শিরোনাম
বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

প্রসবঘরটি কেমন হবে

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

প্রসব শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত হলেও মনে হয় কথাটি অত্যন্তই গোপনীয়। সহজ কথাটি সহজ করে কেউ বলতে চায় না অথবা এর প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করতে চায় না। বাংলাদেশে এখনো ৬২ শতাংশ প্রসব হয়ে থাকে ঘরে। ৩৮ শতাংশ হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে (সরকারি-বেসরকারি একেবারে তৃণমূল থেকে সবচেয়ে নামিদামি প্রতিষ্ঠানে)। যেখানেই হোক না কেন, আমরা কখনই কেমন জায়গায় একজন মা প্রসব করবেন সেটির ওপর কখনই তেমন দৃষ্টি দেই না অথবা এ ব্যাপারে চিন্তা করার মতো বিষয় মনে করি না। সে কারণেই ঘরে যখন প্রসব হয়, সেই আদিকাল থেকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অথবা গোপনীয় এক অন্ধকার জায়গায় সেটি ঠিক করা হয়। ব্যাপারটা পরিবারের কাছে গোপনীয় না অচ্ছুত, বোঝা দরকার। একটি পরিবারে একজন মা যখন সন্তানসম্ভবা হবেন, সেটি প্রথম থেকেই ভাবতে হবে কাঙ্ক্ষিত একজন আসছেন, কখনো যদি অনাকাঙ্ক্ষিত হয় তার জন্য কিন্তু যে আসবে সে দায়ী নয়, কাজেই তার আগমনে তাকে অবশ্যই সঠিকভাবে নিতে হবে।

আগমনীকে গ্রহণ করা কখনো গোপনীয় হতে পারে না, তবে সেটি হবে স্বাভাবিক পর্দার অন্তরালে। জায়গাটি গরুর খোঁয়ার বা ও ধরনের কোনো জায়গায় কেন? মা এবং শিশুর সবরকম নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং পরিষ্কার জায়গাটি প্রসবের জায়গা করতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারপ্রধান এবং যিনি প্রসব করবেন তিনি মা, শাশুড়ি, অভিজ্ঞ ধাত্রী অথবা বর্তমানে সারা দেশে (সিএসবিএ) কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্ট আছেন তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই জায়গাটি ঠিক করে রাখা দরকার এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রসবের আগেই আলোচনা করে রাখা উচিত। পরিবারের সবারই উচিত এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করা। যেমন প্রথম মাস থেকেই পরিবারের ছোট-বড় সবারই উচিত তার খাবার, বিশ্রাম এবং স্বাভাবিক সব প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখা। তাকে দিনে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম বা ঘুমাতে দিতে হবে। সবাই যা খাবেন তারচেয়ে একটু বেশি খেতে দিতে হবে; যেমন : সবাই এক টুকরো করে মাছ খাচ্ছেন, সেখানে তাকে দুই টুকরো মাছ খেতে দেবেন। ভারী কাজ করতে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। নিজেদের সবার রক্তের গ্রুপ জানবেন এবং প্রসূতি মা’র রক্তের রিপোর্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে রাখবেন। 

যদি বাড়ির বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানে করেন সেখানে কীভাবে যাবে সে জায়গাটি আগে থেকেই ঠিক রাখতে হবে। রাত-বিরাতে তাকে কীভাবে নেওয়া হবে সে ব্যাপারটি পারিবারিকভাবেই আগে থেকে ঠিক রাখবেন। বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা করে মা ও শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটি ঠিক করতে হবে এবং জায়গাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে আলো-বাতাস পূর্ণ থাকবে। তার নিজের শোবার ঘরেও একটি নিচু খাটে তার প্রসবের আয়োজন করা যেতে পারে অথবা যেখানে খাট নেই পরিষ্কার মাদুর পেতে তার মধ্যেই করানো যেতে পারে, তবে সব সময়ই যিনি করাবেন তাকে খেয়াল রাখতে হবে। তার কাছে ‘সেফটি কিট’ আছে কিনা অথবা প্রয়োজনীয় যেসব জিনিস লাগবে সেগুলো আগে থেকেই সেই ঘরে ঠিক করে রাখতে হবে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ যেন না হয় সে জন্য মুখে খাবার ওষুধ (মিসোপ্রোস্টল) অথবা পায়ু রাস্তায় দেওয়ার ওষুধটি প্রসবকালীন সময়ে মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখতে হবে।

আমরা সবাই চাই প্রসব কাজটি বাড়ির বাইরে হাসপাতাল অথবা ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শহর পর্যন্ত যেসব জায়গা আছে সেখানে হোক। কিন্তু এই মুহূর্তেই সেটি সম্ভব হচ্ছে না, কাজেই বাড়ির ব্যাপারটির কথাই আগে বললাম। এবারে আসি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। ইউনিয়ন, থানা, জেলা এবং হাসপাতালসমূহে লেবার রুম বলে যে জায়গাটি আছে বর্তমানে তার দিকে তাকাই— সর্বক্ষেত্রে এক রকম হবে না। কারণ কোনো কোনো জায়গায় বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার ডেলিভারি হচ্ছে— কোনো জায়গায় হয়তো অনেক কম। মানবসম্পদও সব জায়গায় এক রকম নেই। কিন্তু সব জায়গায় একটি নির্দিষ্ট ঘর বা কক্ষ অবশ্যই থাকবে, সেটি হবে আলো-বাতাস পূর্ণ লেবার রুম বা প্রসব কক্ষ হিসেবে সেটি নির্দিষ্ট থাকবে। এখনো সব জায়গায় আছে কিন্তু সেটির মান খুবই নিকৃষ্ট। প্রসূতি মা’দের প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারিতে উৎসাহ দিতে হলে এটি হবে প্রথম শর্ত— যে ‘লেবার রুমটি একটি নিরাপদ জায়গা’ সেটি ‘প্রসূতিবান্ধব’ জায়গা হিসেবে বিবেচিত হবে। ঘরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ যাই হোক না কেন প্রতিটি লেবার রুমে ন্যূনতম দুটি টেবিল থাকতে হবে। উক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং বিভাগীয় প্রধানরা এ ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করবেন। কমপক্ষে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার, একটি সাকার মেশিন, বাচ্চার হৃদস্পন্দন শোনবার জন্য ডপলার (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেশিন থাকতে হবে। মার শারীরিক অবস্থার জন্য একটি পালস অক্সি মিটারও রাখা প্রয়াজন। রুম সংলগ্ন বাথরুম-স্নানাগার থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। একটি আলমারিতে এক্লামশিয়া কিট, পিপিএইচ কিট, অক্সিটোসিন, জীবন রক্ষাকারী দ্রুত দেওয়ার জন্য কিছু ড্রাগস (Hydocortison/ Saline/ I/V Set/ Blood Set / Ambubag (বাচ্চা এবং মা দুজনের জন্যই) রাখতে হবে। ব্যথা প্রশমনের জন্য ইনজেকশন অথবা Entonox রাখা প্রয়োজন। সব সময়ই কমপক্ষে দুটি ডেলিভারি কিট হাতের কাছে রাখতে হবে। বর্তমানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই যেসব নার্স নিয়োগ দেওয়া হয় তারা কেউই সেখানে স্থায়ী থাকেন না তাকে কখনো চক্ষু বিভাগ, কখনো মেডিসিন বিভাগে যেতে হয়। সে জন্য আমাদের অনুরোধ বর্তমান সরকার যে মিডওয়াইফারি নিয়োগ দিচ্ছেন নার্সিং কাউন্সিল দয়া করে তাদের যদি লেবার রুম ইনচার্জ করে দেন, তাকে প্রসব কক্ষের রক্ষাবেক্ষণ স্থায়ীভাবে দেওয়া যাবে। আমাদের ভিশন যদি মা ও শিশু তবে নিয়োগ পদ্ধতির মধ্যে অবশ্যই লেবার রুম ইনচার্জ হিসেবে তাদের নিয়োগ পদ্ধতি তৈরি করা অবশ্যই প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে সরকার, নার্সিং পরিচালক, মিডওয়াইফারি দফতর, নার্সিং রেজিস্টার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।  নবাগত শিশুদের দেখার জন্য সর্বক্ষেত্রে আলাদা কোনো জায়গা না থাকলে প্রসব কক্ষের একটি জায়গায় তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ), হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং প্রেসিডেন্ট, ওজিএসবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর