রবিবার, ১৯ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

অনন্যার অনন্য বাবা

অনন্যার অনন্য বাবা

পৃথিবীতে মা-বাবার নিজের সুখ আর আনন্দের চেয়ে সন্তানের সুখ আর আনন্দ আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমার মেয়ে অনন্যা আমার জীবনের সবকিছু’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন, ১২ বছরের মেয়ে অনন্যার বাবা আজম খান। পরিচালকের চোখ দিয়ে নয়, একজন মায়ের চোখ দিয়ে দেখলাম, তার চোখ যেন চিকচিক করে উঠল।

সময়টা ছিল নভেম্বর। একদিন এটিএন বাংলার চন্দন সিনহা ফোন দিলেন আমাকে দেখা করার জন্য। চন্দন দা আমাদের পারিবারিক বন্ধু। তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের দারুণ সম্পর্ক। তা ছাড়া চন্দন দাকে আমি সম্মান করি।

আমার এডি সুব্রত মিত্রকে নিয়ে এটিএন বাংলায় গেলাম। চন্দন কফি দিলেন। খেলাম। বললেন, ‘ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং তোমাকে ফোন দেবেন।’ হাসতে হাসতে বললাম, কেন? আমার তো কোনো লোন লাগবে না, প্রডিউসারও লাগবে না, তা ছাড়া তাকে তো আমি চিনি না। চন্দন দা বললেন, ‘ধুর বউদি, ওসব কিছু না। আজম খান দারুণ এক মানুষ। ১২ বছরের মেয়ে আছে তার। তার শখ মাঝে মাঝে ভালো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার। শখের কাজ। তোমার নাটকে করপোরেট লুক হ্যান্ডসাম বাবা লাগে না? তিনি আমাদের কাছে খুবই সম্মানিত। তাই তোমাকেই বললাম।’

সুব্রত আর আমি হেসেই খুন। আমাকে নম্বর টেক্সট করে দিলেন। দুই দিন পর আবার কল দিলেন। তোমাকে এত করে বললাম, একটা কল দিলা না আজম খানকে! চন্দন দার সেদিনের কথাই ঠিক। ১০ নভেম্বর তার কথামতো হ্যান্ডসাম আজম খানের সঙ্গে আমার দেখা হলো। ওই মাসে আমার সারা মাস শুটিং ছিল। চিটাগাং, রাঙামাটি রিসোর্ট আর নেপালে। এর মধ্যে সময় বের করলাম, কথাও হলো।

সেই নভেম্বর থেকে জুন। আজ সাত মাস ধরে তাকে আমি চিনি। খুবই ভদ্র, নম্র, মার্জিত এবং অবশ্যই হ্যান্ডসাম মানুষ আজম খান। না, আজ পর্যন্ত কোনো নাটকে তাকে আমার নেওয়া হয়নি।

সেদিনের পর থেকে তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়। দেখা হয়। তার পরিবারের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে পারিবারিক অনুষ্ঠানে। তার রুটিন ততদিনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। ভোরবেলা নামাজ পড়ে ৬টায় মেয়েকে তুলে রেডি করা, নাশতা করিয়ে নিজে রেডি হয়ে মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে ধানমন্ডিতে স্কুলে দেওয়া, নিজের অফিসে যাওয়া। অফিসে সারাটা দিন ব্যস্ত সময় কাটানো। ফাঁকে মেয়ের খোঁজ নেওয়া, ফিরল কিনা ঠিকমতো। লাঞ্চ করল কিনা, হোমওয়ার্ক করল কিনা, এমন অনেক কথা।

রাত ৮টা থেকেই অনন্যার কল।

বাবা তুমি কই?

এই তো মা রাস্তায়।

রাস্তায় কি অনেক জ্যাম বাবা?

এই তো একটু একটু।

তোমার সামনে কয়টা গাড়ি?

তুমি কি বাসায় আসছ?

আর কোথাও যাবে তুমি?

না মা, কোথাও যাব না।

হ্যাঁ, আজম খান পারতপক্ষে কোথাও যান না।

অফিসের পর কোনো অফিশিয়াল প্রোগ্রাম না থাকলে তিনি সোজা বাসায় চলে যান। তার একটাই কথা, অনন্যা অপেক্ষা করছে। ও একা।

এক সকালে আজম খানের ফোন এলো। আপনি কি ব্যস্ত? কেন বলেন তো? শুনেছি আপনার ছেলেমেয়ে তুখোড় পড়াশোনায়। আমাকে একটা টিচার ঠিক করে দেবেন প্লিজ! আমি বাসায় ফিরে আমার মেয়েকে সব বললাম। ও বলল, আমি পড়াতে পারি। অনুলেখা এর আগেও পরিচালক শিহাব শাহীনের মেয়ে সফেনকে পড়িয়েছে। কিন্তু অনন্যাকে বাসায় আসতে হবে শুক্রবার আর শনিবার। পরে আজম খান নিজেই অনুলেখার সঙ্গে ঠিক করলেন যে বাকি দুই দিন এনএসইউ থেকে আমার মেয়ের সুবিধা অনুযায়ী তাদের গাড়ি ওকে আনতে যাবে আবার পড়া হলে বাসায় দিয়ে আসবে। আমি তো অবাক।

শুরু হলো বাবা আজম খানের নতুন ছুটির দিন। শুক্র-শনি আমাদের বাসায় নামিয়ে তিনি চলে যান তার বাবা-মায়ের কবরস্থানে। পরে মেয়েকে নিয়েই তার দিন-রাত শেষ হয়। নিজের সময় বলে তার কোনো সময় নেই। জীবনের অনেক লোভনীয় আড্ডা তিনি স্যাক্রিফাইস করেছেন। মেয়ের ব্যাপারে তিনি খুব আন্তরিক, কেয়ারিং আর বিশ্বস্ত।

শপিং করা, সিনেমা দেখা, বই কেনা ডাক্তার দেখানো— সব একাই তিনি বাবা হিসেবে পালন করেন, যা একজন মায়ের করার কথা।

একদিন আমাকে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ দিলেন। আমি গ্রহণ করলাম। শেষ বিকালে যখন আলো কমে আসছিল তখন আজম খান বললেন, ‘স্বপ্ন দেখি অনন্যা একদিন বড় হবে, দেশকে ভালোবাসবে। আমি তো বৃদ্ধ মানুষ। (এ কথাটা তিনি মজা করে বলেন। তিনি জানেন তিনি হ্যান্ডসাম) তাই অনন্যার জন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনছি। ওই মায়াঘরে ও থাকবে। আর আমার কথা মনে করবে। আমি তো আর সারা জীবন এই পৃথিবীতে থাকব না।

অনন্যা যেন তার নামের মতোই আলো ছড়ায় চারপাশ। ভালো মানুষ হয়। একজন বাবা হিসেবে ওর জন্য হয়তো অনেক কিছু করতে পারিনি, কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি।’

জানতে চাইলাম, নতুন করে জীবন সাজাতে ইচ্ছা করে না? তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘যদি বলি ইচ্ছা করে না তবে মিথ্যা বলা হবে। করে। কিন্তু অনন্যার মতো যার একটি দারুণ রাজকন্যা আছে তার আর কিছু চাইতে নেই।’

সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতের সোডিয়াম লাইটের আলোয় বাসায় ফিরছিলাম। কখন যে নিজের অজান্তে দুই চোখ ভিজে জল পড়ল টের পেলাম না! আজম খানের মতো বাবা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের।

অনন্যা তুমি বড় হও। বাবার ইচ্ছা পূরণ করো। তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী।

চয়নিকা চৌধুরী, নাট্যনির্মাতা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর