বুধবার, ২২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজনীতি ও নায়িকার পাঠানো হাঁসের মাংস

নঈম নিজাম

রাজনীতি ও নায়িকার পাঠানো হাঁসের মাংস

জীবনের সব কথা বলতে হয় না। আবার সব কথা বলাও যায় না। অনেক দিন আগে কথাগুলো বলেছিলেন আহমেদ জামান চৌধুরী। আমাদের প্রিয় খোকা ভাই। এক সময়ের জনপ্রিয় সিনে পত্রিকা চিত্রালীর সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু। পরে চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়ে সাংবাদিক। জনপ্রিয় অনেক গান লিখেছেন। চলচ্চিত্রের কাহিনীও লিখতেন। তার লেখা গান— ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন কপলের কালো তিল পড়বে চোখে’ জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। চিরকুমার আমুদে এ মানুষটি ছিলেন ভীষণ বড় মনের। মাঝে মাঝে আমার অফিসে আসতেন। আমিও যেতাম তার বাসায়। এক দিন তার বাসায় আড্ডা দিচ্ছি। আন্তরিকভাবে জানতে চাই, খোকা ভাই চিরকুমার থাকলেন কার জন্য? তিনি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, আপনি আমাকে এ প্রশ্নটি কেন করছেন? মতিউর রহমান চৌধুরী, আমীর খসরুও আসে। আড্ডা দিয়ে চলে যায়। আপনার মতো এমন প্রশ্ন ওরা করে না। খোকা ভাইয়ের বিয়ে না করা নিয়ে একটা গুজব ছিল। গুজবের নায়িকা ঢাকাই ছবির এক বিখ্যাত নায়িকা। আমি মজা করছি বুঝতে দিচ্ছি না। আবার বললাম, ওনারা আমার অনেক সিনিয়র। অনেক কিছু জানেন। আমি পেশায় নবীন। অনেক কিছু জানি না। খোকা ভাই বললেন, শোনেন জীবনের অনেক কথা বলা যায় না। অনেক কিছু শেয়ার করা যায় না। কিছু কথা মানুষের নিজের মাঝেই থেকে যায়। আপনি সব সময় সব কথা বলতেও পারবেন না। জীবনটা বড় অদ্ভুত। ক্ষণিকের জন্য আমরা আসি। আবার সব কিছু ছেড়ে চলে যাই। কেউ কাউকে বুঝি না। এবার বললাম, আত্মজীবনী লিখুন। সব কথা থাকবে। আপনার চলে যাওয়ার পর প্রকাশিত হবে। অথবা মাওলানা আজাদের মতো প্রথমে আংশিক ৩০ বছর পর পুরোটা। হাসলেন তিনি। বললেন, হয় না। কেউই সব কথা প্রকাশ করতে পারে না। স্পষ্টভাষী মানুষেরও কিছু কথা থেকে যায়। কথা বাদ। টেবিলে আসুন। আপনাকে হাঁসের মাংস খাওয়াব। এক নায়িকা রান্না করে পাঠিয়েছে। আমাকে সম্মান করে। খোকা ভাইয়ের সঙ্গে একবার রবীন ঘোষের বাসায়ও গিয়েছিলাম। সেই খোকা ভাই নেই। তার কথাগুলো এখনো কানে বাজে। কথা ছিল আমার কাগজে নিয়মিত লিখবেন। কয়েকটি লেখা দিয়েছিলেনও। আমরাও প্রকাশ করেছি। কিন্তু পরে সময় করতে পারতেন না। মানুষের জীবনের কঠিনতম সত্য শুধু খোকা ভাই নয়, কেউই বলতে পারেন না। আসলে অনেক সত্য উচ্চারণ করা যায় না। সুচিত্রা-উত্তমের এক ছবির সংলাপ এখনো মনে পড়ে। ছবিটির নাম অগ্নিপরীক্ষা। এই ছবিতে সুচিত্রা সেন তার এক বান্ধবীকে বলছেন, এমন কিছু কথা আছে যা কাউকে বলা যায় না। এমনকি অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও না। ছবিটি অনেক দিন আগে দেখেছিলাম। এখনো কিছু কিছু মনে গেঁথে আছে। সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়ে যায় ছোটবেলায়। একপর্যায়ে সেই স্বামীকে ছাড়তে হয় বাবা-মায়ের চাপের কারণে। আধুনিকা সুচিত্রা বড় হয়ে প্রেমে পড়েন উত্তম কুমারের। কিন্তু আগের বিয়ের কথা স্মৃতিতে আসতেই সুচিত্রা দ্বিধায় পড়েন। পালিয়ে থাকেন প্রেমিক উত্তমের কাছ থেকে। চোখে তার অশ্রু। সেই অশ্রু কতক্ষণ? সুচিত্রা নিজেই বললেন, চোখের আর কতটুকু জল আছে? সেইটুকু শেষ হলে থাকবে মনের আগুন। মনের আগুনে পুড়ে যাবে যা আছে সব।

আসলে আগে মানুষের মাঝে আবেগ ছিল। সেই আবেগের ছটা বাস্তব জীবন থেকে চলচ্চিত্রে দেখতে পাই। চিন্তার পরিশীলিত মাপকাঠির মাঝে কৃষ্টি, সংস্কৃতির ছাপ ছিল। মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ছিল। ছিল সুর ও মায়ার ইন্দ্রজাল। মানুষ সম্মান জানাতেন মানুষকে। এক বাড়ির বিপদে ছুটে আসতেন দশ বাড়ির লোক। আমাদের ছোটবেলায় পাড়াপড়শিও শাসন করতেন আমাদের। এই চুল বড় কেন? শুক্রবার তোমাকে মসজিদে দেখিনি কেন? স্কুলে ঠিকমতো যাস তো? এখন পাড়াপড়শি দূরে থাক বাবা-মার শাসনও ঠিকমতো চলে না। শিক্ষকদের একটা মর্যাদা ছিল। তারা সত্য কথা বলতে কুণ্ঠিত থাকতেন না। প্রভাবশালীদের চাটুকারিতায় লিপ্ত হতেন না। এখন অনেক কিছু দেখি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই যুগে আহমেদ শরীফের মতো শিক্ষকের জন্ম হলে চাপাতি পার্টির কবলে পড়তেন। এখন পরমত বলে কিছু নেই। আহমেদ শরীফ তার মতামত লালন, ধারণ, প্রচার করেছেন। অনেকে সমালোচনা করতেন। প্রগতিশীল মানুষ হিসেবেই সবাই তাকে দেখতেন। সম্মান দিতেন। কিন্তু তার ওপর ভয়ঙ্কর আক্রমণের কথা কেউ কল্পনাও করতেন না। কবি শামসুর রাহমান একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছিলেন মৌলবাদীদের হাতে। তবুও জঙ্গিবাদ নামক কোনো শব্দ নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। এখন ধর্মের অপব্যবহারই নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে সমাজে। একদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদ, অন্যদিকে অতি উৎসাহীদের সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ধর্মকে কটাক্ষ করা। দুর্ভাগ্যজনক সব কিছু। এক গ্রুপ সামাজিক গণমাধ্যমে যা খুশি তা লিখছে। কেউই মনে রাখে না কোনো বাড়াবাড়িই ভালো নয়। সমাজের স্থিতি ধরে রাখতে হবে। চিন্তা ও মতের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানাতে হবে। সমাজকে অস্থিতিশীল করে কোনো কিছুই করা ঠিক নয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেখে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঐতিহ্য আমাদের দীর্ঘদিনের। কবি নজরুল একই সঙ্গে ইসলামী গান এবং শ্যামা সংগীত লিখেছেন। নজরুলের গান দিয়ে আমাদের ঈদ শুরু হয়। শ্যামা সংগীতে হিন্দুরা আবার পূজা দেয়। নজরুল বলেছিলেন, ‘মোরা একটি বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলামান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ এই লেখার পর তখনকার গোড়া হিন্দুরা কবিকে বর্জন করে। মুসলিম পত্রিকাগুলো কবি নজরুলকে তুলাধোনা করে। তবু কবি থামেননি। তিনি সাম্যের গান গেয়ে গেছেন। মনে রাখা দরকার কবি নজরুল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এই কারণে হয়তো নেতাজি সুভাষ বসু বলেছিলেন, নজরুলের গান গাইব যখন যুদ্ধে যাব, আবার যখন জেলে যাব তখন। শুধু সাম্যের গান নয় রোমান্টিজমে তিনি চাঁদ থেকে চন্দন এনে প্রেয়সীর মুখে মাখিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। আহারে এই কবিকে নিয়ে অযথা কতই না বিতর্ক করি।

মানুষের এক জীবনে সব আশা পূরণ হয় না। তবু আমরা আশার আলো জ্বালিয়ে পথ চলি। আগামীকে বড় করে দেখি। কেউ বুঝি না এই জীবন বড় ঠুনকো। দুদিনের জন্য আমরা এসেছি। দুদিন পর সব শেষ। চলে গেলে কারও কিছু করার নেই। এই জীবনে এত হানাহানির দরকার নেই। যুদ্ধ আর লড়াই আমাদের ছোট করছে। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ইমেজ ক্ষুণ্ন করছে। অথচ মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য কত পুরনো। সবারই মনে রাখা দরকার ইসলাম শান্তির ধর্ম। জগত্জুড়ে ইসলাম শান্তির ছায়াকে প্রসারিত করেছে। নিরীহ মানুষকে যারা হত্যা করছে তারা নবীজীর আদর্শের বাইরের। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম বলেছেন, ‘মানব অগ্রগতির বৈশ্বিক লক্ষ্য থাকা উচিত।’ ঠিকই বলেছেন, মানুষের কল্যাণকে সামনে রেখেই পথ চলা উচিত। সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। কিন্তু নিজের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করার কোনো যুক্তি নেই। বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রায় সবাই সুন্নি। সুফিইজমের মাঝে সুন্নি মুসলমানদের বিকাশ। এখানে অশান্তির অনল সৃষ্টির সুযোগ নেই। এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু। ধর্মের বিপক্ষে কেউ কথা বললে মানুষ তা ভালোভাবে নেয় না। আবার ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলেও কেউ তার পক্ষে যায় না। আমি নিজেও ছোটবেলায় দেখেছি সারা রাত যাত্রা শুনে মানুষ ফজরের নামাজ আদায় করতেন। আমাদের অসাম্প্রদায়িক চিন্তার এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে। ছোটবেলায় হিন্দুদের পূজা দেখতে যেতাম। হিন্দুরা আমাদের ঈদে আসত। এই ঐতিহ্য শত শত বছরের। ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে হানাহানি-সংঘাত কোনোভাবে কাম্য নয়। বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না বলেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন। এখনো পাকিস্তান ধর্মের নামে এক ধ্বংসাত্মক দেশ। প্রতিদিনই ধর্মের নামে সেখানে মসজিদে হামলা হচ্ছে। শিয়ারা হত্যা করছে সুন্নি মুসলমানদের। আবার সুন্নিরা শিয়াদের। এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ। আমরা সব সময় এর বাইরে ছিলাম। কারণ বাংলাদেশ আকাশ ফেটে জ্যোত্স্না ছড়ায়। সেই আলোয় জ্বলে ওঠে ধরণী। আমরা বর্ষার কদম ফুলে মুগ্ধ হই। ভরা জ্যোত্স্নায় স্নান করি। আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, নৈতিক ঐতিহ্যগুলো ধরে রাখতে হবে। আর এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সমাজের সবারই কম বেশি দায়িত্ব আছে। কিন্তু যাদের দায়িত্ব বেশি তারা হলেন, রাজনীতিবিদ। কারণ রাষ্ট্র তারাই পরিচালনা করেন, কখনো ক্ষমতার বাইরে, কখনো ভিতরে।

প্রয়াত রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরীর কথাও আবার বলতে হচ্ছে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে প্রাণবন্ত ’৯১ সালের পার্লামেন্ট। মিজান চৌধুরী তখন জাতীয় পার্টির কাণ্ডারি। জাতীয় পার্টির নাম তখন দেশে নেওয়া যেত না। রাস্তায় নাম নিলে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের আক্রমণ। সংসদে নিলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। এর মাঝে এরশাদের নাম নিলে তো কথাই নেই। হৈচৈ করে সংসদ অচল। মিজানুর রহমান চৌধুরী সংসদে এক দিন কথা বললেন। তিনি শুরু করলেন, প্রথমে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করে। দুই দল চুপ। এরপর প্রশংসা করলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার। গণতন্ত্রের জন্য এই দুই নেত্রীর তিনি প্রশংসা করলেন। ধন্যবাদ জানালেন তাদের। সর্বশেষ বললেন, দুই নেত্রীর কারণে আজকের এই সংসদ। আর এই সংসদকে আরও প্রাণবন্ত করতে দরকার কারান্তরীণ বিদায়ী রাষ্ট্রপতি এরশাদকে। তাকে সংসদে প্যারোলে আনার প্রস্তাব দিচ্ছি মাননীয় স্পিকার। কেউ প্রতিবাদও করলেন না। এর আগে জাতীয় পার্টির ৩৫ এমপি যখনই এরশাদের নাম নিতেন ক্ষোভে ফেটে পড়তেন আওয়ামী লীগ, বিএনপির এমপিরা। এমনকি জামায়াতে ইসলামীও পিছিয়ে ছিল না। আসলে রাজনীতিতে সব কথাই বলা যায়। কিন্তু সেই কথা বলতে হয় পরিমার্জিতভাবে। উপস্থাপনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। সেই নেতাদের সংখ্যা সব দলেই কমে যাচ্ছে। এখন অন্য এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি হানাহানি বিভেদ বাড়াচ্ছে। পরস্পরের সম্মান ক্ষুণ্ন করছে। কিন্তু কেউ তা বোঝে না। বোঝার চেষ্টাও করে না ক্ষমতা কারও চিরস্থায়ী নয়। প্রয়োজনে ধর্মীয় হানাহানি ও জঙ্গি তত্পরতা দমনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কবি নজরুল বলেছেন, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। আর নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আবেগঘন বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। আমাদের আবিষ্কার করতে হবে ঐক্যের কোনো গভীরতম ভিত্তি, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যা আত্মিক ঐক্য গড়ে দেবে। মানুষের চেতনার গভীরে আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে মানবজাতির সব ধরনের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মহান ঐক্যের কোনো ধরনের বন্ধন কার্যকর। আর এই কর্তব্য সম্পাদনের যথার্থ যোগ্যতা আমাদের রয়েছে। আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের অবিনশ্বর কৃতীর উত্তরাধিকারী, সেসব মহান ঋষি যারা ঐক্য আর সংবেদনের ধর্ম প্রচার করে ঘোষণা করেছিলেন : যে সর্বভূতকে আত্মবৎ উপলব্ধি করে, সে-ই যথার্থ সত্যদ্রষ্টা। শুধু প্রাচ্যের সন্তানদের নয়, পাশ্চাত্যের সন্তানদেরও এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। তাদের আবার সেই মহৎ অমর সত্যগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।’

     লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর