শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

জীবন গঠন করার মাস মাহে রমজান

মুফতি আমজাদ হোসাইন

জীবন গঠন করার মাস মাহে রমজান

আজকের লেখা হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর একটি কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি বলেন, পবিত্র রমজানের রোজা দ্বারা শুধু পশুপ্রবৃত্তিই ধ্বংস হয় না, বরং কেউ যদি রমজানের রোজা সঠিকভাবে রাখে এ রোজা দ্বারা তাকওয়ার উচ্চাসনে উপনীত হতে পারে এবং খাঁটি পরহেজগার ও মুত্তাকি হতে পারে। কারণ তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব অনুভব করে সব গুনাহ পরিত্যাগ করা, অর্থাৎ এ কল্পনা করা যে, আমি আল্লাহর বান্দা, আল্লাহ আমাকে দেখছেন, একদিন আমাকে আল্লাহর সম্মুখীন হতে হবে, আমার সব কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। মৌলিকভাবে একজন মুত্তাকি ব্যক্তির ভিতরে এ ধরনের অবস্থা তৈরি হয়, আর এ অবস্থা তৈরির পেছনে রোজার অনেক বড় অবদান। কিন্তু রোজাদারের মনে রাখতে হবে যেমনিভাবে আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য রোজা রেখেছি এ রোজা কবুল হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার সবই করতে হবে। কিন্তু এমন যাতে না হয় এক ব্যক্তি খুব আগ্রহের সঙ্গে রোজা রাখল কিন্তু রোজার প্রকৃত অর্থ কি? বা রোজা কি চায় তার কিছুই বুঝল না বা বোঝার চেষ্টাও করল না। সে শুধু দিনে পানাহার পরিত্যাগ করল ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা পূর্ণ করা থেকে বিরত রইল ঠিক; কিন্তু প্রকৃত রোজাদার হওয়ার কোনো সিদ্ধান্তই নিলো না। প্রকৃত রোজাদার হতে হলে সব শরিয়তবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। যেমন মিথ্যা, গীবত, শেকায়েত, পরনিন্দাসহ ইত্যাদি। এ সম্পর্কে এক হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কাজ পরিত্যাগ করতে পারল না, তাহলে তার এরূপ ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকার কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। (মিশকাত:১৭৬)।

মাহে রমজানের রোজা এত ফজিলতপূর্ণ কেন? এ সম্পর্কে রসুল (সা.) হাদিসে বলেন, আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দিব। (তিরমিজি শরিফ : ৭৬৪)। অন্যান্য আমলের ব্যাপারে তো বলা হয়েছে যে, কোনোটার প্রতিদান দশগুণ, কোনটার সত্তরগুণ, কোনোটার একশগুণ এমনকি সদকার প্রতিদান সাতশগুণ পর্যন্ত বলা হয়েছে। কিন্তু রোজাদার রোজা রাখে শুধু আল্লাহকে পাওয়ার জন্য। তাইতো দেখা যায় একজন রোজাদার গরমকালে তার প্রচণ্ড পিপাসা লেগেছে। তার সামনে পানি টগবগ করছে এমনকি সে নির্জনেও আছে পানি পান করার সব ব্যবস্থা থাকার পরও লোকটি পানি পান করছে না। তার মনে মনে সিদ্ধান্ত— যদি এই রোজামুখে মারাও যাই, তারপরও রোজা ভাঙা যাবে না। লোকটির মনেপ্রাণে আল্লাহর ইশক-প্রেম ভরপুর। এ ধরনের অনুভূতির নামই হচ্ছে তাকওয়া। বোঝা গেল মাহে রমজান মুত্তাকি হওয়ার ও জীবন গঠন করার মাস। এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত করে, বেশি বেশি সওয়াব হাসিল করে জীবনের গতিকে পরিবর্তন করে দিতে হবে। জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। আগের সব খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে একজন সাচ্চা মুসলমান হয়ে যেতে হবে। পরকালের জন্য নিজেকে পুরোপুরিভাবে তৈরি করতে হবে। এ রমজান মাসে মহান রাব্বুল আলামিন ইবাদত বন্দেগিও বেশি রেখেছেন, সওয়াবও বেশি রেখেছেন, যাতে মানুষ নতুনভাবে জীবনকে গঠন করে নিতে পারে। আর মানুষের জীবন গঠন করার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা ও বড় শত্রু হলো ইবলিস শয়তান। এ বড় শত্রুকে রমজান মাসে বেঁধে রাখা হয়। যাতে মানুষ নতুনভাবে আল্লাহ ও আল্লাহর রসুল (সা.)-এর প্রদর্শিত পথে জীবন গঠন করতে কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়। মানুষ শরিয়ত মোতাবেক নিজের জীবন গঠন করতে পারে। ইবলিস-শয়তান যেহেতু বাঁধা থাকে তাই সে এ মাসে মানুষকে গুনাহ করার ওয়াসওয়াসা অন্য সময়ের তুলনায় কম দিতে পারে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অনেক মানুষকে দেখা যায় তারা অন্যান্য মাসের মতো মাহে রমজানেও গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকে। শয়তান যদি এক মাসের জন্য বাঁধাই থাকে তাহলে তারা কীভাবে গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকে। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে বলতে হবে যদিও মানুষের বড় শত্রু ইবলিস বাঁধা থাকে কিন্তু নফস শয়তান তো প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে রয়েছে। যাকে নফসে আম্মারা বলা হয়। সে মানুষকে গুনাহের ওয়াসওয়াসা দিয়ে থাকে, যারা ইবলিসকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়েছে রমজানের ভিতরেও নফসে আম্মারা গুনাহের কাজে লিপ্ত রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। এটাকেই নফসে আম্মারা বলা হয়। এ নফসে আম্মারার পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত খারাপ চিন্তা আসতে পারে।

তা এলে সঙ্গে সঙ্গে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম পড়ে নিতে হবে। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে ইবাদত করার তৌফিক চেয়ে নিতে হবে এবং মজবুতির সঙ্গে ইবাদতের ওপর অটল থাকতে হবে। যদি মানুষ সঠিকভাবে ইসলামের রঙে জীবন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং নফসে আম্মারাকে প্রতিহত করে ইবাদতের কাজে লিপ্ত থাকে। তখন সে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত পেতে থাকে। নিজের জীবনকে গঠন করার জন্য নিজের একান্ত সিদ্ধান্তের বিকল্প নেই। মানুষ যখন হিম্মত করে তার জন্য কঠিন থেকে কঠিন কাজও খুব সহজ হয়ে যায়। রমজানে রোজা রাখার ব্যাপারটাও এরকম। কেউ যদি হিম্মত করে আমি এ বছরে রমজানের হক আদায় করে রোজা রাখব, তারাবিহ আদায় করব, নফল ইবাদত ও পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত করব, কোনো ধরনের গুনাহের কাজে লিপ্ত হবো না। দেখা যাবে, এক মাস এভাবে ইবাদত করার কারণে বাকি এগারো মাসও এ নিয়মেই চলতে পারবে। এভাবে সারা জীবন শরিয়ত মোতাবেক জীবন পরিচালিত হলে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে জান্নাত পাওয়ার এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির আশা করা যায়। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে মাহে রমজানের জীবন গঠন করার তৌফিক দান করুন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর