময়কাল আরও দীর্ঘ।

বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলের নিয়ম চালু হওয়ার পর আমরা কী দেখেছি? ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। পরের নির্বাচনেই বিদায়। মাঝখানে একটি একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করলেও সে সরকার হয়েছিল খুবই স্বল্পস্থায়ী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। পাঁচ বছর পরের নির্বাচনে তারও বিদায়। আবার ২০০১-এর নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসেন খালেদা জিয়া। পাঁচ বছর পরে আবার বিদায়। তাহলে এ কথা কি বলা যায় যে, কোনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে সক্ষম? নির্বাচনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে জয়লাভ করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার রেকর্ডও নেই তা নয়। আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে পরিচিত, ভারতে একসময় ভোটে জিতেই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে সক্ষম হয়েছিল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বামফ্রন্ট টানা ৩৪ বছর শাসন করেছেন। অন্য রাজ্যেও এরকম টানা শাসনের নজির আছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই রাজনীতিতে নিয়ম হিসেবে ধরা উচিত নয়। এগুলো ব্যতিক্রম। যুক্তরাজ্যে এবং যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ই সরকার গঠন ও বদল হয়। ওই দুই দেশেও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার কোনো উপায়  নেই। ও সব দেশে একই দল বার বার নির্বাচনে জিতে না। আবার এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি সরকারপ্রধানও হতে পারেন না। কাজেই যতই জনপ্রিয়তা থাক না কেন, বিল ক্লিনটন কিংবা বারাক ওবামার শাসনের মেয়াদ কোনোভাবেই আট বছরের বেশি হয় না, হবে না। আবার কারও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হলেই তাকে দুঃশাসক হিসেবে অভিহিত করাটাও সব সময় যুক্তিসিদ্ধ নয়। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ কিংবা সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন বলেই কেউ তাদের দুঃশাসক বলে মনে করেন কি? সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের বালাই ছিল না। শাসকদের শাসনকালও দীর্ঘস্থায়ী ছিল। তাহলে আমাদের রাজনীতিবিদরা এবং আমরা কেন বলি যে, কোনো স্বৈরশাসকই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে না? গণতান্ত্রিক শাসকও তো ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে না। সে জন্যই বরং এটা বলাই যুক্তিসঙ্গত যে, কারও ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সঙ্গে স্বৈরাচারী কিংবা গণতান্ত্রিক হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের জন্ম-মৃত্যুর স্বাভাবিকতার মতো ক্ষমতার পরিবর্তনও স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ক্ষমতা যে কারও চিরস্থায়ী নয়, এই স্বাভাবিক ও সাধারণ বিষয়টি ক্ষমতাসীনরা ও ক্ষমতাপ্রত্যাশীরা বুঝতে চায় না। সে জন্যই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনীতিবিদরা কত ধরনের কাণ্ডকীর্তিই না করে থাকেন। ক্ষমতার মধুর হাঁড়ির লোভ সামাল দেওয়া রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন। আমাদের দেশে এখন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ দেশের একটি অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। জনসমর্থনের বিচারে বিএনপিও একটি বড় দল। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসন করলেও এক দল আর এক দলকে সহজভাবে মানতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো, এই ‘দীর্ঘস্থায়ী’ বলতে বিএনপি মহাসচিব ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? তারা কি মনে করছেন খুব অল্প সময়, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সরকারের পতন হবে? যদি তারা সেটা মনে করেন তাহলে প্রশ্ন আসে, কীভাবে সরকারের পতন হবে? আন্দোলনের মাধ্যমে, নির্বাচনের মাধ্যমে— নাকি হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে? বিএনপির ভাষায় বর্তমান সরকারকে যদি ‘স্বৈরশাসক’ হিসেবেও ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও প্রশ্ন আসে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর বৈধ উপায় কী? নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তনের কোনো বৈধ পথ নেই। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে সরকার পরিবর্তন হলেও সেটাকে জনমতের অভিপ্রায় হিসেবে ধরে ‘গণতান্ত্রিক’ বলেই মেনে নেওয়া হয়। এখন সরকার পরিবর্তনের জন্য বিএনপির পরিকল্পনা কী? তারা কি প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের পতন চায়? নাকি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলের অপেক্ষায় থাকবে? আরও একটি বিকল্পের কথা আগেই বলা হয়েছে, সেটা হলো ‘হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্র’। বিএনপি কোন পথ ধরবে? বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর সহযোগিতা নিয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ফেলে দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বিএনপির কারও কারও জড়িত থাকার কথা। কদিন ধরেই এ নিয়ে নানা ধরনের তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। এই খবরটি দেশের ভিতর ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে। খোদ বিএনপির মধ্যেও চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। বিএনপির নবনিযুক্ত সাংগঠনিক সম্পাদক চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আসলাম চৌধুরী মোসাদ ষড়যন্ত্রের নাটের গুরু। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এই ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, সরকারের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ আছে। যেহেতু ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেছে এবং সরকারের হাতেও তথ্য-প্রমাণ থাকার দাবি করা হচ্ছে, সেহেতু বলা যায়, সত্যতা থাকলেও এই ষড়যন্ত্র ডিসেম্বরের মধ্যে কার্যকর হওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। এই ধারায় সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপিকে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র করতে হবে এবং অপেক্ষায় থাকতে হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর  মোসাদ ইস্যু নিয়ে এক সংবাদ সস্মেলনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বিএনপির কোনো ধরনের যোগাযোগ বা সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি এও বলেছেন, বিএনপি কোনো ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস করে না। বিএনপিকে একটি উদারপন্থি, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দাবি করে মির্জা আলমগীর বলেছেন, বর্তমানে সরকার পরিবর্তন সম্ভব শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে। অন্য কোনো পথে সরকার পরিবর্তনের কথা বিএনপি চিন্তাও করে না।

বিএনপি যদি শুধু নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথে সরকার পরিবর্তনের কথা চিন্তা না-ই করে থাকে তাহলে ‘কোনো স্বৈরশাসকই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে না’ বলে মুখরোচক বক্তব্য দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? এটা কি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের মনোবল চাঙ্গা করার টনিক. নাকি বিষয়টি এমন : ঢিল একটি ছুড়ে রাখলাম, বক যদি মারা যায় তাহলে কেরামতি দাবি করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের জন্য বিএনপিকে তাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর যেটা বাকি থাকে সেটা হলো গণআন্দোলন। বিএনপির নেতৃত্বে দেশে কোনো গণআন্দোলন গড়ে উঠবে সেটা সম্ভবত বেগম খালেদা জিয়াও এখন আর বিশ্বাস করেন না। সে জন্য আগে যেমন তিনি ঘন ঘন আন্দোলনের হুঙ্কার দিয়ে সরকার পতনের সময় বেঁধে দিতেন, এখন আর তা দিচ্ছেন না। মির্জা আলমগীরও যেহেতুু বলেছেন, বিএনপি ‘অন্য কোনো পথে সরকার পরিবর্তনের কথা চিন্তাও করে না’— সেহেতু এটা মনে করাই স্বাভাবিক যে আন্দোলনের কোনো পরিকল্পনা আপাতত বিএনপির নেই। বিএনপির এখন উচিত হবে পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়া। বিএনপিকে একটি নিয়মতান্ত্রিক, উদার, গণতান্ত্রিক দল হিসেবেই নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরতে হবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অধৈর্য  হয়ে শর্টকাট পথ না খুঁজে মিয়ানমারের জনপ্রিয় নেত্রী অং সাং সু চির মতো অপেক্ষা করতে হবে। সবুরে মেওয়া ফলে বলে যে প্রবাদটি চালু রয়েছে বেগম জিয়াকে সেটা বার বার মনে করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর