শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

সব মায়ের সন্তানরা একবার ভাবুন

নাসরীন নঈম

সব মায়ের সন্তানরা একবার ভাবুন

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে কিছু কিছু দিবস বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়েছিল। ওই দিবসগুলো আমাদের জাতি সত্তাকে জাগ্রত, প্রভাবিত করেছে এবং এখনো করছে। যেমন বিজয় দিবস। স্বাধীনতা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভাষা দিবস— এ দিনগুলো আমাদের অস্তিত্বের বাহক। আমাদের প্রাণের স্পন্দন। এই দিবসগুলো পালিত হতে হতে একদিন দখিনা বাতাসের মতো হুড়মুড় করে সুগন্ধি ছড়িয়ে এলো ভালোবাসা দিবস। ‘ভালোবাসি’ ‘ভালোবাসি’ শব্দটি যেন এত দিন লজ্জায় লুকোনো ছিল হৃদয়দানিতে। চুপি চুপি ছাদে উঠে, চিঠি লিখে কিংবা একলাঘরে ফিসফিস করে উচ্চারিত হতো এক সময়। আজ হঠাৎ ঘটা করে এই দিবসটি এসে সমাজ ও সংস্কৃতিতে রঙের প্রলেপ লাগিয়ে দিল। ভালোবাসাহীন সমাজটায় মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার বাঁধন শক্ত করে বেঁধে দিল। ছেলে-বুড়ো, যুবক-যুবতী সবাই কেমন খোলা হাওয়ার মতো ভালোবাসতে উদার হলো। সংকোচ কেটে গেল। এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়— বরং হাত ধরে রাজপথে, শাহবাগ চত্বরে, পার্কে, রেস্তোরাঁয় গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে শব্দ করে ‘ভালোবাসি’ ‘তোমায় ভালোবাসি’ বলে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। কেউ কিছু মনে করে না। বরং বিষয়টি দেখে একটি শিক্ষা নেওয়া যায় যে— ভালোবাসা একটি পবিত্র উপলব্ধি। একে অবহেলা করা যাবে না বরং প্রকাশ করতে হবে। এটি খুবই জরুরি আমাদের জীবনে।

তারপর এলো নারী দিবস। সাজ সাজ রব পড়ে গেল। সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে নারীকে মর্যাদা দেওয়ার অঙ্গীকার বাণী ধ্বনিত হলো চারদিকে। সমাজপতিরা নগণ্য নারীর সঙ্গে এক মঞ্চে পাশাপাশি বসে নারীর যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশংসায় মুখে ফেনা তুলে ঘরে গিয়ে নারীকে তুলোর মতো ধুনলেন দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন— শালীর বেটি তুমি ব্যাটা হওয়ার চাও... যতসব। তার মানে নারী দিবসের আয়োজন ওই এক দিনেই শেষ। এরপর আবার এলো কন্যা দিবস। ওই একই অবস্থা কন্যা বড় হয়েই তো নারী হবে। কন্যা শিশুকে গালটিপে আদর করে ঘরে ফিরে পোয়াতি বউকে চোখ রাঙাবে— এবার যদি মাইয়্য বিয়াইস তো সোজা বাপের বাড়ি পাঠামু মনে রাখিস। তার মানে ওই এক দিনই কন্যা দিবস। বাবা দিবসও আসে মায়ের পিছু পিছু। সন্তানের জীবনে বাবার অবদান গুরুত্বপূর্ণ এবং অনস্বীকার্য। এখনো অনেক বাবা আছেন যারা সন্তানের কথা ভেবে মা-হীন সংসারে নিজেকে উৎসর্গ করেন। সেসব সন্তানই বাবা দিবসে বাবার জন্য ব্যাকুল হয়।

আমার বক্তব্য হলো ‘মা দিবস’ নিয়ে। গত ৮ মে গেল ‘মা দিবস’। সব দিবস মাত্র একটি দিন পালিত হয়— কিন্তু মা দিবস কেন মাত্র এক দিনের জন্য হবে? আমার মতে প্রতিদিনই ‘মা দিবস’ পালিত হওয়া উচিত। সন্তান ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মার সঙ্গে দেখা করে যাওয়া উচিত। মাকে মনে করার শুরুটা এভাবেই হতে পারে।

জোছনা প্লাবিত আকাশের মতো মায়ের মুখের হাসিটা সন্তানের কর্মময় জীবনকে আলোকিত করবে। পৃথিবীতে সন্তান আসে মায়ের কল্যাণে তাই সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান পৃথিবীর সব কিছুরই ঊর্ধ্বে। প্রবাদ আছে— কু-সন্তান যদিও হয়, কু-মাতা কখনো নয়। সন্তান যেমনই হয়-কানা, খোঁড়া, ফর্সা, কালো, হ্যাবলা, মোটা মায়ের কাছে সবাই আদরের নাড়ি ছেঁড়া ধন। কোনো সন্তান যদি মনে করে আমার মা আমার চেয়ে আমার বড় ভাইকে বেশি ভালোবাসেন। কারণ ভাই প্রকৌশলী। আমি তো সামান্য চাকরিজীবী। এটা ভুল ধারণা। এতে বরং মায়ের মনে কষ্ট দেওয়া হয়। মার কাছে সব সন্তানই সমান প্রিয়। মার শাড়ির আঁচল সন্তানের কাছে পরম আশ্রয়। নিরাপদ আবাস। শৈশবে মা সন্তানকে রক্ষা করেন। কৈশোরে এবং যৌবনে এসে সন্তানের উচিত মাকে রক্ষা করা। সামাজিক বিপদ থেকে হোক। সংসারের কূট-কাচালী থেকে হোক কিংবা বাবার অত্যাচার থেকে হোক। সন্তান যদি মনে করে মায়ের প্রতি বাবার অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করা যাবে না— তিনি তো জন্মদাতা। ঠিক আছে তোমাকে ন’মাসব্যাপী জঠরে ধারণ করেছে কে? জন্মের সময় অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেছে কে? তোমার মা। আর এই কারণেই সম্ভবত আল্লাহ বিধান দিয়েছেন, মায়ের পদতলেই তোমার বেহেস্ত। বাবার নয়। স্বামীরও নয়। তাহলে মা-ই হলেন নমস্য। হাদিসে আছে মায়ের সেবা জিহাদের চেয়েও উত্তম। একজন সাহাবি রসুলুল্লাহ (রা.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রসুল আমি হজে যেতে চাই— কিন্তু আমার আর্থিক সংগতি নেই। রসুল (সা.) বললেন তোমার ঘরে মা আছেন?

—জি আছেন

—তাহলে তুমি মায়ের সেবা কর। তোমার হজ হয়ে যাবে। এবার বুঝতে হবে মায়ের মর্যাদা কোথায়। যে কোনো কারণেই হোক বাবা কিন্তু সন্তানকে ত্যাগ করে। ফেলে রেখে যায়। মা তা পারে না। মা তো পাখির মতো খড়কুটো ঠোঁটে নিয়ে সন্তানের মুখে তুলে দেয়।

যোগ্য সন্তান তৈরির জন্য একটি প্রতিষ্ঠান সমাজের কিছু মাকে ‘রত্নগর্ভা’ বলে পুরস্কৃত করে প্রতিবছর। এটি একটি আন্তরিক এবং পবিত্র উদ্যোগ মায়ের প্রতি সম্মান দেখানোর। এতে সন্তানরাও নতুন করে মাকে উপলব্ধি করতে শেখে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো গত ৮ মে ‘মা’ দিবসে একজন রত্নগর্ভা তার সন্তানদের কাছ থেকে সারা দিন অপেক্ষা করেও একটিবার শোনেননি— মা তুমি কেমন আছ? ষাটোর্ধ্ব এই মায়ের চোখ বেয়ে মাছের চোখের মতো বড় বড় অশ্রু ফোঁটা বিছানার চাদর ভিজিয়ে ছিল। বউয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বৃদ্ধাবাসে মাকে একটিবারও দেখতে যায়নি ছেলে। এই ছেলে নাকি রত্ন। এমন রত্নের প্রয়োজন আছে কি কোনো মায়ের? মায়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, অনুগত্য না-ই থাকতে পারে। সন্তানের কেন থাকবে না? নিজের মা-কে ঘরে রেখে অন্যের মাকে নিয়ে তুমি বেড়াতে যাবে— ন্যানদোসে খাবে। মায়ের জন্য একটি প্যাকেটে সামান্য খাবারও আনবে না— এতে কি মার মনে কষ্ট দেওয়া হয় না?

সোভিয়েট ইউনিয়নের লেখক রসুল গামজাতভ তার আমার জন্মভূমি ‘দাগেস্তান’ বইতে ২৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন— ‘শাশুড়ির বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। বিয়ে করলে শাশুড়ি থাকবে। তা বলে তাকে মায়ের আসনে বসাতে নেই। শাশুড়ি কখনো মা হতে পারে না। মা যদি বেঁচে না থাকেন তো তার আসনটুকু শূন্যই থাকুক— সেখানে শাশুড়িকে আনা ঠিক নয়।’ কথাটি আমাকে নিয়তই ভাবায়। সন্তানের কোনো সাফল্যের খবর যদি স্ত্রী বা শাশুড়ির কাছে শুনতে হয় তাহলে সেই মায়ের মন কতটা ছোট হয়ে যায় একবার ভাবুন তো। ঈদের দিনে নিজের জন্মদিনে সন্তান যদি মাকে সালাম না করে শ্বশুরবাড়িতে আগে ছুটে যায় ‘সোনার টুকরা জামাই হওয়ার জন্য তো মায়ের কষ্ট কতটা গভীরে যায়। মায়ের মুখ থেকে যদি ‘আহ্’ শব্দটি উচ্চারিত হয় তো সে সন্তানের মঙ্গল কখনো হতে পারে না।

শুনেছি বৃদ্ধাবাসে মায়েদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। সন্তানরা মায়েদের সংসারে পুরনো আসবাবপত্র ভাবছে— তাই তাদের বৃদ্ধাবাসে রেখে আসছে। কারণ তারা নাকি সংসারে কারও সঙ্গে এডজাস্ট করতে পারছে না। শৈশবে তো ঠিকই বনিবনা হতো।

একজন শীর্ষস্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মা আমাকে বলেছেন— একবিঘা জমি খোঁজেন, আমি আমার সব টাকা পয়সা এবং গহনা বিক্রি করে মনের মতো একটি বৃদ্ধাবাস তৈরি করে অশ্রুসিক্ত মায়েদের নিয়ে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেব। এক কানাকড়িও কুলাঙ্গারদের দেব না।

মহিলার কথাগুলো কি গর্বের নাকি কষ্টের আমি ঠিক ভেবে পাচ্ছি না। মায়েদের চোখের জল মোছাবার জন্য আর কতগুলো মা দিবসের প্রয়োজন আমি জানি না। শুধু মনে হয় যদি ভালোবাসা দিবসটা সার্থক হয় তো মা দিবসটা কেন হচ্ছে না। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা দিনে দিনে নিভে যাচ্ছে নাকি? সব মায়েদের সন্তানরা একবার ভাবুন তো!

লেখক : কবি ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর