সোমবার, ১৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভূরাজনীতিতে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

ভূরাজনীতিতে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে

মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইরানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় সফর শেষ করেছেন। এ সফরের সময় ভারত ও ইরানের মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে দুটি চুক্তি ভারতের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ অর্জনে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। প্রথম চুক্তিটি হলো— ইরানের দক্ষিণ প্রান্তে, পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ গোয়াদার সমুদ্র বন্দরের নিকটবর্তী,  ওমান সাগরের উপকূলে এবং পার্সিয়ান গালফের প্রবেশ মুখে চবাহার সমুদ্র বন্দর সম্পূর্ণ ভারতের সহযোগিতায় নির্মিত হবে। মুম্বাই থেকে চবাহারের দূরত্ব হবে বড়জোর সাড়ে সাত-আটশ নটিক্যাল মাইল। আর গুজরাটের রাজকোট থেকে আরও প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল কম হবে। গালফ রাষ্ট্রগুলো অর্থাৎ ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে যুক্ত সব বাণিজ্য বহর ও সামরিক নৌযানের চলাচল হবে চবাহারের নাকের ডগার কাছ দিয়ে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে চীনের সহযোগিতায় নির্মিত গোয়াদার বন্দরের দূরত্ব চবাহার থেকে মাত্র ১৬৫ কিলোমিটার। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে গোয়াদারের নাবিকদের হাঁকডাকের শব্দও পৌঁছে যাবে চবাহারে। নরেন্দ্র মোদির ইরান সফরের সময় আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিও ইরানে আসেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির উপস্থিতিতে ত্রিদেশীয় ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে ভারত তার সব পণ্য চবাহার বন্দর হয়ে সড়কপথে ইরানের ভিতর দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠাতে পারবে। একইভাবে আফগানিস্তানও ইরানের ভিতর দিয়ে চবাহার বন্দরের মাধ্যমে ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে। এ বন্দর থেকে ইরান ত্রিমুখী সুবিধা পাবে। আফগানিস্তান ও ভারতের কাছ থেকে বন্দরের মাশুল পাবে, দুই দেশ সড়ক ব্যবহার করবে তার জন্য মাশুল পাবে এবং ইরান নিজের পণ্যও সহজে ও স্বল্প সময়ে ভারতে রপ্তানি করতে পারবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধার চেয়েও ভারতের জন্য এর স্ট্র্যাটেজিক মূল্য হবে অনেক অনেক বেশি। চবাহার বন্দরের মাধ্যমে ভারত স্বল্প সময়ে ও অল্প খরচে ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে পারবে। পাকিস্তানের বাধা উপেক্ষা করে, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এড়িয়ে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান পূর্বের থেকে আরও শক্তিশালী হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর তিন দেশের তিন নেতা মোদি, রুহানি ও আশরাফ ঘানি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ক্যামেরার সামনে হাস্যোজ্জ্বল পোজ দেন। এই চুক্তির ফলে আফগানিস্তানের হেরাত, কান্দাহার, কাবুল ও মাজার-ই-শরিফের মতো বড় শহরগুলো ভারতের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। শুধু আফগানিস্তান নয়, উল্লিখিত সংযোগ সড়ক সম্প্রসারিত করে ভারত স্থলপথে সরাসরি সংযোজিত হওয়ার সুযোগ পাবে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তানের সঙ্গে, যা চূড়ান্তভাবে ভারতকে যুক্ত করবে রাশিয়ার সঙ্গে। এটা হলে চীন ও পাকিস্তানের বিপরীতে ভারত বিশাল স্ট্র্যাটেজিক আপারহ্যান্ড পাবে ও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। এর ফলে প্রয়োজন হলে চীনের প্রভাবিত অঞ্চল পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর এড়িয়ে ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য করতে পারবে। সে বিবেচনায় আঞ্চলিক সংযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র হবে ইরানের চবাহার বন্দর। আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে ভারত যত বেশি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে সেটি তত বেশি পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করবে। মোদি ও আশরাফ ঘানির ইচ্ছা ছিল স্থল ও সমুদ্র, দুই পথের মিশ্রণ ও ট্র্যানশিপমেন্টের ঝামেলা এড়িয়ে পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে সড়কপথে দুই দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। কিন্তু পাকিস্তান তাতে না বলার পর বিকল্প হিসেবে তারা সম্মিলিতভাবে বেছে নিলেন ইরানের চবাহার বন্দর। সমুদ্র পথে সংযোজিত হওয়ার জন্য স্থলবেষ্টিত দেশ আফগানিস্তানের পক্ষে পাকিস্তানের ওপর যে একচ্ছত্র নির্ভরশীলতা ছিল তা অনেকাংশে কমে যাবে।

এটা আফগানিস্তানের জন্য বিরাট লিফ ফরোয়ার্ড। পাকিস্তান সংযোগ সড়ক প্রদানে অস্বীকার করায় গত বছর আশরাফ ঘানি বলেছিলেন, এর ফলে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগের জন্য পাকিস্তানকে আফগানিস্তানের সড়ক ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সুতরাং উপমহাদেশে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে পাকিস্তানের ভারত বিদ্বেষ এবং ভারত-বাংলাদেশ উভয়ের বিরুদ্ধে একাত্তরের প্রতিশোধ গ্রহণের নীতির কারণে পাকিস্তান ক্রমশই একটা বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। নেপালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সার্ক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আন্তঃসড়ক ও রেল সংযোগের যে প্রস্তাব উঠেছিল তা কেবল পাকিস্তানের বিরোধিতার কারণে কার্যকর হতে পারে না। পাকিস্তানের বিরোধিতার মূল কারণ ছিল ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের স্থল সংযোগ যে কোনোভাবে ঠেকিয়ে রাখা। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে হয় না, এ সত্যটি পাকিস্তান বরাবর অস্বীকার করে আসছে। ইরান সফরের আগে মোদি সৌদি আরব সফর করেন। মোদি ও বাদশা সালমানের পারস্পরিক করমর্দন ও হৃদ্যতাপূর্ণ ছবি মিডিয়ায় ছাপা হয় এবং দুই দেশের মধ্যে অর্ধডজনের মতো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সৌদি আরব ও ইরান, দুই সাপে নেউলে সম্পর্কের রাষ্ট্রের সঙ্গে মোদি সমানতালে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছেন, যা পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের বিষয়। ইরান থেকে ফিরে মোদি স্বতন্ত্রভাবে আবার আফগানিস্তান সফরে যান এবং সেখান থেকে সরাসরি মোদি যান কাতারে। আগামীতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যদি যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারের নিরাপত্তাকল্পে পশ্চাত্ভূমির সুবিধার জন্য আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশসমূহের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা পাকিস্তানের জন্য ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আরও কতকগুলো আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক সংঘ থেকে পাকিস্তান বাদ পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে BCIM-EC, অর্থাৎ বাংলাদেশ, চায়না, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর। সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক ফোরাম BIMSTEC, অর্থাৎ Bay of Bengal Initiative for Multi Sectoral Technical and Economic Co-operation, এখানেও পাকিস্তান নেই। এই সংস্থার সদস্য দেশ হলো— বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। কাঠমান্ডুতে গত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তান সার্ক কানেকটিভিটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল স্বাক্ষর করে কানেকটিভিটি চুক্তি, যার নাম BBIN, অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া ও নেপাল। BBIN- এর কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ভারত হলো চির শত্রু, এই স্ট্র্যাটেজি থেকে পাকিস্তান এ পর্যন্ত বের হতে পারেনি। আর সম্প্রতি  যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে পাকিস্তান চরম অসৌজন্যমূলক ও সীমাহীন ঔদ্ধত্য আচরণ করছে। বাংলাদেশের সব মানুষ কঠোর ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। পাকিস্তানের দুই রক্ষাকবচ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন আর আগের মতো নেই। এক ঘরে বসবাস আর সম্ভব নয়, তবে তালাকও সহজে দেওয়া যাবে না, এটাই হলো এখন পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্কের মর্যাদা বলতে এখন আর কিছু নেই। সামান্য জিজ্ঞাসা না করে প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গি দমনের নামে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ড্রোন আক্রমণ চালাচ্ছে। তাতে জঙ্গির সঙ্গে মরছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। পাকিস্তানের যেন কিছুই বলার নেই। মাতা-পিতাহীন এতিম অবলা গৃহবধূর মতো সব নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে ধরে রাখার উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, পরমাণু অস্ত্র যাতে চরম উগ্র জঙ্গিদের হাতে না পড়ে তার পাহারা দেওয়া। আর দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের ওপর চীনের একচ্ছত্র প্রভাব ও আধিপত্য রোধ করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ার অন্তত দুটি প্রকাশ্য বড় প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। এখন থেকে অস্ত্র ক্রয় ও সামরিক প্রযুক্তি বিনিময়ে ভারতকে ন্যাটো সদস্য দেশের মতো মর্যাদা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন ও মর্যাদাবান নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ারস গ্রুপে ভারতের সদস্য পদ লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের কাছে পূর্ব-প্রতিশ্রুত ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহের চালান আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বন্ধ করে দিয়েছে। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। ৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের উভয় পরিষদের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সম্মান পেয়েছেন মোদি। অন্তত আটবার স্ট্যান্ডিং ওভেশন পান এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের তুমুল হর্ষধ্বনির কারণে মোদির বক্তব্য বাধাগ্রস্ত হয়। আঞ্চলিক ভূরাজনীতির সমীকরণে পাকিস্তানের একমাত্র ভরসা এখন চীন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চীন পাকিস্তানকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করবে।  তবে চেষ্টার মাথায় সীমানা বেঁধে দেবে— BIMSTEC, BCIM-EC এবং BRICS- এর মতো সংঘগুলো। রাশিয়াও এক্ষেত্রে ভারতের জন্য ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং পাকিস্তান যদি উগ্র ধর্মান্ধ সংকীর্ণ দর্শন থেকে বের হতে না পারে এবং অভ্যন্তরীণভাবে মোল্লা ও মিলিটারির কবল থেকে মুক্ত হতে না পারে তাহলে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির বাস্তবতায় পাকিস্তান ক্রমশ আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

     লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর