শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাদশাহ আলমগীর ও বাংলাদেশের এক সম্রাটের কাণ্ড

ড. শেখ আবদুস সালাম

বাদশাহ আলমগীর ও বাংলাদেশের এক সম্রাটের কাণ্ড

আমি একজন যোগাযোগের ছাত্র। যোগাযোগ বিষয় পড়তে গিয়ে জেনেছি যোগাযোগ হচ্ছে মানব তথা প্রাণিকুলের সবচেয়ে আদি অভিব্যক্তি ও মানব জীবনের একেবারে একটি মৌলিক বিষয়। জীবন প্রবাহের ক্ষেত্রে এটি এতই স্বতঃসিদ্ধ যে, যোগাযোগ ছাড়া জীবনকে কল্পনা করাই যায় না। যোগাযোগ মানব সমাজে যে কাজগুলো করে পণ্ডিতরা তার একটিকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ঐতিহ্য বিচ্ছুরণ অর্থাৎ transmission of heritage’র কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। আর যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ঐতিহ্য সঞ্চালন করে থাকেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে পরিবার ও সমাজের শিক্ষাদাতা হিসেবে। সব সমাজেই অন্যান্যের পাশাপাশি মোটাদাগে শিক্ষাদাতা হচ্ছেন শিক্ষকরা। সেই আদিকাল থেকেই শিক্ষকরা তাই সমাজে একটি আলাদা এবং মর্যাদাবান সত্তার অধিকারী হিসেবেই সম্মানিত হয়ে আসছেন। দুনিয়াব্যাপী সব সমাজ তা মেনেও নিয়েছে এবং বিষয়টি তাই সার্বজনীন।

এই উপমহাদেশে রাজা-বাদশাহদের দরবারে যিনি তাদের সন্তানদের পাঠ শিখাতেন তার কদর ছিল আলাদা। আমরা বাদশাহ আলমগীরের সেই গল্পটি হয়তো অনেকেই জানি। তবুও পাঠকদের একটু মনে করিয়ে দেই। গল্পটি হচ্ছে যে, বাদশাহ আলমগীরের সন্তানকে তার এক ওস্তাদ বা শিক্ষক বাদশাহর বাড়িতে এসে পাঠদান করতেন। একদিন শিক্ষক কাদামাটি পায়ে বাদশাহ আলমগীরের সন্তানকে পড়াতে এসেছেন। পড়তে বসার আগে সন্তান তার শিক্ষকের পায়ে বদনা (পাত্র) দিয়ে পানি ঢালছে এবং শিক্ষক তার নিজ হাত দিয়ে পায়ের কাদামাটি পরিষ্কার করছেন। বাদশাহ আলমগীর এটা দেখে এগিয়ে এসে শিক্ষককে বললেন, শিক্ষক তার সন্তানকে কেমন শিক্ষা দিয়েছেন? অন্যদিকে সন্তানইবা শিক্ষকের কাছ থেকে কেমন শিক্ষা গ্রহণ করেছে যে, সে তার নিজ হাত দিয়ে শিক্ষকের পায়ের কাদামাটি না ছাড়িয়ে দিয়ে শুধুই পানি ঢালছে? অতঃপর তিনি তার সন্তানকে নিজ হাত দিয়ে শিক্ষকের পায়ের কাদামাটি ছাড়িয়ে দিতে উপদেশ দিলেন। বাদশাহ আলমগীরের এই কাহিনী আজও দুনিয়াজুড়ে মৌলভী, পণ্ডিত, মাস্টার মহাশয়, শিক্ষক সবাইকে মহিমান্বিত আসনে আসীন করে রেখেছে; শিক্ষার্থীরাও শিখেছে কীভাবে শিক্ষককে মর্যাদা দিতে হয়। 

আমি নিজেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। আজও আমার সত্তা যেন আমার নিশিকাণ্ড মাস্টার মহাশয়, হাশেম স্যার, নূরো স্যার কিংবা চিত্ত স্যারদের ঘিরে আবর্তিত। আমাদের সময়ে আমাদের শাসন করার ভার আমাদের পরিবার এবং সমাজ এসব শিক্ষক এবং গুরুজনদের হাতেই ন্যস্ত করেছিল। আমাদের শাসন (বেত্রাঘাত পর্যন্ত) করার অধিকারই যেন ছিল এসব শিক্ষকের। এটাও ঠিক, আমাদের শিক্ষকরা আমাদের শাসন করতেন ঠিকই কিন্তু তারচেয়ে সোহাগ করতেন বেশি। পড়া ফাঁকি দিলে এমনকি বাড়িতে কোনো অন্যায় করলে আমাদের অভিভাবকরা এসব শিক্ষকের কাছে গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ দিয়ে আসতেন। শিক্ষকের শাসন-সোহাগের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠত শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথা গুরু-শিষ্যের বন্ধন এবং সম্পর্ক। যে কোনো এবং যে স্তরেরই শিক্ষক হোক না কেন একজন শিক্ষক সমাজে সবারই শিক্ষক মর্যাদায় অভিসিক্ত হতেন।

বাদশাহ আলমগীরের আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল কিংবা বাংলাদেশ সমাজেও এই একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রোথিত এবং এ ধরনের লাখ লাখ উদাহরণ আমাদের সবার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে। যতদূর মনে পড়ে আমি বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের পরে অধ্যাপক আবুল ফজল সাহেবের একটি লেখা পড়েছিলাম। তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন এবং তিনি ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। অধ্যাপক আবুল ফজল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কাজে একদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভবনে তার সঙ্গে দেখা করতে এসে নিচতলায় বসে অপেক্ষা করছিলেন। মরহুম আবদুর রাজ্জাক কিংবা আজকের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এদের কেউ একজন গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে এই বার্তাটি পৌঁছে দেন। খবর পেয়েই বঙ্গবন্ধু তত্ক্ষণাতই নিজে নিচে নেমে এসে অধ্যাপক আবুল ফজলকে ওপরে নিয়ে যান এবং নিচ তলায় অধ্যাপক আবুল ফজলের অপেক্ষমাণ থাকার কথা বঙ্গবন্ধুকে কেন জানানো হয়নি সে কারণে তিনি নিচের অফিসকর্মীদের খানিকটা বকাঝকাও করেছিলেন।

আমরা শুনেছি স্বাধীনতার পর একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ছাত্রদের দ্বারা কোনো এক কারণে তার অফিসে ঘেরাও হয়েছিলেন; ছাত্ররা তাকে অসম্মান করার চেষ্টা করছিল। এই খবর পেয়েই বঙ্গবন্ধু সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন এবং উপাচার্য মহোদয়কে ওই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে ছাত্রদের এমন ধরনের আচরণ থেকে ভবিষ্যতে বিরত থাকার জন্য সাবধান করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কর্তৃক শিক্ষককে সম্মান করা কিংবা সম্মানহানির আশঙ্কা থেকে শিক্ষককে রক্ষা করার এই উদাহরণ দুটি শিক্ষকসত্তাকে নিশ্চয়ই আজও গৌরবান্বিত করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসেছিলেন। রুম ভর্তি ওই সভার প্রথম সারিতে সম্ভবত তার সাবসিডিয়ারি ক্লাসের শিক্ষক (এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট ভাই শেখ কামালের সরাসরি শিক্ষক) সমাজবিজ্ঞানের প্রয়াত অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন উপস্থিত ছিলেন। স্বভাবতই নেত্রী আসাতে সবার সঙ্গে অধ্যাপক রঙ্গলাল সেনও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন আমি লক্ষ্য করেছিলাম রঙ্গলাল স্যার দাঁড়িয়ে থাকা পর্যন্ত শেখ হাসিনা তার নির্ধারিত চেয়ারে বসেননি। তিনি বক্তৃতা দিতে উঠে শুরুতেই শ্রেণিকক্ষের ছাত্রীর মতো কাচুমাচু করছিলেন এবং সরাসরি বলেই ফেলেছিলেন যে, তার শিক্ষক অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন এবং অন্য শিক্ষকদের সামনে তিনি কীভাবে বক্তৃতা দেবেন তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। যা হোক, সেদিনও তিনি মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষকের প্রতি তার ভঙ্গি ও বিনয় তাকে যেন সেদিন আরও আলোকিত এবং উজ্জ্বল করে তুলেছিল।

পাঠকদের আরও একটি ঘটনার কথা বলি। জননেত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বৌভাত অনুষ্ঠান। ধানমন্ডির ৫ নম্বরে আয়োজিত এই ভৌভাত অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের জন্য আলাদা আয়োজন এবং খাওয়ার সময় টেবিলে টেবিলে ঘুরে ঘুরে শেখ হাসিনা যেভাবে সেদিন নিবিড় তদারকি করছিলেন আমরা তখন তা আগ্রহভরে প্রত্যক্ষ এবং উপভোগ করেছিলাম। শিক্ষক হিসেবে তা ছিল আমাদের জন্য আর একটি মর্যাদাভোগের উদাহরণ।

যা হোক, একজন শিক্ষক বা শিক্ষকসত্তা আসলে কী চায়? আমার ধারণা মোটামুটি খেয়ে-পরে একটু মর্যাদা নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করতে পারলেই তারা খুশি। কিন্তু শিক্ষকদের কপালে তা সব সময় জুটছে কি? শহর-বন্দর- গ্রাম-গঞ্জে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন কর্তৃত্ব করছেন এদেশের সংসদ সদস্য কিংবা তাদের অনুসারীরা। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে পারে; তবে প্রায় ক্ষেত্রেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে চাকরি দেওয়া। শিক্ষক নিয়োগের নামে এই ‘চাকরি দেওয়া’র আড়ালে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সহযোগিতা করার কথা বলে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে আজকাল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের প্রায় সব জায়গায় সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নের কাজটিকে টার্সিয়ারি গণ্য করে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন অন্যান্য কাজে। কাবিখা থেকে মসজিদ-মন্দির, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট-খেয়াঘাট, জলমহাল-বালুমহাল এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তারা নাক গলাচ্ছেন না। এরই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে নারায়ণগঞ্জের এক বিখ্যাত সংসদ সদস্য— সাংবাদিক সোহরাব হোসেনের ভাষায় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্যতম সিপাহসালার সেলিম ওসমানের নির্বাচনী এলাকায়। সংসদ সদস্য তারই এক তল্পীবাহককে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে অবস্থিত পিয়ার সাত্তার লতিফ হাইস্কুল কমিটির সভাপতি বানিয়েছেন। ১৮-২০ বছর ধরে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি করে আসছেন শ্যামলকান্তি ভক্ত। এই প্রধান শিক্ষককে তাড়িয়ে তার স্থলে সভাপতি সাহেব তার বোনকে প্রধান শিক্ষকের আসনে বসাতে চান। এই উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে গত ১৩ মে প্রধান শিক্ষক সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় ‘ইসলাম ধর্মের অবমাননা’ দাওয়াই ব্যবহার করে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে বলা হয় প্রধান শিক্ষক ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে সংসদ সদস্যের সঙ্গে প্রশাসন ও পুলিশের সদস্য এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও উপস্থিত হন। এ সময় সংসদ সদস্য ওই শিক্ষককে তার দুই গালে দুটি করে চড় মেরে তাকে কান ধরে উঠতে-বসতে বলেন (!); প্রাণ বাঁচাতে শিক্ষক তাই-ই করেন। উল্লেখ্য, ওই সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির একজন সদস্য। পত্রিকায় দেখেছি সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপস্থিত লোকজন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে ওই প্রধান শিক্ষকের কান ধরে উঠবোস করার দৃশ্য উপভোগ করেছেন। ঘটনাটি এখানেই থেমে থাকেনি। পরদিন স্কুল কমিটি এই শিক্ষককে তার পদ থেকে চাকরিচ্যুতও করেছে। অনাচারের যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। একটি ভালো খবর যে, শিক্ষামন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোগ নিয়ে ওই শিক্ষককে চাকরিতে বহাল করেছেন এবং স্কুল কমিটি বাতিল করে দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে এই ঘটনা নিয়ে সারা দেশে দলমত এবং পেশা- প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে নিন্দার ঝড় বইয়ে দিয়েছে; দেশব্যাপী ঘৃণ্য এই ঘটনার বিচারের দাবি উঠেছে। সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষ নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্যের ওই জঘন্য কর্মের জন্য তাকে দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চাইতে বলেছেন। Phlph Nader -এর একটি কথা আছে– Your best teacher is your last mistake. কিন্তু এই দুর্বিনীত মানুষটি এখনো পর্যন্ত সে পথে হাঁটেননি। তিনি মনেই করেন না যে, তিনি কোনো ভুল করেছেন। বরং তিনি দম্ভ করে বলেছেন যে, তিনি মরে গেলেও এ ব্যাপারে ক্ষমা চাইবেন না। তিনি কৌশলে ধর্মানুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে পার পেতে চাইছেন। একদা reg Henry Quinn বলেছিলেন A teacher teaches history to those who will make history. আমরা জানি না এই দাম্ভিক সংসদ সদস্য কোনো শিক্ষকের কাছে ইতিহাস পড়েছিলেন কিনা? পড়ে থাকলে তিনি এ কি ধরনের ইতিহাস গড়লেন? ধিক তার এই দানবীয় প্রবৃত্তিকে।

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

     ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর