রবিবার, ১৯ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গিবিরোধী অভিযান কি সফল হয়েছে?

কাজী সিরাজ

জঙ্গিবিরোধী অভিযান কি সফল হয়েছে?

টার্গেট কিলিং বন্ধ এবং জঙ্গি দমনে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান শেষ হয়েছে। পুলিশের তথ্যানুযায়ী জঙ্গি সন্দেহে ১৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হলেও মোট গ্রেফতারের সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এলডিপির ইফতার মাহফিলে বক্তৃতায় তিনি এ অভিযোগ করেন। মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যেও গ্রেফতারের সংখ্যা প্রায় এমনই বলা হয়েছে। জঙ্গি ধরতে গিয়ে এই গণগ্রেফতার নিয়ে দারুণ সমালোচনার মুখে পড়েছে পুলিশ। গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। বলা হয়েছে নির্দোষ, নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে। এ সুযোগে সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দলন-দমনের সুযোগ নিয়েছে বলেও জোরালো অভিযোগ এসেছে। বেগম খালেদা জিয়া সংখ্যা উল্লেখ করে বলেছেন, ১৬ জুন পর্যন্ত বিএনপির গ্রেফতারকৃতের সংখ্যাই ২ হাজার ৭০০ জন। সংখ্যা নির্ণয় করে যখন তিনি বলেছেন, ধরে নেওয়া যায় তিনি তথ্যভিত্তিক অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। জঙ্গি ধরতে গিয়ে বিএনপি ধরা হবে কেন? সন্দেহভাজন ১৯৪ জঙ্গি ছাড়া বিএনপির বাইরেও যে আরও প্রায় ১০ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে তারাই বা কারা? বলা হচ্ছে নাশকতার মামলা, পরোয়ানাভুক্ত আসামিদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে এ অভিযানে। সরকারি দলের কোনো কোনো ব্যক্তি এবং তাদের কিছু ‘দলদাস’ গণগ্রেফতারের তীব্র সমালোচনার জবাবে এখন ‘জ্ঞান’ বিতরণ করতে চাচ্ছেন যে, এ ধরনের অভিযানে নাকি পুরনো মামলা, পরোয়ানাভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করার নিয়ম আছে। আইনশাস্ত্রের কোন ‘কিতাবে’ এটা বলা আছে  সে বিষয়ে কিন্তু ‘জ্ঞানী’ সরকারপন্থিরা কিছু বলছেন না। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তারা আদতে যে সরকারের ক্ষতি করছেন তা বোধহয় অনুধাবন করছেন না। দালালি করতে গিয়ে তারা এ সাক্ষ্যই দিয়ে দিচ্ছেন যে, ভুলবশত গণগ্রেফতার হয়নি। এটা পরিকল্পিত গ্রেফতার অভিযান, এর উদ্দেশ্য যে একই সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধবাদীদেরও শায়েস্তা করা তা পরিষ্কার হয়ে যায়। নাশকতার মামলা বলুন আর পরোয়ানাভুক্ত আসামি বলুন, তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি তো পুলিশের দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্কেরই অন্তর্ভুক্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতদিন কোথায় ছিল? যদি এমন হতো যে, এই শ্রেণিভুক্ত আসামিদের ধরার জন্যই বিশেষ কোনো অভিযানের মধ্যে এদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাহলে একটা যুক্তি থাকত। কিন্তু বর্তমান পরিচালিত বিশেষ অভিযানটি সাম্প্রতিক কিছু টার্গেট কিলিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান বলেই ঘোষিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলাগুলো মূলত দায়ের করা হয়েছে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত, তাদের তিন মাসের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পেট্রলবোমাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে। অধিকাংশ মামলার আসামিই সন্দেহভাজন। কোনো কোনো মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। অনেকে জামিনে আছেন। অজ্ঞাত আসামিও আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইচ্ছা করলেই যে কোনো লোককে ওইসব মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারে। ২০১৫ সালের তিন মাস বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শতসিদ্ধ নিয়ম লঙ্ঘন করে হিংসাশ্রয়ী হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পেট্রলবোমা, অগ্নিসংযোগে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। তবে সে সময় নিহতের অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন ক্রসফায়ার, সংঘর্ষ, কথিত গাড়িচাপায় এবং অন্যান্য কারণে। পেট্রলবোমা, অগ্নিসংযোগে নিহতদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য কোনো বাহিনীর হাতেনাতে একজন রাজনৈতিক অপরাধীও ধরতে পারার তথ্য মিডিয়ায় অন্তত আসেনি। প্রায় সব আসামিই সন্দেহভাজন। যদি এমনও ধরে নেওয়া হয় যে, বিচারে আসামিরা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাহলেও এটা তো বলতে হবে যে তারা সবাই সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অপরাধ করেছেন। অর্থাৎ তা একটি ব্যর্থ রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতি। বিএনপি-জামায়াত অবশ্য পেট্রলবোমা, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ বার বার নাকচ করে বলেছে, তাদের ফাঁসানো এবং জনসম্মুখে হেয় করার জন্য সরকারই প্রশিক্ষিত লোকজন দিয়ে নিপুণভাবে এসব হামলা পরিচালনা করেছে। যেহেতু বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের ডাকে ওই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার দায় বিএনপি-জামায়াতকে নিতে হবে। শুরু থেকেই যখন বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তারা সে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিল না কেন? সরকারের দলনে-দমনে বলেন, আর কৌশলের কাছে হেরে যাওয়ায় বলেন, লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েই তো খামোশ হয়েছে ২০-দলীয় জোট। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এখনো কিন্তু তারা তাদের ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করেনি। তবু আবারও বলি, সেই আন্দোলন ছিল সরকার হটানোর ঘোষিত রাজনৈতিক আন্দোলন। টার্গেট কিলিং বা জঙ্গি হামলার সঙ্গে তা গুলিয়ে ফেললে তাকে প্রতিপক্ষ দলন-দমনের জন্য রাজনৈতিক হীনউদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা যেতেই পারে। টার্গেট কিলিং বন্ধ ও জঙ্গি দমনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বিশেষ অভিযানকে ব্যাপক গণগ্রেফতার অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৩ জুন এক সংবাদ বিশ্লেষণের চমৎকার বাস্তবানুগ শিরোনাম দিয়েছিল। শিরোনামটি ছিল ‘অভিযানের রাজনীতি, রাজনীতির অভিযান’।

 

সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘চলমান অভিযান শুধু জঙ্গি আটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করছে, তাদের নেতা-কর্মীদেরও আটক করা হচ্ছে বিভিন্ন অজুহাতে। অনেককে আটকের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। টাকা না পেয়ে পেন্ডিং মামলায় জড়িয়ে দেওয়াও হচ্ছে অনেককে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের অভিযোগও আসছে। বিএনপি বলছে, ৫৪ ধারায় তাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে পরে পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংবাদ বিশ্লেষণ যথার্থ বলেই মনে হয়। পত্রপত্রিকায় গুরুত্বসহকারে লেখালেখি চলছে যে, ঈদ সামনে রেখে রমজান মাসে এ ধরনের অভিযান পুলিশবাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যের হাতে গ্রেফতার বাণিজ্যের সুযোগ এনে দিয়েছে। ঘোষণা দিয়ে জঙ্গি ধরার সাঁড়াশি অভিযানকেও মানুষ বিস্ময়কর মনে করছে। সোর্স রেখে, গোয়েন্দাগিরি করে মাঝে মাঝে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে যেখানে নির্দিষ্ট অপরাধী বা জঙ্গি আটকে তেমন বড় কোনো সাফল্য এ পর্যন্ত দেখানো যাযনি, ঘোষণা দিয়ে অভিযান চালিয়ে সাফল্য  আশা করা যায় কীভাবে? জঙ্গিদের ‘উদ্দেশ্যে এলান’ জারি করা হলো যে, তোমাদের ধরতে আসছি, আর জঙ্গিরা গ্রেফতারবরণ করার জন্য বসে থাকবে— এটা চিন্তা করা যায়? এমন অবাস্তব চিন্তা কী করে মাথায় এলো বোঝা মুশকিল। রমজান মাস বলে অপরাধী ধরার অভিযান চালানো যাবে না এমন কথা বলছি না। বরং অপরাধীরা যদি জানে ও বোঝে যে রমজান মাসে কোনো পুলিশি অভিযান নিষিদ্ধ, তাহলে তো এক মাসে এক বছরের বা এক যুগের অপরাধ সংঘটিত করে ফেলবে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অভিযান যে কোনো সময়ই চলতে পারে। তবে অবশ্যই লক্ষ্যাভিমুখী হতে হবে এবং লক্ষ্য হবে চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের আটক করা। এজন্য সতর্কতা ও নানা কৌশল প্রয়োগ করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সতর্ক থাকতে হবে যারা দুর্বৃত্ত ধরতে যাবে তাদের, দুর্বৃত্তদের সতর্ক করে দেওয়া হাস্যকর। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশি অভিযানের লক্ষ্যই ছিল আওয়ামী লীগ ধর, বিএনপি ধর, জামায়াত ধর। সেই অভিযানের অর্থ মানুষ বুঝত, বুঝেছে। কিন্তু ডাকাত ধরার অভিযানের কথা বলে পুরনো রাজনৈতিক মামলা, পরোয়ানাভুক্ত মামলার কথা বলে যদি বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাপা বা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবির ধরা শুরু হয় তখন তাকে কেউ ডাকাতবিরোধী অভিযান বলবে না, বলবে রাজনৈতিক হুমকি মোকাবিলার অভিযান। কোনো অভিযান অবশ্যই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হতে হবে। লক্ষ্যচ্যুত হওয়া চলবে না। ১০০টার মধ্যে ৫-৭টা ভুল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ১০০টার মধ্যে ৯৫টাকে ভুল বলা যাবে না। বইপত্রের পাতা দেখিয়ে ভুল ব্যাখ্যা যতই দেওয়া হোক না কেন, মানুষ তা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলবেই। টার্গেট কিলিং বন্ধ ও জঙ্গি দমনের নামে ঘোষিত সাঁড়াশি অভিযান লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে বলে সমালোচনার পেছনে যুক্তি আছে। কোনো একটি হত্যাকাণ্ড অথবা এ ধরনের সহিংস কোনো ঘটনা ঘটলেই সরকারের উপরমহল থেকে সরাসরি বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে রাজনৈতিক আক্রমণ হানা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত আইনের দৃষ্টিতে নির্ধারিত হওয়ার আগেই অপরাধী চিহ্নিত করে দিলে প্রকৃত অপরাধী আড়ালে চলে যাওয়ার সুযোগ পায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেও একটা মাস্ট দিকনির্দেশনা হাজির হয়ে যায়। তারা কখনো ছোটে আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের পিছে, তখনো ছোটে বিএনপি-জামায়াত ও ২০-দলীয় জোটের পিছে। প্রকৃত অপরাধীরা বাজায় শখের ডুগডুগি।

দোষারোপের রাজনীতি বিস্ময়কর কোনো ঘটনা নয়। এটা আগে যেমন ছিল, এখনো আছে; ভবিষ্যতেও যে থাকবে না তা হলফ করে বলা যায় না। রাজনীতিবিদদের কারও কারও মধ্যে এ রোগ শুধু বাংলাদেশেই নয়, এটা অনেকটা বৈশ্বিক বিষয়। এর একটা সীমাও থাকে। পরস্পরের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, দায়িত্ব পালনের  অক্ষমতা-সক্ষমতা নিয়ে বাইরের দুনিয়ায়ও দোষারোপের রাজনীতিচর্চা লক্ষ্য করা যায়। একই দলের মধ্যেও এ প্রবণতা দেখা যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাইমারিতে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলের দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে এটা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দায়িত্ববান রাজনীতিবিদ নির্দিষ্ট কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য তদন্ত ও আদালতের অভিমতের আগে একজন আরেকজনের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন এমন শোনা যায়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিটা মনে হচ্ছে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। দুই পরস্পরবিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রেষারেষি, কিংবা নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে দলের সঙ্গে দলের, কিংবা একই দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধ-বিদ্রোহের কারণে হত্যা-খুনের বিষয় ভিন্ন। যেমন অতিসম্প্রতি বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দলের শ্রমিক সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে খুনের ঘটনায় বিএনপি আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করছে না, করছে বিএনপিরই এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে। একইভাবে সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রীর রিকমেন্ড করা দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে শতাধিক লোক খুন হয়েছে। কোনো গ্রুপই এসব খুনের দায় বিএনপির ওপর এখনো চাপায়নি। সব হত্যাকাণ্ডই জঘন্য অপরাধ। অপরাধীর শাস্তিও হওয়া উচিত একই রকম কঠোর। তবে দলীয় হত্যাকাণ্ডের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে বর্তমান টার্গেট কিলিং বা সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী তত্পরতা অবশ্যই ভিন্ন। এর ভয়াবহতা সমগ্র জনগণ এবং রাষ্ট্রকে স্পর্শ করে। এমন হত্যাকাণ্ড নিয়েও আমাদের দেশে দোষারোপের রাজনীতি হয়। সাম্প্রতিক সময়ের যে হত্যাকাণ্ডগুলোকে টার্গেট কিলিং বলা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে জঙ্গি তত্পরতা, আমাদের দুই নেত্রী কী অবলীলায় একজন আরেকজনকে দোষারোপ করছেন, অথচ কারও হাতেই এর যথেষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনী বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। দোষারোপের এই রাজনীতির ফাঁক গলিয়ে অনায়াসে বেরিয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রকৃত অপরাধী ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্টদের পেছনে ছোটে। সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যায়। অপরাধ নির্মূল করা তো দূরের কথা, অপরাধীরা পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। যেমন সদ্য সমাপ্ত অভিযান শুরুর দিনই অপরাধীরা পাবনায় এক আশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে হত্যা করে। শেখ হাসিনা এবং বেগম জিয়া তো পরস্পরকে দুষছেন, আসল অপরাধী ধরা পড়বে কী করে? এভাবেই যদি চলে তো সংকট সমাধান হবে কী করে?

টার্গেট কিলিং— যাকে জঙ্গি তত্পরতা বলা হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ বা দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুবিধা করতে পারছে না। এ ব্যর্থতা সরকারেরও। সারা দেশে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তথা সমগ্র নাগরিকের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, কেউ টার্গেট রেঞ্জের বাইরে নেই। এ অবস্থায়ও সমস্যাটা জাতীয় হিসেবে দেখছেন না, ভাবছেন না বর্তমানে দেশের রাজনীতির বন্ধ্যা বাজারের পাইকাররা। দেশ ও জনগণের জন্য এটা বড় এক দুর্ভাগ্য। সবারই অনুধাবন করা উচিত, এটা এক ভয়ঙ্কর জাতীয় রাজনৈতিক সংকট— স্রেফ কয়েকটা খুন-খারাবির বিষয় নয়। নিরীহ মানুষ হত্যা করে দেশময় একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অপরাধীরা এ বার্তাই তো দিতে চাচ্ছে যে, ‘হুঁশিয়ার আমরা আসছি’। এমন শক্তির উত্থান ও আগমন ঠেকানো একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। পরাশক্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এমন কথাই বলেছেন দিন সাতেক আগে। আমাদের দেশে উদ্ভূত জঙ্গি পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও শক্তির মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে জাতীয় ঐকমত্য। সরকার পারছে না এটা প্রমাণিত। একা সরকারের পক্ষে পারা সম্ভবও নয়। সরকারের উচিত, দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া। ক্ষমতাসীনদেরই ইনিশিয়েট করতে হবে জাতীয় শান্তি ও রাষ্ট্রীয় স্থিতি নিশ্চিত করার স্বার্থে। রাজনীতিবিদরা ঐক্যবদ্ধ হলে জনগণও ঐক্যবদ্ধ হবে। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে জঙ্গি তত্পরতা নির্মূল হতে বাধ্য। একাত্তর তো আমাদের সামনে নজির হয়েই আছে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ, গদির লোভ ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থকে যদি আমাদের সব পক্ষের দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতারা অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রাধান্য না দেন, ক্ষুব্ধ, দ্রোহী জনগণ এই নেতৃবৃন্দকেই একসময় ‘না’ বলে দিতে পারে।

জঙ্গিবিরোধী এক সপ্তাহের অভিযানের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনা-পর্যালোচনার ওপরের বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবেই।

 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর