রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইউপি নির্বাচনে ১৩৭ খুনের দায়ও কি বিএনপির?

কাজী সিরাজ

ইউপি নির্বাচনে ১৩৭ খুনের দায়ও কি বিএনপির?

ছয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষ হয়েছে ৪ জুন। স্থানীয় সরকারের তৃণমূল স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। পাকিস্তান আমলে বলা হতো ইউনিয়ন বোর্ড। জাতীয় নির্বাচন থেকে এ ইউনিয়ন বোর্ড অথবা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মেজাজ সর্বদাই আলাদা ছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে নির্দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের রেওয়াজ ছিল আমাদের দেশে। এবারই প্রথম লীগ সরকার পুরনো রেওয়াজ পাল্টে দিল। নির্বাচন হলো দলীয় ভিত্তিতে, দলীয় প্রতীকে। এটি একটি বড় ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এমন একটি জরুরি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। বলা বাহুল্য, এ সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারি ইচ্ছায়, নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছায় নয়। তাই সরকারের পক্ষ থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ ব্যাপারে সংলাপ ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার এতটাই একগুঁয়ে ছিল যে, এসবের কোনো পাত্তাই দেয়নি। সংসদে তাদের ‘গৃহপালিত’ বলে যে বিরোধী দলটি আছে, এরশাদের সেই জাতীয় পার্টিকেও আস্থায় নেয়নি তারা। বিএনপির কথা তো বাদই। অথচ বিএনপিই হচ্ছে শাসক লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। সাধারণ মানুষের মধ্য এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল যে, দেশে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতবে, ফল ঘোষণার আগে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। অতীত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের রেকর্ড বলে, দুই দলের ‘ভোট ব্যাংক’ প্রায় সমান। অথচ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চরিত্রসংক্রান্ত একটি মৌলিক ইস্যুতে তাদের সঙ্গে আলোচনা-সংলাপের কোনো প্রকার তাগিদই অনুভব করল না সরকার বা সরকারি দল। এর আগে নির্বাচনসংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনকে স্টেকহোল্ডার এবং বিষয়-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা গেছে। স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে, দলীয় প্রতীকে করার ব্যাপারে দুই হাত তুলে সায় দিল ইসি অথচ তারাও কারও সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন মনে করেনি। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করার পেছনে সরকারের কোনো দুরভিসন্ধি আছে। সেই দুরভিসন্ধিটা যে সব রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে, যেনতেন প্রকারে বেশির ভাগ ইউনিয়ন পরিষদ দখল করা, তা পরিষ্কার হলো ছয় ধাপে এই ‘নির্বাচনী খেলা’ সমাপ্ত হওয়ার পর।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার সূচনায়ই সরকারি দল এমন অনৈতিক আচরণ শুরু করে, যাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা অন্য কাউকে জিততে দিতে চায় না। প্রায় ৫০০ ইউনিয়ন পরিষদে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে মনোনয়নপত্রই জমা দিতে দেওয়া হয়নি। শতাধিক ইউপিতে বিএনপি প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। শাসক লীগের লোকজন, দলদাস বুদ্ধিজীবীরা বলতে থাকেন বিএনপি নাকি প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না বলে এতসংখ্যক ইউপিতে তারা প্রার্থী দিতে পারেনি। এটা আসলে শাসক লীগের প্রচারণারই একটি অংশ ছিল। তা না হলে এমন হাস্যকর কথা তারা কী করে বলতে পারে যে, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে বিএনপি প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। ইউনিয়ন তো অনেক ওপরে, এমন কোনো ওয়ার্ড, গ্রাম, পাড়া-মহল্লা, এমনকি বাড়িঘরও আছে যেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কোনো লোক নেই? শাসক দলের পেশিবাজেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য-সহযোগিতায় বাধা দিলে সে বাধা ডিঙিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাধ্য সবার থাকার কথা নয়। আওয়ামী লীগ যা করেছে, এ রকম সুযোগ পেলে বিএনপিও যদি একই কাজ করে তো আওয়ামী লীগও কি পারবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে? বিএনপির বরং প্রশংসা পাওয়ার কথা এজন্য যে, মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে তারা শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়নি। তাতে হানাহানি-প্রাণহানির সংখ্যাই বাড়ত শুধু। প্রশ্ন আসতে পারে, অন্যসব ইউনিয়নে বিএনপি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারল কী করে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, প্রায় অর্ধেক আসনে এটা সম্ভব হয়েছে শাসক লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে। সরকারি দলের প্রার্থীরা বিদ্রোহী প্রার্থী সামলাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন, বিএনপির প্রার্থীর দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত পাননি। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলে বিএনপি প্রার্থীরা আরও প্রায় এক হাজার ইউপিতে সরকারি প্রার্থীর প্রতিরোধের মুখে পড়তেন। সরকারি প্রার্থীরা প্রায় এক হাজার ইউপিতে তো ‘যুদ্ধ’ করলেন নিজেদের মধ্যে, আওয়ামী লীগে-আওয়ামী লীগে। বিএনপির চেয়ে দ্বিগুণ আসনে জিতেছে বিদ্রোহী লীগ। কেন এমন হলো সে বিশ্লেষণে আমরা পরে যাব। সরকার যে যেনতেন প্রকারে ইউনিয়ন পরিষদসমূহ দখল করতে চেয়েছে, তা বোঝার জন্য এই নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের প্রতি আমরা নজর দিতে পারি। ১. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এবারই সর্বাধিক ২০৭ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ১৯৮৮ সালে এরশাদ আমলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চেয়ারম্যানের সংখ্যা ছিল ১০০। ১৯৯৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৭। ১৯৮৮ ও ১৯৯৭ সালে নির্বাচন হয়েছিল নির্দলীয় ভিত্তিতে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরা কোনো একটি দলের সমর্থক ছিলেন না। এবার সবাই শাসক দল আওয়ামী লীগের। ২. নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ৭৫ শতাংশই শাসক লীগের প্রার্থী। বিএনপি জিততে পেরেছে ৩০৫টি পদে মাত্র। আওয়ামী লীগের ১০ শতাংশেরও কম। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এটা একেবারেই সামঞ্জস্যহীন। অবিশ্বাস্যও বটে। শাসক লীগের বিদ্রোহীরাও পেয়েছে বিএনপি থেকে বেশি। এর শানে নুজুল আবার ভিন্ন। সরকারি দলের দ্বন্দ্বে-যুদ্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব থেকেছে। কারও গায়ে হাত তুলতে সাহস করেনি। নির্বাচন কমিশনও নীরব থেকেছে। কেন্দ্র থেকে নমিনেশন ‘কিনে’ নেওয়া প্রার্থীর সঙ্গে তুলনায় বিদ্রোহী প্রার্থী অধিক শক্তিশালী থাকায় ধরাশায়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রত্যয়নকৃত’ প্রার্থী। নমিনেশন বেচাকেনার ভালো ‘খোন্দ’ (মৌসুম) এবার বিএনপিতেও ভালো গেছে। আওয়ামী লীগ বা তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীরা যেসব ইউনিয়নে জিতেছেন, সেসব ইউনিয়নের অনেকটিতে বিএনপির প্রার্থীও ছিলেন ঢাকায় নমিনেশন বিক্রির দলীয় বিভিন্ন পাইকারি হাট থেকে প্রার্থিতা ও ধানের শীষ মার্কা কিনে নেওয়া। দলের জেনুইন প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হলে সরকারি দল বা তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিজয় এত সহজ হতো না। অবশ্য নির্বাচনটা যথাযথভাবে যদি হতো। এই ফাঁকে বিএনপির নমিনেশন ব্যাপারীরা তাদের পয়সাটা সহজে হজম করে ফেলতে পারল। ৩. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এবারই সর্বাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা ১৩৭। এর আগে ১৯৮৮ সালে এরশাদের আমলে ইউপি নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ১০০ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে ১৯৯৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৭। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী আহতের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার, ১৯৮৮ সালে যা ছিল ৫ হাজার।

কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচনটি এমনই হবে, বিএনপি কি তা বুঝতে পারেনি? আমার মনে হয় বিএনপি বুঝে-শুনেই দলীয় ভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। আমাদের এ ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আমল থেকেই শাসককুল তা সামরিক হোক অথবা রাজনৈতিক, স্থানীয় সরকারের কাঁধে চড়ে নানা সংকট মোকাবিলা করেছে। বিশেষ করে কোনো সরকার স্বীয় কৃতকর্মের জন্য যখন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তারা ভিত্তি খোঁজে তৃণমূলে। স্থানীয় সরকারের ওপর ‘আছর’ করতে চায় তারা। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই গ্রামে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিছু হয়। সেখানে রিলিফের কম্বল যায়, ঢেউটিন যায়, চাল-গমও যায় কখনো কখনো। আরও আছে ওয়ার্ক প্রোগ্রামের টাকা বা টাকার বিনিময়ে চাল-গম। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এখানে সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া সহজ নয়। এমন চিন্তা-ভাবনা থেকেই আইয়ুব খান ৮০ হাজার বিডি (বেসিক ডেমোক্র্যাট) মেম্বার বানিয়েছিল যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়ে। গণবিচ্ছিন্ন আইয়ুবকে কিছুদিন টিকে থাকতে সাহায্যও করেছিল ওই ৮০ হাজার ফেরেস্তা খ্যাত বিডি মেম্বার। লীগ সরকার আইয়ুবের সেই অভিজ্ঞতাটা বোধহয় কাজে লাগাতে চেয়েছে। কিন্তু আইয়ুবের ‘ফেরেস্তাদের’ অন্য ভূমিকার কথা বোধহয় সরকারি নীতিনির্ধারকরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেননি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের অগ্নিশিখা যখন প্রজ্বালিত হয় সারা দেশে, বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুবের ‘ফেরেস্তারা’ আর আইয়ুবের পক্ষে থাকেনি। অধিকাংশ হয়ে যায় জনগণের বন্ধু, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মিত্র। তৃণমূলের প্রতিনিধিরা জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যেতে চান না ভবিষ্যতের আশায়। তৃণমূলের স্থানীয় সরকার পরিষদ দৃষ্টিকটুভাবে দখল করতে গিয়ে সরকার প্রমাণ করেছে, এই ইউপি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই প্রয়োজন। এখানে তাদের উদ্দেশ্য দ্বিবিধ বলে মনে করেন পর্ববেক্ষকরা। ১. সরকারের গণভিত্তি নেই বলে দেশে-বিদেশে যে জোর প্রচার আছে, বিশেষ করে বিদেশিদের কাছে তা খণ্ডন করতে চান তারা।

তাদের কোনো মাথা মোটা পরামর্শক বোধহয় এই বুদ্ধি দিয়েছেন যে, দলীয় প্রতীকে যদি অধিকাংশ চেয়ারম্যান পদ কব্জা করা যায় তা দিয়ে বোঝানো যাবে যে শাসক লীগ কত জনপ্রিয়। তাদের কত জনসমর্থন। ২. ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে নানারকম ‘কলা’, ‘মুলা’ দেখিয়ে জনগণকে পক্ষে রাখা যাবে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে সম্পূর্ণই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। স্থানীয় জনসাধারণকে তারা হাতেনাতে চোর ধরার মতো ‘ভোট চোর’ ধরিয়ে দিতে চেয়েছে। তারা দাবি করতে পারে যে, এ কাজে তারা সফল হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেওয়া, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, সিল মারা, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া, হানাহানি, খুনোখুনি সব তাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। নির্বাচন কেমন হয়েছে ডিজিটালব্যবস্থার সুবাদে, তার সচিত্র দৃশ্য বিদেশিরাও দেখেছেন। এ ক্ষেত্রেও বিএনপিকে সফল বলা চলে যে, বিদেশিদের তারা বোঝাতে পেরেছে যে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনের চরিত্র এমনই হবে। তিন সিটি নির্বাচনের পর বলা হয়েছিল, বিএনপি ভোট চলার মাঝখানে নির্বাচন বর্জন না করলে ফলাফল ভিন্নও হতে পারত। পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনে থেকে তারা প্রমাণ করতে পেরেছে। মাঝপথে বর্জন না করলেও ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন করলে ফলাফল এমনই হবে। তাদের আরেকটি বড় লাভ হয়েছে এই নির্বাচনের মাধ্যমে দলের স্থবিরতা কিছুটা হলেও কাটানো গেছে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কে কত চেয়ারম্যান পেল তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে এমনকি সাধারণ্যেরও তেমন কোনো আলোচনা নেই। বরং  শাসক লীগ যা করেছে তাতে বিএনপি ৩০৫টি চেয়ারম্যানই বা কী করে পেল, তা নিয়েও সম্প্রতি এক টকশোয় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। আলোচনা হচ্ছে এই নির্বাচনে হানাহানি, খুনোখুনি নিয়ে। কেন এসব ঘটল তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মত হচ্ছে— ১. স্থানীয় সরকার নির্বাচনের  অতীত ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে দলীয় ভিত্তিতে দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন করা। নির্বাচন শেষে এটা প্রমাণ হয়েছে যে, সরকার স্বীয় স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২. সরকারি দলের প্রার্থীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর লিখিত সুপারিশ (প্রত্যয়নপত্র)। এটা ছিল উপজেলা, জেলা লেভেলের নেতার কাজ অথবা কেন্দ্রের দফতর/সহ-দফতর সম্পাদকের কাজ। গোলযোগ হয়েছে মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে (প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ পেলেই তো চেয়ারম্যান), মনোনয়ন না পেলে মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে। ৩. প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরকারি প্রার্থীর পক্ষাবলম্বন। ৪. সরকারি দলের বর্তমান এমপি ও ভবিষ্যৎ সংসদ সদস্য পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী ও প্রভাবশালী নেতাদের প্রভাববলয় রক্ষা বা সৃষ্টির চেষ্টা। ৫. নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীরাও শাসক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা কিংবা স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান বা ঢাকাবাসী অন্য কোনো প্রভাবশালী নেতার পৃষ্ঠপোষকতাধন্য হওয়ায় প্রশাসন, ইসি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। মূলত সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং অনৈতিক, অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কারণেই এমন সহিংসতা ঘটেছে ইউপি নির্বাচনে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসে পেট্রলবোমা, পুলিশের ক্রসফায়ার, সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যার চেয়ে এবার ইউপি নির্বাচনে নিহতের সংখ্যা তো কম নয়। ১৩৭ জনের প্রাণহানি আর প্রায় ১০ হাজার লোককে জখম করার দায় তো বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপানো যাবে না। নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, চাকরির মায়ায় নির্লিপ্ততা, সর্বোপরি সরকারি দলের দখলদারিত্বের মানসিকতাকেই এর জন্য দায়ী করতে চান পর্যবেক্ষকরা। তিন মাসের আন্দোলনে মানুষ মারার দায়ে সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিএনপি-জামায়াত অভিযুক্ত এবং অনেকে কারারুদ্ধ, বেগম জিয়াসহ অনেকে মামলায় ফাঁসা কিন্তু ইউপি নির্বাচনে তো হামলাকারী-খুনিরা সরকারি দলের লোক হিসেবে চিহ্নিত। ১৩৭ খুনের অপরাধে এ পর্যন্ত কতজন গ্রেফতার হয়েছে? কী করছে সরকার?

গত রবিবারের (৫ জুন) লেখায় একটি বড় অংশ ছাড় গেছে। পাঠকদের অসুবিধা হয়েছে লেখা বুঝতে। অনেকে অভিযোগও করেছেন। এ ত্রুটি অনিচ্ছাকৃত। চলতি লেখায় অপ্রকাশিত অংশের বক্তব্য তুলে আনার চেষ্টা করেছি। অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য দুঃখিত।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর