মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্বাচীনদের হাত থেকে বাঁচান

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্বাচীনদের হাত থেকে বাঁচান

ঈদ মোবারক। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিম জাহানের জন্য এলো খুশির ঈদ। দয়াময় প্রভু আমাদের পঙ্কিলতা থেকে আলোর পথে পরিচালিত করুন। পবিত্র ঈদে এই কামনাই করি।

সিংহের ‘স’ আর ছাগলের ‘ছ’-এর মধ্যে যে কত পার্থক্য সেদিনও সেটা দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, যার কত নামিদামি উপাচার্য ছিলেন যাদের কথা মনে হলে এখনো গর্বে বুক ফুলে ওঠে। আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক। ভদ্রলোক কোথায় ছিলেন, কী করতেন, কী তার দক্ষতা, যোগ্যতা ভালো করে জানি না। যমুনার পশ্চিম পারের মানুষ শুধু এটুকুই জানি। দেখতে শুনতে সুন্দর বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কিনা বলতে পারব না! সেদিন ছাত্রলীগের ছাত্ররা উপাচার্যের গাড়ি ভেঙে, তার পদত্যাগ দাবি করছিল। আলাপ-আলোচনায় ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ায় তাদের দাবি প্রত্যাহার করেছে। গৃহপালিত দল দিয়ে যে কোনো দাবি আদায় হয় না তা আবারও দেখা গেল। তবে ক্ষয়িষ্ণু ছাত্রলীগকেও ধন্যবাদ জানাই, তারা ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে যেভাবেই হোক একটা ছোটখাটো প্রতিবাদ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্র-পত্রিকা ম্যাগাজিন বা কোনো প্রকাশনায় যদি এমন ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হয়, তাহলে কী আর করা যাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকাশনায় যদি বলা হয় জনাব জিয়াউর রহমান বীরউত্তম বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, তাহলে বাবার নামে কীর্তন করে তারেক আর কী অন্যায় করেছে? স্ত্রী যেমন স্বামীকে, বোন ভাইকে, সব ছেলে তেমনই তার বাবাকে বড় দেখতে চায়। তাই তারেক জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি করতেও পারেন! বড় বেশি অবাক হলাম ছাত্রদের দাবির মুখে উপাচার্য অস্থায়ী রেজিস্ট্রারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। দাবি মেনে তিনি পদত্যাগ করেননি। ছাত্রদেরও কী কানমন্ত্র দিয়েছেন তারা অবলীলায় মেনে নিয়েছে। একেই বলে ঠেলার নাম যশমত আলী মণ্ডল। বাচ্চাদের পুতুল খেলার মতো। লিখেছিলাম সত্যের কল বাতাসে নড়ে। সেদিন অগ্রণী ব্যাংকের এমডিসহ আরও কয়েকজন বরখাস্ত হয়েছে। তিনজনকে দুদক ইতিমধ্যে খোঁয়াড়ে পুরেছে। দুয়েকজন যারা বাকি তাদেরও খোঁয়াড়ে যেতে শুধু সময়ের ব্যাপার। গত বছর সোনার বাংলার ঋণ নিয়ে অমন জালিয়াতি করায় আমাদের এক নেতা ইকবাল সিদ্দিকী বড় বেশি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিল, আমাদের সঙ্গে প্রতারণা জালিয়াতি করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান অপমানজনকভাবে পদ হারিয়েছেন। আমি তাকে বারণ করেছিলাম অমন কথা বলতে। কিন্তু সত্যিই সত্যের কল বাতাসে নড়ে। অগ্রণী ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ একটি গ্রাহকের সঙ্গে যে নিদারুণ জালিয়াতি করেছে হাজার বছরেও তাদের সে পাপ মোচন হবে না।

সোনার বাংলা প্রকৌশলী সংস্থাকে সেই ’৯৪ সাল থেকে ১৩-১৪ বছরে অগ্রণী ব্যাংক সর্বমোট চার কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। সেখানেও ফ্যাকড়া। সুদকে মূলধন ধরে শুধু মঞ্জুরীপত্র দেয়, কোনো টাকা দেয়নি, যে কারণে অগ্রণী ব্যাংক মূলধন হিসেবে সর্বমোট দুই কোটি ছিয়ানব্বই লাখ টাকা আমাদের দিয়েছে। আর ওই ১৩-১৪ বছরে আমরা ব্যাংককে সুদ ও অন্যান্য চার্জ পরিশোধ করেছি ছয় কোটি সাতাত্তর লাখ। তারপরও ব্যাংক এখনো পায়। এ যেন সেই মহাজনী সুদখোর। এক সময় আবেদন করেছিলাম ব্যাংক আমাদের কত ঋণ দিয়েছে আর ওই সময় আমরা কত শোধ করেছি। সেই জন্য ব্যাংকের হিসাব মতোই উপরের ব্যাপার বেরিয়ে আসে। তারপরও ব্যাংকের চাহিদা মতো ২৬-০৬-১৪ তারিখে দশ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দরখাস্ত করেছিলাম। সেই দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাঞ্চ এবং জোনের হিসাবে ৩.১৯ কোটি টাকা আসল পানা দেখিয়ে ২৬-০৮-২০১৫ তারিখ ৪২৭তম বোর্ড মিটিংয়ে তোলা হয়। সেখানে পণ্ডিতেরা নানারকম হিসাব-কিতাব করে ৯,৫৬,৯১,০৩০ দেখায় যেখানে তাদের হিসাবেই ৭,৯৭,৭৬,৩৪৫ আরোপিত সাধারণ সুদ। বোর্ডের মেমোতে উল্লেখ করা হয়- ‘সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, উপরোক্ত স্মারকটি গত ২৬-০৮-২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ৪২৭তম সভায় উপস্থাপন করা হয়।’

স্মারকটি পর্যালোচনান্তে পরিষদ লক্ষ্য করে যে,

ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জনাব আবদুল কাদের সিদ্দিকী একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যুদ্ধে অপরিসীম অবদানের জন্য তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হন;

ঋণগ্রহীতা ইতঃপূর্বে কোনো সুদ মওকুফ সুবিধা ভোগ করেননি;

ঋণ হিসাবটি দীর্ঘদিন যাবৎ মন্দ হিসাবে শ্রেণিকৃত এবং

আদালতের মাধ্যমে ঋণ আদায় সময় সাপেক্ষ।

এ পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালনা পরিষদ এনপিএল ম্যানেজমেন্ট কমিটির মতামত/সুপারিশের আলোকে টাঙ্গাইল অঞ্চলাধীন শাখার খেলাপি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোনার বাংলা প্রকৌশলী সংস্থা (প্রা.) লিমিটেডের টার্ম লোন ও ওডি/কার্যাদেশ হিসাবদ্বয়ের কস্ট অব ফান্ড সংরক্ষণপূর্বক এবং রুগ্ন শিল্পের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক আয় খাত ডেবিট না করার বিধান থাকায় আয় খাত ডেবিট না করে মওকুফ অবশিষ্ট ১০,৮৮,২৬,৪২৩/- (দশ কোটি আটাশি লাখ ছাব্বিশ হাজার চারশত তেইশ) টাকা ১০% হার সুদে ১০ (দশ) বছর মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ সাপেক্ষে পরিশোধের বিষয়টি অনুমোদন করেন। উক্ত সময়ের মধ্যে মওকুফ অবশিষ্ট দায় পরিশোধ করতে না পারলে এ সুবিধা বাতিল বলে গণ্য হবে। বোর্ড মিটিংয়ে বসে কয়েক মিনিটের মধ্যে এক কোটি বত্রিশ লাখ বৃদ্ধি করে ১০.৮৮ কোটি আটাশি লাখ দেখিয়ে ১০% সুদে ১০ বছরে পরিশোধের সিদ্ধান্ত দেয়। মানে মুরগির আণ্ডার থেকেও দ্রুত সুদ বৃদ্ধি।

আমাদের আবেদন ছিল সমুদয় সুদ মওকুফ করে একবারে পরিশোধ। আমরা প্রায় ৫ বছর ধরে সমুদয় সুদ মওকুফে একবারে পরিশোধের প্রস্তাব করছিলাম। কত রাজাকার আলবদর, কত স্বাধীনতাবিরোধীর কত শত হাজার কোটি সুদ মওকুফ হলো। কিন্তু শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সোনার বাংলা প্রকৌশলী সংস্থার হলো না। উদ্যোক্তা মুক্তিযোদ্ধারা আজ কেউ বেঁচে নেই। তাই সংস্থার সমুদয় দায় পড়েছে আমার ওপর। ওয়ান-ইলেভেনের কল্যাণে সংস্থাটি গত ৯ বছর কোনো কাজ করছে না। কোনো কোনো সময় মনে হয়েছে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের সম্মান করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুয়েকবার তেমন দেখেছিও। কিন্তু ইদানীং যে অত্যাচার-বঞ্চনা— কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অগ্রণী ব্যাংকের এমডি এক সময় মনে করেছিলেন সোনার বাংলার ঋণ নিয়মিত করলে হয়তো সরকার এবং সরকারপ্রধান খুশি হবেন। ঋণ পুনঃতফসিলের পর কেউ কেউ ফোনে তেমন বলেছিলেন। কিন্তু গোল বাধে যেই কালিহাতী উপনির্বাচনে অংশ নেই তখন। বহু বছর ভারতে থেকেছি। ব্যাংক অব বরোদার এমডি আমার বাসায় এসেছেন আমি তাদের সঙ্গে অনেক উঠাবসা করেছি। ব্যাংক অব বরোদা এবং এলাহাবাদ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের অনেককেই চিনতাম। বিশেষ করে জনাব শেখ শহীদের শ্বশুর মুশফিকুস সালেহীন ব্যাংক সম্পর্কে আমাকে অনেক জ্ঞান দিয়েছেন। সবরকম নিয়ম-কানুন মেনে সোনার বাংলার ঋণ পুনঃতফসিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাটা বেইজ থেকে নাম বাদ দিয়ে দেওয়ার পর আবার কীভাবে মন্দ ঋণ বলা যায় এ ছিল আমার ধারণার অতীত। আর সোনার বাংলার ঋণ পুনঃতফসিল বাতিল হলে অন্য ব্যবসায়ীদের তিন চার লাখ কোটি টাকা পুনঃতফসিলের কী হবে? সেগুলোও তো বাতিল করতে হবে। আমি তো আর বসে বসে ললিপপ চুষব না? এসব নিয়ে আমিও তো কোর্ট-কাছারি করব। তখন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কী হবে? ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ৪২৭তম সভায় সোনার বাংলাকে ১০% সুদে ১০ বছরের সুবিধা দিয়েছে বলে দেখায়। অনেক বিত্তশালী জিনের বাদশাহকে বিনা সুদে ২৫ বছরের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তারা সব ব্যাংক সুবিধা পাবে কিন্তু সোনার বাংলা পাবে না, এখানে সুবিধা কোথায়? অসুবিধাই তো বেশি। আমি একজন রাজনৈতিক মানুষ, আমিও ১০ বছর কোনো নির্বাচন করতে পারব না! বাহ্ কী সুবিধা! গরু মেরে জুতা দানের মতো।

বাংলাদেশ খুবই ছোট্ট দেশ। সবার সঙ্গে সবার জানাশোনা। প্রথম শুনেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী চান না আমি নির্বাচন করি। সে জন্য সোনার বাংলার ঋণ পুনঃতফসিলে তিনি খুব ক্ষুব্ধ, তাই সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে। কিন্তু এখন শুনছি অন্যরকম। মুক্তিযুদ্ধে আমার এক যোদ্ধা ডা. আবদুর রাজ্জাক এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, তিনিই নাকি মূল নাটের গুরু। যিনি কালিহাতী উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তার অনুরোধে জনাব রাজ্জাক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বলেছিলেন, যেভাবেই হোক সোনার বাংলার ঋণ পুনঃতফসিল বাতিল বা ঘাপলা করতে হবে। সে রকমই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চান। জনাব রাজ্জাকের মুখে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কথা শুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অগ্রণীর এমডি যে আন্তরিকতা নিয়ে পুনঃতফসিল করেছিলেন তার চেয়ে জোরেশোরে সঠিক কাজটি বেঠিক করতে লেগে যান। যার ফল এখন ভদ্রলোকেরা একে একে পাচ্ছেন।

অতি সম্প্রতি জঙ্গিবাদের জানান দিতে গুলশানে যে ঘটনা ঘটেছে তার নিন্দার ভাষা নেই। উদ্ধার অভিযান সফল হয়েছে। সব মরে গেলে সেখানে আর উদ্ধার কী? তবে সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের তত্পরতা শতভাগ প্রশংসার যোগ্য। এতকাল শুনছি ক্রসফায়ার ক্রসফায়ার। ক্রসফায়ারে এত পারদর্শী পুলিশ, র‍্যাব তাদের অমন হলো কেন? হ্যান্ডকাফ পরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করা দেখানো বা বলা যত সোজা প্রকৃত প্রতিপক্ষের সঙ্গে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো অত সোজা না।

কিছু জঙ্গি পয়লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা করে যাদের জিম্মি করেছিল তাদের প্রায় সবাই আহত নিহত হয়েছেন। এমনি ঘটনা ঘটেছিল ’৭৪-এ ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের ভারতীয় হাইকমিশনে। ঘটনার পরিকল্পনাকারী কমান্ডার ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর কমান্ডার অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। কোনো রেস্টুরেন্ট দখল করে জিম্মি বানানোর ঘটনা আমাদের দেশে এর আগে কখনো ঘটেনি। ঠিক তেমনি কোনো  দূতাবাস আক্রমণ করে হাইকশিনারকে জিম্মি করার ঘটনাও বাংলাদেশের মানুষ জানত না। ভারতীয় হাইকমিশন আক্রমণে গণবাহিনীর তরুণ তুর্কিরা ছিল সাখাওয়াত হোসেন বাহার, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান, হারুন অর রশিদ, সৈয়দ বাহালুল হাসান সবুজ ও ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল হত্যাযজ্ঞ শিখতে বা সরকারকে উত্খাত করতে পরবর্তীতে লিবিয়াতেও ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তিনি এখন আওয়ামী লীগের এমপি। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের গাড়ি গেটে এলে আক্রমণকারীরা তাকে দুদিক ধরে ফেলে, ‘আপনি আমাদের জিম্মি, ঘরে চলুন।’ বন্দুকের ডগায় হাইকমিশনারকে তার অফিসে নিয়ে যাওয়ার সময় দোতলার সিঁড়িতে হাইকমিশনের নিজস্ব ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীরা গুলি চালালে বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন নিহত এবং বেলাল ও সবুজ আহত হয়। হাইকমিশনার সমর সেনও কাঁধে গুলি লাগায় আহত হন। ভারতীয় হাইকমিশনার জিম্মি ঘটনার অবসান ঘটে, আহত বেলাল এবং সবুজকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে এক সময় জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ক্ষমতায় এলে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। এখন তো ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল পুরোদস্তুর আওয়ামী লীগের নেতা ও এমপি। অন্যদিকে কুষ্টিয়ার খোকসার এমপি বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় গোলাম কিবরিয়াকে কুষ্টিয়া জেলা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার, কুষ্টিয়া জেলা গণবাহিনীর প্রধান মারফত আলীর প্রস্তাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর ’৭৪ প্রকাশ্যে ঈদগাহ মাঠে ১০-১৫ হাজার লোকের সামনে তাকে হত্যা করা হয়। গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার আগে কুমারখালী থানার ওসি নজরুল ৩০ জন এবং খোকসার ওসি আবুল ২০-২২ জন কনস্টেবল নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। গণবাহিনীর সদস্যরা যখন থানায় গিয়ে বলে, আত্মসমর্পণ কর না হয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। তখন থানার বীরেরা গণবাহিনীর কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে বলে, আমরা দু-একটা ফাঁকা গুলি ছুড়ে অস্ত্র দিয়ে দেব। আমাদের জানে মারবেন না। সেই সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে সাহস জোগায়নি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ফোন করেননি। আমেরিকা, জার্মানি, ইতালি কেউ খোঁজ করেনি। পৃথিবীর অন্যরা বঙ্গবন্ধুর পাশে আছে বলেনি। তারপরও তাকে রাষ্ট্র চালাতে হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা কত ভাগ্যবতী! তার পিছনে সারা দুনিয়া। শুধু জাতীয় সংহতি নেই। গতকাল কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। ১২-১৫ ঘণ্টা এ ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি উদ্ধার অভিযান নিয়ে রাস্তাঘাটে নাকি কোনো বেদনা নেই। মানুষের মধ্যে কোনো শোকের ছায়া নেই। শোক পালনেও কেউ অর্ধনমিত পতাকা তুলেনি, কালো পতাকা উড়ায়নি। আমরা কত দুর্ভাগা! আমাদের সামনে কত বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেদিকে কারও কোনো নজর নেই।

বহু দিন পর নেত্রকোনার এক সময়ের অবিসংবাদিত নেতা আবদুল করিম আব্বাসী সকাল সকাল আমার বাড়ি এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে, আবু সাঈদ চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, তোফায়েল ভাই, মণি ভাই, রাজ্জাক ভাই, নূরে আলম সিদ্দিকী, শেখ শহীদসহ কত নেতা এসেছেন। জাতীয়তাবাদী নেতা জিয়াউর রহমানকে কতবার পেয়েছি বাবর রোডে। কিন্তু হুইপ আবদুল করিম আব্বাসী কখনো আসেননি। তার এই প্রথম আমার বাবর রোডের বাড়িতে আসা। বয়স নাকি ৮০। তাকে দেখে চিনতে পারিনি। চেহারা তেমন বদল না হলেও তিনি আছেন কি নেই খেয়াল ছিল না। আর এমনিও তাকে দেখিনি প্রায় ৮-১০ বছর। তিনি বলেছিলেন আমাকে চিনতে পেরেছেন? চেহারা দেখে চিনিনি। কিন্তু গলার আওয়াজে চিনেছিলাম, ‘আপনি  হুইপ করিম আব্বাসী না?’ তিনি বললেন, ‘জাসদের গণবাহিনী নিয়ে আপনার লেখা পড়ে থাকতে পারলাম না তাই ছুটে এসেছি। তিন এমপির নাম লিখেছেন আমাদের নেত্রকোনার খালেক এমপির নাম লেখেননি। ময়মনসিংহের অ্যাডভোকেট ইমান আলীকে গণবাহিনী হত্যা করেছিল। আপনার কি মনে পড়ে মহিউদ্দিন সাহেবের ভাতিজা এক সময় ইকবাল হলে ভিপি শওকতুল আলম সগিরকে হত্যা করেছে?’ হ্যাঁ তিন এমপি লিখে কেমন যেন খালি খালি লাগছিল। কারণ সংসদ নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মাননীয় স্পিকার আমার চারজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আজও আমার কানে বাজে। জনাব আব্বাসীর কথায় বড় বেশি উৎসাহিত হয়েছিলাম।

প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। তখন বিএনপি ক্ষমতায় জনাব আব্বাসী হুইপ। লুত্ফুজ্জামান বাবর প্রবীণ নেতা মোমিন ভাইকে হারিয়ে মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ির এমপি। পূর্বধলার আওয়ামী লীগের এমপি মোশারফ হোসেনের আমন্ত্রণে দুই সপ্তাহের সাংগঠনিক সফরে নেত্রকোনা গিয়েছিলাম। দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, খালিয়াজুড়ি, আটপাড়া, বারহাট্টা, মদন, কেন্দুয়া-নেত্রকোনার কোনো উপজেলা বাদ ছিল না যেখানে সফর করিনি। নেত্রকোনা সার্কিট হাউসের ১ নম্বর রুম মোশারফ হোসেন এমপির নামে বুক করা ছিল। আমি সেখানেই ছিলাম। খুব সম্ভবত দুই দিন ছিলাম তৃতীয় রাত নেত্রকোনায় থেকে ময়মনসিংহ চলে আসার কথা ছিল। গভীর রাতে নেত্রকোনা সার্কিট হাউসে ফিরে দেখি ১ নম্বর ভিআইপি রুম দখল হয়ে গেছে। আমার জিনিসপত্র বাইরে। মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। বিরক্তিও লেগেছিল অনেক। নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহ ৩০-৩৮ কিলোমিটার। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কল্যাণে শেরপুর এবং নেত্রকোনার রাস্তা ছিল তখন বাংলাদেশের সেরা। আগে ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা যেতে ৭-৮ ঘণ্টা লাগত সেখানে তখন ৪০-৪৫ মিনিটেই ময়মনসিংহ আসা যেত। তাই গভীর রাতে নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহ ফিরে অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল কবিরের বাড়ি উঠেছিলাম। তখন আনোয়ারুল কবির ছিলেন না। কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী, ছেলে অসম্ভব যত্ন করেছিল। ভারতে কত বছর থেকেছি, কত সরকারি অতিথিশালা ব্যবহার করেছি। স্বাধীনতার পর ধুবড়ী সার্কিট হাউসের ভিআইপি রুমে ভারতের কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ ছিলেন পরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। আমি যাওয়ায় তিনি সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক মান্নানের অনুরোধে একবার মেহেরপুর গিয়েছিলাম। মন্ত্রী হিসেবে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ ছিলেন মেহেরপুর সার্কিট হাউসের ১ নম্বর ভিআইপি রুমে। সংসদ সদস্য হিসেবে অধ্যাপক আবদুল মান্নানের নামে ২ নম্বর রুম বুক করা ছিল। আমি গিয়েছি শুনে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ রুম ছেড়ে কুষ্টিয়া চলে গিয়েছিলেন। ডিসি সাত্তারকে বলেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীর মতো একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা দেশের গৌরব ২ নম্বর রুমে থাকবে আর আমি থাকব ১ নম্বর রুমে? জিনিসটা মানানসই হয় না। আপনি নিজে তাকে ১ নম্বর রুমে তুলে দিবেন।’ কেউ রুম ছেড়ে দেয় আবার কেউ দখল নেয়। তেমন ঘটনাই ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ২০-২৫ বছর আগে। যে কারণে হয়তো জনাব করিম আব্বাসীর আমার সম্পর্কে দ্বিধা থাকতে পারে। আমারও কিছু দিন বিরক্তি ছিল নেত্রকোনা সার্কিট হাউসের ঘটনার জন্য। তারপর ভদ্রলোক সংসদে এসেছেন। আমিও সংসদে ছিলাম। প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় এক সময় আবদুল করিম আব্বাসী ছিলেন হুইপ, বাবর ছিল এমপি। পরে লুত্ফুজ্জামান বাবর হয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। পরে বহুবার বাবরের সঙ্গে কথা এবং দেখা হয়েছে। দু-একবার জিজ্ঞেসও করেছি ওভাবে সরকারি অতিথিশালায় কেউ কারও জিনিসপত্র বের করে দেয়? তোমরা অমনটা করেছিলে কেন? বাবর বার বার বলত করিম সাহেব ছিলেন প্রতিমন্ত্রী আমি এমপি আমার কী করার ছিল? যা করার করিম সাহেবই করেছেন। তিনি ক্ষমতা দেখিয়েছেন। হতেও পারে। ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতা দেখাবে। সবাই না দেখালেও কেউ কেউ দেখায়। ব্যাপারটা আমায় বিরক্ত করলেও করিম আব্বাসীর প্রতি কোনো বিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু সেদিন আমার বাড়িতে ছুটে এসে তথ্য দিয়ে সাহায্য করায় আমার মন প্রাণ হৃ দয় তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভরে গেছে। একেই বলে রাজনৈতিক চরিত্র। কোনো একটা ঘটনা রাজনৈতিক জীবনকে একেবারে উল্টে পাল্টে দেয় না। ছাত্রজীবনে ভদ্রলোক বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিলেন। আমাদের সতীর্থ। একজন নিবেদিত ছাত্রকর্মীর যে দক্ষতা যোগ্যতা থাকা দরকার তার তা ছিল। এখন স্বাধীন দেশ, নানা মত, নানা পথ। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি বিএনপি হয়েছিলেন। দাপটের সঙ্গে ৩০-৩৫ বছর বিএনপির রাজনীতি করেছেন। কিন্তু তিনি সেদিন ওভাবে আমার বাড়ি এসে যে সৌহার্দের পরিচয় দিয়েছেন তা অভাবনীয়। তিনি আমার বাড়িতে স্বস্ত্রীক নাতনি নিয়ে ইফতার করেছেন। আমিও আমার কলিজার টুকরো কুশিমনি ও কুশিমনির মা নাসরিনকে নিয়ে তার বাড়ি পবিত্র রমজানে ইফতার করেছি। মাহে রমজান মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি সৌহার্দের এক নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি করুন এই কামনাই করি আমিন।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর