মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

মেধাবী তারুণ্যের জঙ্গি হওয়া : দায় কার?

ফরিদা ইয়াসমিন

মেধাবী তারুণ্যের জঙ্গি হওয়া : দায় কার?

কাঁদছে বাংলাদেশ। কাঁদছে বন্ধুবৎসল এক মায়াবী তরুণ ফারাজ হোসেনের জন্য। কাঁদছে অবিন্তা, ইশরাতসহ হলি আর্টিজানে নিহত সবার জন্য। বাংলাদেশ কাঁদছে তারুণ্যের নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যও। এ কীভাবে সম্ভব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে? মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় গোটা জাতি স্তম্ভিত, শোকে মুহ্যমান। হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের ছবি দেখে স্তম্ভিত তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, গোটা দেশবাসী। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ এই পাঁচ জঙ্গির ছবি প্রকাশ করেছে, তারা কেউই মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। তারা উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। রাজধানীর নামিদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এরা বিত্তবৈভবের মধ্যেই বড় হয়েছে। কোনো কিছুর কমতি ছিল না। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে এরা স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এই মেধাবী তরুণরা কীসের আশায় কেন জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয়? এই প্রশ্ন আজ সবার মনে। নিখোঁজ হওয়ার পর তাদের পরিবারের কেউ কেউ থানায় জিডি করেছেন, হন্যে হয়ে ঘুরেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে। এমনকি কেউ কেউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছেন। কিন্তু তারা পাননি কোনো সহযোগিতা। পাননি সন্তানের কোনো খোঁজ। অথচ আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের দাবি জঙ্গি হিসেবে অনেক আগে থেকেই পুলিশ তাদের খুঁজছিল। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) ভাষ্য অনুযায়ী তাদের নাম আকাশ, বিকাশ, বাঁধন, রিপন, ডন। দীর্ঘদিন ধরে তারা আসামির তালিকায় ছিল। অথচ আইএস এর দেওয়া ছবির সঙ্গে মিলিয়ে জঙ্গিদের সহপাঠী ও আত্মীয়স্বজনরা ফেসবুকে তাদের আসল পরিচয় শনাক্ত করে। তাদের মধ্যে আছে নিব্রাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামি মোবাশ্বের। ছয় থেকে তিন মাস আগে নিখোঁজ হওয়া ছেলেগুলো কীভাবে দীর্ঘদিন আসামির তালিকায় ছিল? এ প্রশ্নও আজ সবার।

সাইট ইন্টেলিজেন্সের দেওয়া তথ্য অনুসারে তারা আইএসের সদস্য। হত্যাকাণ্ডের পরপরই তাদের ছবি প্রকাশ করে। প্রশ্ন হচ্ছে তারা কীভাবে জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হলো। জঙ্গি সংগঠনগুলো বরাবরই তাদের দলে ভিড়ানোর জন্য অনলাইনকে ব্যবহার করে। তাদের আদর্শসংবলিত বিভিন্ন লিফলেট, নিবন্ধ পাঠিয়ে তাদের যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদেরকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার জন্য ইসলামভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলায় প্রলুব্ধ করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা এখানে রোমান্টিসিজম বা হেরোইজমে আকৃষ্ট করা হয়। অনলাইনে তারা যা পাঠায় সবই ইংরেজিতে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য তা পড়া ও বোঝা খুব সহজ। তারা অনায়াসে তা পড়ে এবং কখনো কখনো তাতে আকৃষ্ট হয়। আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনের মূল টার্গেট মেধাবী তরুণরা। এর সঙ্গে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানান দ্বন্দ্ব-সংঘাত, স্কুলে অতিরিক্ত চাপ, কখনো বাবা মায়ের প্রত্যাশার বাড়তি চাপও তাদের বিপথগামী করে। তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েরা এসব চাপ সহ্য করতে না পেরে নতুন কিছুর সন্ধান করতে থাকে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, উচ্চবিত্তের অনেক তরুণ না চাইতে অনেক কিছুই পেয়ে যায়। কখনো কখনো জীবন তাদের কাছে পানসে হয়ে যায়। তখন নতুন হেরোইজমে তারা আকৃষ্ট হয়। গুলশান হামলার ঘটনার পর রেস্টুরেন্টের এক কর্মচারী নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জঙ্গিরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছে। এ থেকে সহজেই অনুমেয় তারা কতটা রোমান্টিসিজমে ভুগছিল। ভারতীয় অভিনেত্রী শ্রদ্ধা কাপুরের ভক্ত ছিল নিব্রাস। কোনো এক অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা কাপুরের সঙ্গে করমর্দন করে তা ফেসবুকে শেয়ার করে সে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। এক বছরের মধ্যে কীভাবে তার এতটা মগজ ধোলাই হলো। সেটাই সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের। এই ছেলেগুলো তাদেরই বয়সী ফারাজ হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অথচ ফারাজ তার বন্ধুদের বাঁচাতে জীবন দিয়েছে। কী বৈপরীত্য! এই ছেলেগুলো কীভাবে এতটা নৃশংস হয়ে গেল? এর দায় পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র, আমরা এই সচেতন মানুষেরা কি এড়াতে পারব? ওরা তো জঙ্গি হয়ে জন্ম নেয়নি। ওদেরও একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিল। গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী শতাধিক ছেলে বাড়ি থেকে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ আছে। রাষ্ট্রযন্ত্র কি সন্ধান করেছে তাদের? এই মেধাবী ছেলেগুলো কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? পুলিশের কাছে গিয়েও কোনো সহযোগিতা পায়নি পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ তাদের কাউকে কাউকে বলেছিল, আপনারা পায়সাওয়ালা মানুষ। ছেলে কোথাও বেড়াতে গেছে। আবার সময়মতো ফিরে আসবে। অভিযোগ করার পরেও পুলিশ কোনো তত্পরতা দেখায়নি।

পরিবারগুলো কি বুঝতে পেরেছিল তাদের সন্তান আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি লক্ষ্য করেছে ছেলেটা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। একদিন একটা চিঠি এলো আর তারা ঘর ছেড়ে চলে গেল ব্যাপারটা নিশ্চয় সেরকম না। তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে প্ররোচিত করা হয়েছে। জঙ্গি আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আমরা সবাই আমাদের জায়গা থেকে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।

ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল সম্পর্কে আমার বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। সেখানে সবকিছু সিস্টেমেটিক। তাদের স্টুডেন্ট কাউন্সিলর, সুপারভাইজার ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে বিদেশি স্টাইলে। কিন্তু সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষটি নেই। টিনএজ বাচ্চাদের সঙ্গে ঠিক কী আচরণ করতে হবে অধিকাংশ শিক্ষকই তা জানেন না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে স্বপ্ন দেখাতে তারা জানেন না। একটু ভুল হলে বাবা মা তুলে গালিগালাজ করেন, প্রয়োজনে টিসি দিয়ে বের করে দেন। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অভিভাবকদের অপমান করেন কিন্তু একটা কাদামাটির মতো নরম শিক্ষার্থীকে কীভাবে গড়ে তুলতে হবে তা জানেন না। পড়ালেখা আর ভালো ফলাফলের চেয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা পিতামাতা এবং শিক্ষক উভয়েরই দায়িত্ব। সেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই।

গুলশান হত্যাকাণ্ডে যেসব জঙ্গি অংশ নিয়েছে তারা এদেশে থেকেই জঙ্গি হয়েছে। নিশ্চয়ই এখানে তাদের প্রশিক্ষণ সেন্টার আছে— তা খুঁজে বের করা হোক।

এখনো কম করে হলেও পুলিশের তালিকায় একশ মেধাবী তরুণের নাম রয়েছে। রাষ্ট্র খুঁজে বের করুক তারা কোথায় আছে। লোক দেখানো সাঁড়াশি অভিযান নয় প্রকৃত অর্থেই এদের আস্তানা খুঁজে বের করতে হবে। না হলে জাতিকে চড়া মূল্য দিতে হবে।

অভিভাবকদের উচিত হবে সবার আগে নিজের সন্তানের প্রতি লক্ষ্য রাখা। অতি আদরের সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, সে কী পড়ছে, ইন্টারনেটে কী দেখছে সেগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশেষ করে সন্তান ধর্মান্ধতার দিকে ঝুঁকছে কিনা সেই বিষয়টি খুবই সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর