সোমবার, ১৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইফতারি যদি ফল দিয়ে হয়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ইফতারি যদি ফল দিয়ে হয়

বিকাল গড়ালেই রোজাদার অনুভব করেন এক আনন্দ ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণ তার আত্মায় তৃপ্তি আনে। জিবে স্বাদ লাগে। এভাবেই রোজাদারের ঘরে ঘরে শুরু হয় ইফতারের আয়োজন।  সাধ্যের মধ্যে সেরা ইফতার সবার চাওয়া থাকে। মৌসুমি ফল ইফতারের প্রধান চাহিদা। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে ফলের ভূমিকা অনন্য। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকায় ধনী-গরিব সবার ইফতারেই কমবেশি ফলের সমাহার লক্ষণীয়। রোজাদারদের ইফতার দেখলে মনে হয়, জান্নাতি মেহমানরা জান্নাতি ফল দিয়ে ইফতার করছেন।

আমাদের এই দেশ ফল ফসলের দেশ। এ দেশের ফলফুল দেখে জাতীয় কবি লিখেছেন— ‘এই সুন্দর ফুল এই সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/খোদা তোমার মেহেরবানি।’ খোদার অপার করুণায় আমাদের মাটিকে ফল ফসলের জন্য উপযুক্ত করে দিয়েছেন। এ দেশের মাটিকে কবি সোনার চেয়েও খাঁটি বলেছেন। মৌসুমি ফলের আশ্চর্য ক্ষমতা হলো, যে মৌসুমে যে রোগের সম্ভাবনা রয়েছে, ওই মৌসুমের ফলগুলো তার প্রতিষেধক। সহজ কথায় কেউ যদি মৌসুমি ফল নিয়মিত খায় তবে তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। রোজায় সুস্থ থাকার জন্য এখনকার ফলগুলো নিয়মিত রাখা চাই। ইফতার ও সাহরিতে ফলের চাহিদা বিশ্বজুড়েই রয়েছে। খোদার অপার দান এ ফলের জন্য শোকরিয়া আদায় করা চাই। মুখে আলহামদুলিল্লাহ বলার পাশাপাশি এক কেজি ফল ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। একটি আম দশটি লিচু রাস্তায় পড়ে থাকা বনি আদমের হাতে তুলে দিতে হবে। যদি এমনটি করতে না পারেন তবে আমি সারা জীবন কোরআনের আদ্যোপান্ত জপতে থাকলেও প্রভু খুশি হবেন না। প্রভু তখনই খুশি হবেন যখন তাঁর দেওয়া নেয়ামত তাঁর বান্দার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য ব্যয় করা হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য সাহায্য করবে, আল্লাহ ততক্ষণ তাকে সাহায্য করতে থাকবেন।’ (মুসলিম।) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় একুশ শতকের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশেষজ্ঞ শায়েখ উসাইমিন (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে তেমনই সাহায্য করবেন, যেমন তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করেছ।’

ফল বেহেশতি খাবার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা জান্নাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে অসংখ্যবার ফলের উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘জান্নাতে মুমিনদের ওপর বিস্তীর্ণ থাকবে বৃক্ষরাজির ছায়া, আর ফলরাজি থাকবে তাদের নাগালের মধ্যে।’ (সূরা ইনাসা/দাহর, ৭৬ : ১৪।) ‘শুভ সংবাদ দাও তাদের, যারা ইমান আনবে এবং ভালো কাজ করবে। তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যেগুলোর নিচ দিয়ে থাকবে নদ-নদী ও নহর। যখনই সেই সব জান্নাতের ফলফলারি তাদের খেতে দেওয়া হবে, তারা বলবে এসব ফল তো আমাদের আগেও খেতে দেওয়া হয়েছে। আসলে জান্নাতের ফলগুলো দেখতে হবে দুনিয়ার ফলফলারির মতোই।’ (সূরা বাকারাহ : ২৫।)

রোগ প্রতিষেধক মৌসুমি ফল একদল অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে রোগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ফল আমরা সুস্থ থাকার জন্য খেয়ে থাকি সে ফলই আমাদের মরণব্যাধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলের নামে বিষ কিনে খাচ্ছি আমরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফল সংরক্ষণ ও পাকানোর জন্য যেসব বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব ফল খেলে ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাকসহ নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগ হতে পারে। এমনও সম্ভাবনা রয়েছে ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ মারা যেতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আহাল্লাহুল বায়আ ওয়া হাররামার রিবা।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’ হালাল ব্যবসার নামে মানুষকে বিষ খাওয়ানো কোনোভাবেই জায়েজ হতে পারে না। এটা সুস্পষ্ট প্রতারণা। মানুষকে ধোঁকা দেওয়া আল্লাহকে ধোঁকা দেওয়ার নামান্তর। আল্লাহ বলেন, ‘ইউখাদিয়ু নাল্লাহা ওয়াল্লাযিনা আমানু’ অর্থাৎ ‘তারা আল্লাহ এবং বিশ্বাসীদের ধোঁকা দিচ্ছে।’ ধোঁকা ও প্রতারণা করে মানুষ ঠকায় যারা তারা রসুল (সা.)-এর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’

আমাদের দেশের উৎপাদিত ফল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। ফলের ভিতর এভাবে বিষ প্রয়োগ করতে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। ব্যবসায়ীদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, ‘যে বিষ মাখানো ফল সাধারণ মানুষকে খাওয়াচ্ছেন সে ফল কি আপনার সন্তানকে খাওয়াতে পারবেন? আপনি নিজে খেতে পারবেন? যদি না পারেন তাহলে কেন তা আমাদের আর আমাদের সন্তানদের খাওয়াচ্ছেন? রসুল (সা.) বলছেন, ‘মুমিন তো সেই যে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা তার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করবে। এ হাদিসের আলোকে নিজেকে প্রশ্ন করুন আমি কি মুমিন?’

হে আল্লাহ, এই রহমতের মাসে আমাদের আপনি প্রেমিক বান্দা বানান। প্রেমিক তো সেই হতে পারে যে মানুষকে ভালোবাসতে শেখে। মানুষকে ভালোবাসলে তবেই না আল্লাহকে ভালোবাসা যায় এবং  পাওয়া যায়।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর