সোমবার, ৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

খুনের চেয়েও বড় অপরাধ

হায়দার আকবর খান রনো

খুনের চেয়েও বড় অপরাধ

ক্ষমতার দাপটের সামনে আমরা সবাই অসহায়। নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী শ্যামলকান্তি ভক্তকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করার পর চারদিকে প্রবল প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও আমরা আশ্বস্ত হতে পারিনি। এই প্রথম দেখলাম ক্ষমতাসীনদের কারোর দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার পর সরকার পক্ষের লোকদের কেউ কেউ সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। শিক্ষক শ্যামলকান্তিকে সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন মন্ত্রী মো. নাসিম। তার সামনে শিক্ষক শ্যামলকান্তির আচরণ দেখেও মনে হয়েছে কত অসহায় একজন শিক্ষক হতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী কিছু অ্যাকশন নিয়েছেন। শ্যামলকান্তিকে স্বপদে পুনর্বহাল করা হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটি বাতিল হয়েছে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট?

একজন শিক্ষক দরিদ্র হলেও সমাজে সম্মানী ব্যক্তি বলে বিবেচিত হন এবং সেটাই আমাদের বাঙালি সমাজের আবহমানকাল থেকে চলে আসা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। তেমনি একজন শিক্ষক যেভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন তা তো খুনের চেয়েও অধিক ভয়ঙ্কর এবং নিশ্চিতভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেই অপরাধ যিনি বা যারা করেছেন, তারা কিন্তু এখনো সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কারণ তারা ক্ষমতাবান। তারা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট পরিবারের সদস্য।

কান ধরে উঠবোস করানো নাকি ফৌজদারি অপরাধ নয়। তাই পুলিশ মামলা নেয়নি। অবশ্য আইনমন্ত্রী বলেছেন, সেলিম ওসমান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে, কান ধরে উঠবোস করিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় লিখেছেন, ‘যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ওসমান পরিবার আওয়ামী লীগ কর্তৃক আশীর্বাদপুষ্ট, সেখানে আমরা ন্যায়বিচারের আশা করব কী করে?’ (দেখুন বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ মে’র সংখ্যা)

তবু আমরা আশা করতে চাই। হয়তো নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং সেটা বেশ পুরনো। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রী স্বদলের কেউ অপরাধ করলে দায়মুক্তি দেবেন? একটা অন্য উদাহরণ দেওয়া যাক। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদের সবাই সম্মানিত। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি গুরুতর অপরাধ করেন তাহলে কি তাদের ছাড় দেওয়া হবে? বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, তাদের অনেকেই খেতাবপ্রাপ্ত (খেতাব দিয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু) মুক্তিযোদ্ধা। তাহলে একদা ওসমান পরিবার আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করলেও তাদের সব অপকর্মকে হালকা করে দেখা ঠিক হবে না। আশা করি প্রধানমন্ত্রী তেমনটা করবেন না।

সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান যেটা করেছেন তা হয়তো ফৌজদারি আইনের বিশেষ ধারার মধ্যে পড়বে না। কিন্তু তিনি আহত করেছেন আমাদের বিবেককে। নিহত করেছেন শিক্ষক সমাজের মানসম্মান ও জাতীয় ঐতিহ্যকে। এ অপরাধ কোন আইনে হবে জানি না। কিন্তু তা যে অপরাধ তা মানতেই হবে। হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে এটাকে অপরাধ গণ্য করে মামলা নিয়েছেন। রিপোর্ট চেয়েছেন প্রশাসনের কাছে। প্রশাসনের দেওয়া রিপোর্ট পড়ে হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বলেছেন দায়সারা গোছের রিপোর্ট। ইতিমধ্যে এক মন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আর বাড়াবাড়ির দরকার নেই।

এদিকে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সেলিম ওসমান নিজেকে নির্দোষ দাবি করে যা বলছেন তাতেও তার দোষ ঢাকা পড়ে না। তিনি একেকবার একেক কথা বলেছেন। প্রথমে শিক্ষককে কান ধরে উঠবোস করতে বলেননি বলে দাবি করেছিলেন। পরে ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়লে তিনি বললেন, শিক্ষককে জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য এমন নির্দেশ দিয়েছেন। যে কোনো অজুহাতই হোক না কেন, এমন নির্দেশ কি তিনি দিতে পারেন? তিনি যে সাংস্কৃতিক মনের পরিচয় দিয়েছেন, তাকে সহজভাবে মেনে নিলে সমাজ কলুষিত হবে। না, কোনোভাবেই তা সহজভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এ এক বিকৃত নোংরা মনের পরিচয় বহন করে। অথচ তারাই প্রচণ্ড প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ আমলে একেকটা এলাকায় একেকটা ক্ষুদে ‘লর্ডের’ আবির্ভাব ঘটেছে, যারা দ্বিধাহীন চিত্তে অপরাধ করেই চলেছেন। কোনো প্রতিকার নেই। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় পিরোজপুরের এমনই এক প্রচণ্ড ক্ষমতাবান পরিবারের কাহিনী দেখলাম। তার আগে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন ১২ বছরের ছেলে সৌরভকে পায়ে গুলিবিদ্ধ করেও সংসদ সদস্য পদে বহাল আছেন। গত পয়লা জুন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান এক নির্বাচন কর্মকর্তাকে পেটালেন। কারণ কী? কারণ উক্ত নির্বাচন কর্মকর্তা এমপির পছন্দমতো লোককে ইউপি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেননি। বলাই বাহুল্য, এমপি কর্তৃক এভাবে নিয়োগ প্রদানের জন্য নির্বাচন কর্মকর্তাকে অনুরোধ বা হুকুম দেওয়া অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নির্বাচনের নিরপেক্ষতায় হস্তক্ষেপ বলে গণ্য হবে। সেসব প্রশ্ন না হয় আপাতত বাদ রাখলাম। কিন্তু একজন নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর করা— এ কোন কালচারের জন্ম দিল আওয়ামী লীগ? এ রকম ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ইঞ্জিনিয়ার পিটিয়ে আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।

আমাদের সংসদ সদস্যদের কয়েকজনের বিশেষ পরিচয় তুলে ধরেছিল বাংলাদেশ প্রতিদিনের গত বছরের (২০১৫) ১৪ আগস্টের সংখ্যা। সেখান থেকে দু-একটি বাক্য উদ্ধৃত করা যাক। ‘সন্ত্রাসী লালন, মাস্তানিতে অংশগ্রহণ, মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে বিতর্কে পড়েছেন সরকারি দলের দুজন আইনপ্রণেতা, দুজন প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী।’ নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল র‌্যাবের হাত থেকে আসামি ছিনতাই করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে উক্ত প্রতিবেদনে।

ফিরে আসি নারায়ণগঞ্জের ঘটনায়। সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান বলেছেন, তিনি নাস্তিককে শাস্তি দিয়েছেন। যে কোনো ব্যক্তির যে কোনো ধর্মে বিশ্বাস রাখার বা পালন করার এবং কোনো ধর্মে বিশ্বাস না রাখার পূর্ণ অধিকার আছে। নাস্তিকতার অভিযোগ তুলে খালেদা জিয়াও গণজাগরণ মঞ্চকে অভিযুক্ত করেছিলেন। স্পষ্টতই খালেদা জিয়া গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দেননি। এখন আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট ওসমান পরিবার যদি একই পথে হাঁটেন এবং আওয়ামী লীগ সরকার যদি নীরব থাকে, তাহলে এ সরকারও যে গণতান্ত্রিক নয়, তা-ই প্রমাণিত হবে।

নাস্তিকতার পাশাপাশি আরও একটি মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন সংসদ সদস্য। শিক্ষক শ্যামলকান্তি নাকি ইসলাম ধর্মবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। মানুষকে ক্ষেপানোর সবচেয়ে সস্তা উপায়। মসজিদের মাইক ব্যবহার করে কে বা কারা এমন মিথ্যা প্রচার করেছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যারা ঘটনাস্থলে সমবেত হয়েছিল, তারা সংসদ সদস্যের নিজস্ব লোক। কান ধরে উঠবোস করানোর সময় তারা উৎসাহের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলছিল। যে জয় বাংলা ছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি, তা আজ ব্যবহৃত হচ্ছে কী ধরনের অপকর্মে। আমরা কি অধঃপতনের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছি?

এ ঘটনা প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে হয়। পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা বোধহয় এখনো ঢেপে আছে। শুধু বিএনপি-জামায়াতের মধ্যেই নয়, শাসক দলের মধ্যেও। পাকিস্তানি শাসকদের বড় হাতিয়ার ছিল ধর্ম। যে কোনো অপরাধীকে ঢাকা দেওয়ার জন্য তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত ধর্ম। সরকারবিরোধী যে কোনো আন্দোলনকে তারা ইসলামবিরোধী বলে চিত্রিত করতে চাইত। এখনো দেখছি একজন প্রধান শিক্ষককে অপমান, প্রহার ও অপদস্থ করার জন্য তাকে ইসলামবিদ্বেষী বলে প্রচার করা হচ্ছে। বিষয়টি আরও গুরুতর এ কারণে যে, উক্ত শিক্ষক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এ ঘটনার যদি যথাযথ সুবিচার না হয়, তাহলে আমাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অসহায় বোধ করবেন। একজন হিন্দু শিক্ষককে ইসলামবিদ্বেষী বলে উত্তেজনা সৃষ্টি করা সহজ। কিন্তু এরকম উত্তেজনা বর্তমান সরকারের জন্য যে কাল হয়ে দেখা দিতে পারে, সেই উপলব্ধি কি সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আছে?

আমরা অবাক হয়ে দেখছি, নারায়ণগঞ্জের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কিছু সংস্থা সেলিম ওসমানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ক্ষমতার কাছে অনেকেই বশ্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু তাতে জনমত যে প্রভাবিত হয়নি, এটাই শুভ লক্ষণ। দেশব্যাপী যে প্রতিবাদের ঝড়  উঠেছে, তাতেই খানিকটা আশ্বস্ত হচ্ছি। কিন্তু দোষী ব্যক্তি উপযুক্ত শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত মনকে শান্ত করব কী দিয়ে?

আমরা লক্ষ্য করলাম চরম প্রতিক্রিয়াশীল হেফাজতে ইসলাম সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের পক্ষ নিয়েছে। তারাও নাস্তিকতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। পাশার দান যেন পাল্টে গেল। যে হেফাজত মাত্র কিছুদিন আগে বিএনপির সমর্থনপুষ্ট হয়ে সরকার পতনের পরিকল্পনা করেছিল এবং ঢাকায় তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল, সেই হেফাজতের সঙ্গে কি সরকারের গোপন সমঝোতা তৈরি হয়েছে? বিভিন্ন আলামত থেকে তাই মনে হয়। হেফাজতকে মাঠে নামিয়ে, নাস্তিকতার অভিযোগ তুলে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সামাজিক অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন চক্র যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করছে তার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। সরকারকে দূরে বসে দর্শকের ভূমিকা পালন করলে চলবে না। সরকারকে ফিরিয়ে আনতে হবে শিক্ষকের সম্মান এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের আস্থা।

     লেখক : রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর