বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস

তোফায়েল আহমেদ

আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন। ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লালসূর্য অস্তমিত হয়েছিল। যারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন-মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অকালপ্রয়াত নেতা শামসুল হক-তারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার জন্য ঐতিহাসিক এই ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল আমার। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমি শুনেছি, তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি যে, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাঙালির ভাগ্য-নিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই প্রথমে তোমাদের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। তারপর ২৩ জুন এই ঐতিহাসিক দিনটি বেছে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। লক্ষ্য ছিল একদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন করা।’ আজ আওয়ামী লীগের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সে-সব কথা আমার মানসপটে ভেসে ওঠে।

জাতির জনক যে লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, ’৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ’৬২-তে আমাদের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়েছিলেন লাহোরে। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে ৬ দফা দিলেন। বিমানবন্দরে জাতির সামনে ৬ দফা পেশ করলেন। এবং ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে জাতির জনক আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেন এবং শহীদ জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক হলেন। ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন ‘সাঁকো দিলাম, এই সাঁকো দিয়েই একদিন আমরা স্বাধীনতায় পৌঁছাব।’ ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর।

৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। আমরা জাগ্রত ছাত্র সমাজ সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে রাজপথে নেমে এসে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিলাম। আসাদ, মকবুল, রুস্তম, মতিয়ুরসহ অসংখ্য শহীদের বিনিময়ে। তখন আমরা স্লোগান দিতাম ‘পাঞ্জাব না বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা’। এইভাবে ধাপে ধাপে আমরা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি এবং জাতির পিতাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ চিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছি। তারপরে আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যখন ১ মার্চ জাতীয় সংসদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করল ইয়াহিয়া খান তখন দাবানলের মতো আগুন জ্বলে উঠল। রাজপথে লাখ লাখ লোক নেমে আসল। শুরু হলো আরেক দফা আন্দোলন। তারপর জাতির জনক ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে তিনি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করলেন। এবং শেষ করলেন এই কথা বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই বক্তৃতাটইি ছিল আমাদের ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধু ৯ মাস মিয়ানওয়ালী কারাগারে কারারুদ্ধ অবস্থায় যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, আমরা তখন হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর দেশকে স্বাধীন করেছি। সুতরাং জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই যে ইতিহাস, তার শুরু আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই; সুতরাং আওয়ামী লীগের অর্থই হলো সংগ্রাম। বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু এই তিনটি নাম একীভূত।

পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন। কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আমরা সাব্যস্ত করি মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বপ্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের পতাকা তারই হাতে তুলে দেব। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। একই বছরের ১৭ মে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বৃষ্টিমুখর দিনে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। ওইদিন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭৩৭ বোয়িং বিমানে ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে সে-সময়ের ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বিকাল সাড়ে ৪টায় এসে পৌঁছেন। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ তাকে সংবর্ধনা জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে সমবেত হয়। ওই সময় লাখো জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিল,- ‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা-স্বাগতম’; ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা  নেবো’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেবো না’; ‘আদর্শের মৃত্যু নেই, হত্যাকারীর রেহাই নেই’; ‘মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’।

দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ সাফল্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে যোগ্যতার সঙ্গে দলকে গণরায়ে অভিষিক্ত করে তিনবার সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। নিষ্ঠার সঙ্গে, সততার সঙ্গে, অত্যাচার-অবিচার সহ্য করে, জেল-জুলুম নির্যাতন ভোগ করে আওয়ামী লীগকে বাংলার মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ’৭৫-এর পর অনৈক্য আর ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ যখন কঠিন সময় অতিক্রম করছিল, তখন তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তখন সামরিক শাসকের দুঃশাসনের কবলে নিপতিত। দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে সেই দুঃসময় থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। ’৮১-এর সম্মেলনে সবাই ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জীবন-পণ চেষ্টা করে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করেছিলাম। যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মনে করেছিল তারা শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই যেন ফিরে পেয়েছে।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিল স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া। গত শতাব্দীর ’৭০-এর দশকের শেষ এবং ’৮০-এর দশকের শুরু থেকেই গণতন্ত্রমনা দেশপ্রেমিকদের জন্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বিষিয়ে তুলেছিল এই সামরিক শাসক। সংবিধান স্থগিত করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। রাজনীতিকদের বেচা-কেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাষ্ট্রীয় মদতে দলভাঙার নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া সদম্ভে ঘোষণা করেছিল, ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’ এবং ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস।’ জেল, জুলুম, হুলিয়া, গুম-খুন ইত্যাদি ছিল নিত্যকার ঘটনা। প্রতিদিন সান্ধ্য আইন জারি ছিল। চারদিকে গড়ে তোলা হয়েছিল এক সর্বব্যাপী ভয়ের সংস্কৃতি। ’৭৬-এর ১ আগস্ট সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া সীমিত পরিসরে ‘ঘরোয়া রাজনীতি’ করার অনুমতি দেয়। আমরা যারা জেলে ছিলাম এবং যারা জেলের বাইরে ছিলেন তারা দলকে সংগঠিত করেছিলেন। তখন প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদকে সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্যে ’৭৭-এর ৩ ও ৪ এপ্রিল মতিঝিলের হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী সমবেত হয়। নেতৃবৃন্দ মতবিরোধ নিরসন করে দলীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। ’৭৭-এর এপ্রিলে আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হওয়ার এক বছর পর ’৭৮-এর ৩ থেকে ৫ মার্চ ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কারান্তরালে থাকা অবস্থায়ই আমাকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। সেই দুর্দিনে জাতির জনক ও জাতীয় নেতাদের অনুপস্থিতিতে দলকে সংগঠিত করতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। দুঃসময়ের সেই দিনগুলোতে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

১৫ আগস্টের পর থেকেই আমাকে প্রথমে গৃহবন্দী ও পরে গ্রেফতার করে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করে খুনিচক্র এবং সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে কারান্তরালে নিক্ষেপ করে। কারাজীবনের কুড়ি মাস ছিলাম ময়মনসিংহ কারাগারে এবং ১২ মাস কুষ্টিয়া কারাগারে। প্রায় ৩৩ মাস কারাগারে আটক থাকার পর আমার ও আবদুর রাজ্জাকের মুক্তির ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করলে প্রথমে রাজ্জাক ভাই এবং ৪ মাস পর-’৭৮-এর ১২ এপ্রিল-আমি মুক্তিলাভ করি। কারামুক্তির পর দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতৃত্বের সঙ্গে সারা দেশ চষে বেড়াই। এর মধ্যেও দলের অভ্যন্তরে ছিল নানারকম মতবিরোধ। সবধরনের দলীয় মতানৈক্য দূর করে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বপ্রদানকারী প্রাণপ্রিয় দল, আপামর বাঙালির মুক্তির ঠিকানা আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করে আমরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলি। ’৭৮-এর সম্মেলনে আবদুল মালেক উকিল সভাপতি, আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক ও আমি সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই।

’৮১-এর সম্মেলনে সবারই ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে। সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে সন্ধ্যার প্রাক্কালে সকলের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি যখন দলীয় প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যার নাম প্রস্তাব করি, তখন তা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। সেকি আনন্দ-উচ্ছ্বাস, সেকি দৃশ্য! চোখের সামনে সেই ছবি ভেসে ওঠে। যা আজ ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। মনে হয়েছে যে আবার আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাছে, যে রক্তের কাছে আমরা ঋণী,-যে ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না-সেই রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার হাতে দলীয় পতাকা তুলে দিয়ে ঋণের বোঝাটা হয়তো কিছুটা হালকা করতে পেরেছি। সেদিন সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার নাম শুনে নেতা-কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং বিপুল করতালির মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে। শেখ হাসিনা সভানেত্রী, পুনরায় সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আবদুর রাজ্জাক এবং আমি নির্বাচিত হই।

আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করে দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-এ আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে আসীন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করে আমরা মন্ত্রী হয়েছি, ৫ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আমাদের হারানো গৌরব স্বাধীনতার সুমহান চেতনা প্রতিষ্ঠার পথে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দল এবং তার আদর্শকে হত্যা করতে পারে নাই। শুরু হয়েছিল আমাদের নূতন যাত্রা। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স চাপিয়ে দিয়েছিল, তাদের পরাস্ত করে ইনডেমনিটি আদেশ বাতিল করে বিচারের পথ প্রশস্ত করেছিলাম। ২০০১-এ ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া সেই বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। ২০০৯-এ সরকার গঠন করে সেই বিচারের কাজ শেষ করে আদালতের রায় বাস্তবায়নের পথ করে বাংলার মাটিতে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী না হতেন তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনোদিন বাংলার মাটিতে হতো না। যেখানে বিএনপি যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিল, সেখানে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলার মানুষকে কলঙ্কমুক্ত করে চলেছে।

আওয়ামী লীগ আমলে আমরা যদি দেশের উন্নয়নের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে, বিস্ময়কর উত্থান এই বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর দুটি স্বপ্ন ছিল-এক, বাংলার স্বাধীনতা; দুই, শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আজ জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলার মানুষ সেই অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে চলেছে। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্যাভাব ছিল, এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে খাদ্যশস্যে আমরা উদ্বৃত্ত শুধু নই, বাংলাদেশ এখন খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। যখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তারপর থেকে আমাদের রপ্তানি ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে আজ তা প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসীদের থেকে আয় ১৫ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭১-এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর; একই কালপর্বে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর; আর ২০১৪-এর হিসাব মতে বর্তমানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর, পাকিস্তানের ৬৫ বছর আর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৯ বছর। ১৯৭১-এ ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে বাংলাদেশে ছিল ২২৫ জন; ভারতে ১৬৬ জন। আর এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় বাংলাদেশে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৬ জনে আর ভারতে তা ৬৫ জন আর পাকিস্তানে ৭২ জন। আর্থ-সামাজিক সব ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে চলেছি। নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে।’ গত বছর ডিসেম্বর মাসে কৌশিক বসু এসে বলে গেলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি চমৎকার। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি মডেল।’ মানব সূচক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্মিত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এই হার অব্যাহত থাকলে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে আমরা ২০২১-এর পূর্বেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হব। সুতরাং, সামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই আজ আমরা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি। শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা যখন যাই তখন আমাদেরকে যারা একদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বলে বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটানা ১৪ বছর দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। তারপর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও তার কাছে থেকে কাজ করেছি। এ ছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তাকে কাছ থেকে দেখেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে যখন তার কাছে বসি বা ক্যাবিনেট মিটিং করি বা সভা-সফর করি, তখন বঙ্গবন্ধুর কথা আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর জীবনে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই করতেন; একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার সঙ্গে আপস করতেন না এবং ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও মাথা নত করতেন না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও আমাদের জাতির জনকের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই আদর্শ অর্জন করেছেন। তিনিও লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করেন এবং সেই লক্ষ্য পূরণে থাকেন অবিচল। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব তিনি তার পিতার মতোই একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা। একাত্তরের ঘাতক মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিনা রক্তপাতে একজনকেও হত্যা বা গ্রেফতার না করে ৫ মে রাতে ষড়যন্ত্রকারী হেফাজতীদের শাপলা চত্বর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বিতাড়িত করে স্বাধীন বাংলাদেশে নব-ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে পরিচালিত করেছেন। শেখ হাসিনা আজ শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক ও সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।

 প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে জননেত্রী শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করে বলেছিলেন, ‘৫০ বছরের গ্যাসের মজুদ না রেখে আমি গ্যাস রপ্তানি করব না।’ সেই অঙ্গীকার তিনি সমুন্নত রেখেছেন এবং দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শেখ হাসিনা সর্বশেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে খোদ আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের জাতিগত পক্ষপাতিত্বের কথা খুবই স্পষ্ট করে বলেছেন। শেখ হাসিনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন টেলিফোনে অনুরোধ করে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ রহিত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু জনসাধারণের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শেখ হাসিনাকে টলাতে পারেননি। ফারাক্কার পানি বণ্টনে বঙ্গবন্ধু সরকার শুষ্ক মৌসুমে পেয়েছিল ৪৪ হাজার কিউসিক পানির নিশ্চয়তা। সেই পানি কমতে কমতে বেগম খালেদা জিয়ার আমলে ৯ হাজার কিউসিকে নেমেছিল। আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনায় সুযোগ পেয়ে প্রথমেই পানি সমস্যার সমাধানে ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী পাওয়ার কথা ৩৪,০০০ হাজার কিউসিক, অথচ শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে শুষ্ক মৌসুমে ৬৪ হাজার কিউসিক পর্যন্ত পানি পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনারও রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। তিনি আজ ৩৫ বছর আওয়ামী লীগের সভাপতি; দীর্ঘ কালপর্বে বহু বাধার প্রাচীর তাকে টপকাতে হয়েছে! শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের লড়াই ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সময় ছিল যখন আওয়ামী লীগের ঘোর সমর্থকও অনেকে মন করত আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন; রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্তি যেন এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু শেখ হাসিনার বাস্তবোচিত রাজনৈতিক কর্মতত্পরতায় আওয়ামী লীগ তিনবার গণরায় নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার লাভ করেছে। আজ সমগ্র বিশ্বে বিশেষ করে কৃষি উৎপাদনের পথিকৃৎ বাংলাদেশ। ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে তখন দেশের খাদ্য ঘাটতি ছিল ৪০ লাখ মেট্রিক টন। সেই খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশকে তিনি উন্নীত করেছেন খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে। ধান, গম ও ভুট্টা জাতীয় ফসলে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই অগ্রসরমান বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বে প্রতি হেক্টর জমিতে গড় উৎপাদন প্রায় ৩ টন আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন।  ২০১৪-এর ৭ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো প্রধান ইরিনা বোকোভা শেখ হাসিনার হাতে ‘শান্তি বৃক্ষ’ পদক তুলে দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘সাহসী নারী শেখ হাসিনা সারা পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছেন।’ ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়লাভের পর সফলভাবে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি ও সমুদ্র সীমা নির্ধারণ চুক্তি করেছেন। বিশ্বব্যাংকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে পদ্মা সেতু নির্মাণের মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আসলেই শেখ হাসিনা না থাকলে পদ্মা সেতু হতো না। বঙ্গবন্ধু সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলপথ নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ, মেট্রো রেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ এসবই তার নেতৃত্বে যুগান্তকারী কাজ। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া বিদ্যুতের বিপুল ঘাটতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে জনজীবন থেকে লোডশেডিং দূর করেছেন। বিগত সাত বছরে রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন। যার ফলে ঢাকার চেহারাই পাল্টে গিয়েছে। নয়নাভিরাম হাতিরঝিল প্রকল্প, চলাচলের সুবিধার জন্য নিত্য-নতুন ফ্লাইওভার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অবদান।

২০০৭-এর ১/১১-এর পরে ১৬ জুলাই যেদিন শেখ হাসিনাকে বন্দী করা হয়, সেদিন তিনি জিল্লুর রহমান সাহেবকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। সেদিনই আমি জিল্লুর রহমানের বাসভবনে যাই। তিনি আমাকে বুকে টেনে নেন। তাকে জড়িয়ে ধরেই অঙ্গীকার করেছিলাম, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এই কঠিন দুঃসময়ে আপনার নেতৃত্বে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব। জিল্লুর রহমান সাহেব আমাকে দলের মুখপাত্র এবং চৌদ্দ দলের সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যে আলোচনা হয়, সেখানেও ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির কনভেনর হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি যথাযথভাবে সেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ‘শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো নির্বাচন না, শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো সংলাপ না’-সেই সিদ্ধান্ত আমরা অটুট রেখেছিলাম। যে কারণে তৎকালীন সেনাসমর্থিত সরকার স্ত্রী, কন্যা এবং আমার নামে মিথ্যা মামলা দেয়। আমার স্ত্রী ও মেয়েকে হাইকোর্টে গিয়ে জামিন নিতে হয়। এমন অবস্থা হয়েছিল যে, কঠিন অসুস্থতা সত্ত্বেও আমাকে বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি। সে এক কঠিন সময়। নির্বাচনে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে শেখ হাসিনার দাবি তথা গণদাবি অনুযায়ী ১/১১’র সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও জাতীয় পরিচয় পত্রের দাবি মেনে নিয়ে তা প্রণয়নে বাধ্য হয়েছিল। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির সামনে ঘোষণা করেছিলেন রূপকল্প-২০২১। তাতে তিনি প্রধান দুটি অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন এক. ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন দুই. মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে দুটোই এখন বাস্তব। সম্প্রতি জাপানের উপদ্বীপ ইসে-শিমায় জি-৭ ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের আউটরিচ বৈঠকে অংশগ্রহণ করে দেশকে এক অনন্য-উচ্চতায় তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব সম্পদের ৬৪ শতাংশের অধিকারী বিশ্বের শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্রসমূহের নেতৃবৃন্দের প্রতি পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলা এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদমুক্ত বিশ্ব গঠনের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

শতরকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জাতির জনকের হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। সংবিধান এবং সাংবিধানিক শাসন সমুন্নত রাখতে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর। কেননা আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক দল, গণতান্ত্রিক দল। আর নিয়মতান্ত্রিক দল বলেই সেই ’৫৪ সাল থেকে অনুষ্ঠিত-’৮৮-এর এবং ’৯৬-এর ১৫ ফেরুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বাদে-প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের আমলে অনুষ্ঠিত বেসিক ডেমোক্রেটিক ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছিল। আমাদের প্রয়াত জাতীয় নেতৃবৃন্দের অন্যতম জাতীয় নেতা শহীদ কামারুজ্জামান, আবদুল মালেক উকিল, মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ অনেকেই এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। আবার যখন আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইলেকশন করেন তখন ফাতেমা জিন্নাহ’র সমর্থনে বঙ্গবন্ধু সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচারকার্য সংগঠিত করেন। যখন সামরিক শাসনে এলএফও-এর (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে ’৭০-এ নির্বাচন করার প্রশ্ন আসে তখন অনেকেই নির্বাচন বর্জনের ডাক দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঐতিহাসিক সিদ্দান্ত গ্রহণ করেন। তিনি বলতেন, ‘আসন্ন নির্বাচন আমার কাছে ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে রেফারেন্ডাম। নির্বাচনে বাংলার মানুষ তাদের ম্যান্ডেট প্রদান করে বিশ্ববাসীকে দেখাবে কারা তাদের নেতা। নির্বাচনে পরে আমি এই এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।’ সুতরাং ইতিহাস থেকে এটি স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ জনসাধারণের ভোটাধিকারে বিশ্বাস করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক নির্দেশনা পালন করে। যারা ভোটাধিকারে বিশ্বাস করে না, যারা অগণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। আমরা যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখব, একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দল মুসলিম লীগ, শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টি এদের অস্তিত্ব এখন আর নাই। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ’৭০-এর নির্বাচন বর্জন করে বলেছিল, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’-আজ তার বিলুপ্ত। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভগ্নদশায় নিপতিত। কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষয়িষ্ণু। প্রাচীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগ বাংলার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আজও তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে টিকে আছে। কেননা আওয়ামী লীগ গণসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল, গণবিচ্ছিন্ন নয়। যারা এসব ইতিহাস মনে রাখে না-নির্বাচন বর্জন করে, জনসাধারণের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে জ্বালাও-পোড়াও করে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করে মা-বোনের কোল খালি করে আর্থ-সামাজিক বিকাশকে ব্যাহত করতে চায় তারা অতিঅবশ্যই সমাজবিচ্ছিন্ন-গণবিচ্ছিন্ন এবং জনসাধারণ কর্তৃক পরিত্যাজ্য। সংবিধান মোতাবেক আগামী ২০১৯-এর ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের যে কোনো দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে। আমার বিশ্বাস সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে। কেননা ২০১৪’র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে তারা যে ভুল করেছে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে নিজেদের দলীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে বিপজ্জনক পথে এগোবে না।

সুতরাং, সকলের শুভবুদ্ধির প্রয়োগ ঘটিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় অগ্রগতিকে সমুন্নত রেখে চলতে পারলে আমরা ২০২১-এ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪২-এ উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে সক্ষম হব। জাতির জনকের আদর্শ ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের গৌরবময় সংগ্রামী পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সোনার মানুষ তৈরি করে সোনার বাংলা কায়েম করাই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিপ্রায়।  

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

[email protected]

সর্বশেষ খবর