মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রবীণদের দিকে নজর দিন

অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান

বিশ্বজুড়ে প্রবীণদের (৬০+ বছর বয়সী) সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বাড়ছে। ১৯৯৫ সালের ৫৪ কোটি ২০ লাখ বিশ্ব প্রবীণ জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে ২০২৫ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ১২০ কোটিতে! দুঃখজনক ঘটনা হলো প্রবীণরা আজ ভালো নেই। তাদের প্রায় ৪৬ শতাংশ নিজেদের বাড়িতেই নানা প্রকারের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হয়ে মারাত্মক শারীরিক ও আবেগীয় সমস্যায় পতিত হচ্ছেন। প্রবীণের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর লাখ লাখ প্রবীণ ব্যক্তি স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিষয়টি আজ একটি বৈশ্বিক সামাজিক ইসু্যুতে পর্যবসিত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজন বিশ্ববাসীর সক্রিয় নজরদারি। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রবীণরা দুর্ব্যবহার, অবহেলা, নির্যাতন এবং শোষণের সম্মুখীন হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের প্রায় সব প্রবীণই কোনো না কোনো ধরনের দুর্ব্যবহারের শিকার হন; তবে অধিকাংশের ঘটনাই থাকে অনুচ্চারিত। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ প্রবীণ এ ধরনের অবস্থায় পতিত হন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে এর প্রায় ২৩ গুণ বেশি ঘটনা যা সবার অজানাই রয়ে যায়।

বাংলাদেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক এবং বিস্ফোরন্মুখ অবস্থা হলো জনসংখ্যার বার্ধক্য। বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ নাগরিক প্রবীণ। ২০২৫ সাল নাগাদ প্রবীণের (৬০ বা তদূর্ধ্ব বছর বয়সী) সংখ্যা হবে প্রায় দুই কোটি, ২০৫০ সালে প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি!! বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা, চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং যাতায়াত-যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল অনেক বেড়েছে এবং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে প্রবীণদের এখনো সেবা-সম্মান করা হয়। কিন্তু তাদের প্রতি অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার আর নির্যাতনের ঘটনা এখানেও কম নয়। আশঙ্কার কথা হলো, প্রবীণদের প্রতি এহেন আচরণের বিষয়ে আমরা কেউই পর্যাপ্ত মাত্রায় অবহিত, সচেতন অথবা সতর্ক নই। দেশের চলমান শিক্ষা পাঠ্যসূচি, গণমাধ্যম কর্মসূচি কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসূচিতে এ ব্যাপারে নেই তেমন কোনো সাড়াশব্দ। কিন্তু সময় থাকতে এখনই আমাদের সাবধান এবং উদ্যোগী হওয়া খুবই জরুরি। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে আর নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে, এখন থেকেই।

দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়ার সমাধান করা প্রয়োজন। এ জন্য দরকার গণসচেতনতা। আর এ গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের প্রতি অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার আর নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো দেশের সব শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হবে। জরাবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের প্রবীণদের তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন— তরুণ-প্রবীণ (৬০-৭০ বছর বয়সী), মধ্যম-প্রবীণ (৭০-৮০ বছর বয়সী) এবং অতি-প্রবীণদের (৮০ বা তদূর্ধ্ব বছর বয়সী)। এদের অবস্থা, সমস্যা, চাহিদা ইত্যাদি আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করে সে অনুযায়ী তাদের প্রতি যত্নবান হতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু ৭০ বছর আর অবসরগ্রহণের বয়স ৫৯ বছর। সাধারণত প্রবীণদের অথর্ব বা মূল্যহীন বলে অবহেলা না করে দেশের বিরাট সংখ্যক জ্ঞানী, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ প্রবীণদের জন্যে বিকল্প কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। বয়স্ক বলে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা না করে দেশের ছোট-বড় নানা ধরনের সেবাদান কাজে নিয়োজিত প্রবীণদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ জন্য কর্মক্ষম ও সচ্ছল থাকতে তাদের সহায়তা করা প্রয়োজন। সামর্থ্যবান প্রবীণদের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা, সাহচর্য, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তাপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের প্রবীণ নিবাস ও প্রবীণ সেবাকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে বিরাট সংখ্যক প্রবীণের বাসস্থান চিন্তা দূর হবে। প্রবীণ নারী, অটিস্টিক, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, হতদরিদ্র, আদিবাসী এবং সমাজবিচ্ছিন্ন প্রবীণদের অবস্থা ও চাহিদা বিশেষভাবে বিবেচনায় এনে সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগে নিরাপদ আবাসন তৈরি এবং লাগসই সেবার ব্যবস্থা করা বর্তমানে জরুরি হয়ে পড়েছে। পীড়াদায়ক আচরণ করা থেকে বিরত রেখে প্রবীণদের পারিবারিক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংশ্লিষ্ট রাখা যেতে পারে। বয়সের ভারে রোগে-শোকে আক্রান্ত প্রবীণকে কষ্টসাধ্য উপার্জন কাজে নিয়োজিত করা যেমন, সম্পদ ও বাড়িঘর পাহারা দেওয়া, বাজার করা, রান্না করা, শিশুদের দেখভাল ও স্কুলে আনা-নেওয়া করা ইত্যাদি সাংসারিক কাজে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করা কোনোক্রমেই সমীচীন নয়। প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য, খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি সরবরাহ করা এবং কাঙ্ক্ষিত সঙ্গ দেওয়া জরুরি। বাড়ির বারান্দায়, চিলেকোঠায়, খুপরিঘর বা গোয়ালঘরে তাদের রাখার কথা চিন্তা না করে বরং স্টোররুম, বেবিরুম, সার্ভেন্টসরুম তৈরির আগে প্রতিটি বাসা/ফ্লাটে পিতা-মাতার জন্য প্যারেন্টসরুমের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। গণসেবা প্রাপ্তিতে, নানা স্থানে চলাচলে, সড়ক পারাপারে, যানবাহনের আসন পেতে এবং বিপদাপন্ন প্রবীণের যে কোনো সহায়তায় বলিষ্ঠ ও ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবীণদের প্রতি অন্যায় আচরণ সংঘটিত হতে দেখলে তাত্ক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিবিধানের জোরাল ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রবীণদরদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান প্রবীণবান্ধব সরকার প্রবীণদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। প্রবীণদের জন্য সরকার বয়স্কভাতা কর্মসূচি, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩, পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩, প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। প্রবীণ এবং নবীন সব শ্রেণির নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব সরকারের নেওয়া প্রবীণ কল্যাণ কর্মসূচিতে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করা, বলিষ্ঠ করা এবং নিজেদের স্বার্থেই এগিয়ে নেওয়া। সফল বার্ধক্যের স্বার্থে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রিয় বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সব বয়সীর বসবাসের জন্য সমান উপযোগী একটি সুন্দর রাষ্ট্র।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ।

ই-মেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর