সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

উপজেলা পর্যায়ে কলেজ সরকারিকরণ ও শিক্ষার মান

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

উপজেলা পর্যায়ে কলেজ সরকারিকরণ ও শিক্ষার মান

দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি কলেজকে সরকারিকরণের ঘোষণা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক উৎসাহ ও আবেগ সৃষ্টি করেছে। সরকারি কলেজে মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে উন্নত শিক্ষার পরিবেশে শিক্ষার্থীরা উন্নত ও মানসম্মত শিক্ষা লাভ করছে, এমন ধারণা সবাই পোষণ করে। উপজেলা পর্যায়ে একটি সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে গ্রামগঞ্জের ছাত্রছাত্রীরা উন্নতমানের শিক্ষার সুযোগ পাবে। গ্রামাঞ্চলে সার্বিকভাবে শিক্ষার মান উন্নত হবে এবং পরীক্ষার ফলাফল শহর ও মহানগরে অবস্থিত সরকারি কলেজগুলোর সমপর্যায়ে উন্নীত হবে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার মানের বৈষম্য দূরীভূত হবে। সাধারণ মানুষ প্রতি উপজেলায় একটি কলেজ সরকারিকরণের বিষয়টি নিয়ে এ ধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশাই করছেন। আর এ প্রত্যাশা থেকে শুরু হয়েছে দেশের উপজেলা পর্যায়ে তুমুল প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ নেই, সেসব উপজেলার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ক্ষেত্রবিশেষ ঘটছে তেলেসমাতি কাণ্ড। স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ দৌড়ঝাঁপ ও ধরনা দিতে শুরু করেছে। কোনটি বাদ দিয়ে কোনটি অন্তর্ভুক্ত হবে, এ নিয়ে চলছে নীরব ও সরব প্রতিযোগিতা। আয়োজন করা হচ্ছে সমাবেশ, বিক্ষোভ এবং স্মারকলিপি প্রদানের কার্যক্রম। এমনকি টাকা-পয়সা লেনদেনের অভিযোগের কথাও শোনা যাচ্ছে। তার উপরে আছে রাজনৈতিক চাপ।

এ ধরনের একটি মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে মৌলিক কিছু বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং সেসব সমস্যা সমাধানের বিষয়কে মাথায় রেখে অগ্রসর হওয়া সমীচীন হবে। সর্বপ্রথমে বিবেচনায় আনতে হবে— বর্তমানে যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ বিদ্যমান আছে, সেসব কলেজের সার্বিক অবস্থা, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজের শিক্ষার পরিবেশ, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, ক্লাসরুমে শিক্ষক উপস্থিতি এবং সর্বোপরি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক কিনা তা বিশ্লেষণ জরুরি। সন্তোষজনক না হলে তার কারণ অনুসন্ধান করে সমস্যা সমাধানের অগ্রিম প্রস্তুতি নিয়ে এত বড় একটি মহৎ উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুবা উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের পরিবর্তে ওইসব সরকারি কলেজের শিক্ষার মানের মারাত্মক অবনতি ও পরীক্ষার ফলাফলের আশঙ্কাজনক ব্যর্থতার ভাগ্যবরণ করতে হবে। ওইসব সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে আসবে চরম বিপর্যয় ও হতাশা।

২০১৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার পর দেখা যায়, অন্য বছরের তুলনায় প্রতিটি বোর্ডেই ফল বিপর্যয় ঘটেছে। কুমিল্লা বোর্ডের ফলাফলে পাসের হার ৫৯.৮০% এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তের সংখ্যা ১৪৫২ জন। বিপর্যস্ত ফলাফলের মধ্যে কুমিল্লা বোর্ডের সরকারি কলেজগুলোর ফলাফল ছিল আশঙ্কাজনকভাবে খারাপ। ফলাফল প্রকাশের পর কুমিল্লা বোর্ডের সরকারি কলেজসমূহে এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের এক ভয়াবহ চিত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় (ইত্তেফাক, ৩০/০৮/২০১৫)। ওই বছর কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে ছয়টি জেলার ৩২৩টি কলেজ এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১০টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি, চাঁদপুরে দুটি, নোয়াখালীতে আটটি, লক্ষ্মীপুরে পাঁচটি, ও ফেনীতে ছয়টি সরকারি কলেজ রয়েছে। কুমিল্লা বোর্ডের ৩৪টি সরকারি কলেজ থেকে তখন ২৮ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফেল করেছে ১২ হাজার ৮৯০ জন। এর মধ্যে ১৮টি কলেজের কোনো পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি। এসব সরকারি কলেজের মধ্যে ১৮টি কলেজের পাসের হার ২০-৫০ শতাংশ, চারটি কলেজের পাসের হার ৫০-৬০ শতাংশ, সাতটি কলেজের পাসের হার ৬০-৭০ শতাংশ এবং তিনটি কলেজে পাসের হার ৭০-৮০ শতাংশ। অপর দুটি সরকারি কলেজের মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের পাসের হার ৮৬.৭৩ শতাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের পাসের হার ৮১.৮৮ শতাংশ। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এসব নামকরা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিল। দুই বছর শিক্ষা লাভের পর এত অধিক সংখ্যক ফেল করায় এবং যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষা সচেতন মহল চরমভাবে হতাশ হয়েছে।

কুমিল্লা বোর্ডের অধীন এক উপজেলায় দুটি সরকারি কলেজ একমাত্র আমার উপজেলা দাউদকান্দিতে অবস্থিত। একই উপজেলার দুটি বেসরকারি কলেজের পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে দুটি সরকারি কলেজের ফলাফলের তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোর বেহাল অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। উল্লিখিত চারটি কলেজই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত এবং যাতায়াত ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধার বিবেচনায় প্রায় সমান অবস্থান। সে কারণেই এ চারটি কলেজের পরীক্ষার ফলাফল উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছি। দাউদকান্দি উপজেলার দুটি বেসরকারি ও দুটি সরকারি কলেজের বিগত ৩ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের একটি তুলনামূলক চিত্র নিম্নে ছকে দেওয়া হলো :

ছক-‘ক’

দাউদকান্দি উপজেলার দুটি বেসরকারি কলেজের সঙ্গে দুটি সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার তিন বছরের ফলাফলের তুলনামূলক চিত্র :

উপরোক্ত ছক (ছক-‘ক’) পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৫ সালের অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষার দুটি বেসরকারি কলেজ থেকে যাথাক্রমে ৯৭.৫৬ শতাংশ ও ৯৩.৬৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। আর অন্যদিকে দুটি সরকারি কলেজ থেকে যথাক্রমে ৩৬.১৭ শতাংশ ও ৩২.৪৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। একই বছরে দুটি বেসরকারি কলেজ থেকে যথাক্রমে ১৭ জন ও ছয়জন জিপিএ-৫ লাভ করেছে, আর অন্যদিকে সরকারি দুটি কলেজ থেকে কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি। ২০১৫ সালের ফলাফলে দুটি বেসরকারি কলেজ থেকে যথাক্রমে ২০০ জন এবং ১৬৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-(অ) পেয়ে পাস করেছে। আর অন্যদিকে দুটি সরকারি কলেজ থেকে ‘অ’ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র তিনজন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় বেসরকারি দুটি কলেজ থেকে যথাক্রমে ৬৭ জন এবং ছয়জন জিপিএ-৫ লাভ করেছিল। ২০১৪ সালের পরীক্ষায় দুটি সরকারি কলেজ থেকে কেউ জিপিএ-৫ পায়নি। এভাবে বিগত তিন বছরের ফলাফল (ছক-‘ক’) এবং তার পূর্বের ফলাফলও তুলনামূলকভাবে প্রায় একই ধরনের। উল্লিখিত চারটি কলেজে দাউদকান্দি উপজেলার বিভিন্ন হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। একই ভৌগোলিক অবস্থান, একই ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা এবং সরকারি কলেজে বাড়তি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন সরকারি কলেজে ফলাফল বিপর্যয় ঘটে বা অব্যাহতভাবে ফলাফল খারাপ হয়, তার একটি বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

দাউদকান্দি উপজেলায় উল্লিখিত দুটি বেসরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই দুটি সরকারি কলেজের ফলাফল অব্যাহতভাবে খারাপ ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে এ এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি কলেজ দুটির শিক্ষার মান উন্নয়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমার সব উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছে। সরকারিকরণের পর থেকেই দুটি সরকারি কলেজে শিক্ষক সংকট বিরাজমান ছিল। চার থেকে পাঁচ বিষয়ে শিক্ষকের অভাব সারা বছরই এ দুই কলেজে বিদ্যমান ছিল। আমার প্রচেষ্টায় শূন্য পদে শিক্ষক দেওয়ার ব্যবস্থা করার পরও দেখা গেছে, শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে তদবির করে বদলি ঠেকিয়ে শহরেই থেকে গেছে। যাদের দুটি সরকারি কলেজে যোগদানে বাধ্য করা হয়েছে তারাও কয়েক মাসের মধ্যে পুনরায় বদলি হয়ে শহরে চলে গেছে। বদলিকৃত নতুন শিক্ষকরা কয়েক মাস থাকলেও পুরনো শিক্ষকরা বদলি হয়ে চলে যাওয়ায় অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষকশূন্যতা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত দাউদকান্দি উপজেলার এ দুই সরকারি কলেজে একই অবস্থা চলে আসছে। একজন শিক্ষার্থী দুই বছরের কোর্স সম্পন্নকালে গড়ে চার-পাঁচ বিষয়ে যদি শ্রেণিশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তার পক্ষে ওইসব বিষয়ে নিজে নিজে পড়ে পরীক্ষায় পাস করা সম্ভব নয়। শিক্ষকশূন্যতার কারণে যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেল করে তাদের কি দায়ী করা যাবে? অথচ তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে যে অন্ধকার নেমে আসছে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে?

উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কলেজগুলো বিশেষ করে দাউদকান্দি উপজেলার দুটি সরকারি কলেজের বেহাল অবস্থার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায় : (ক) কলেজ দুটি সরকারিকরণের পর থেকেই শিক্ষকের অভাব, (খ) শিক্ষকদের আবাসিক সমস্যা, (গ) শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষক উপস্থিতি, শিক্ষার মানসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদারকির জন্য বেসরকারি কলেজের মতো কোনো পরিচালনা পর্ষদ বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি, (ঘ) সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে পদায়িত শিক্ষকরা শহরে (ঢাকা অথবা কুমিল্লা) বসবাস করে প্রতিদিন কলেজে সময়মতো উপস্থিত হতে ব্যর্থতার কারণে কলেজের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও শিক্ষা কার্যক্রম বিপর্যস্ত হওয়া, (ঙ) রাজনৈতিক বিবেচনায় কলেজ দুটিকে সরকারিকরণ, (চ) উভয় কলেজের ভৌগোলিক অবস্থান, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও অবকাঠামোকে বিবেচনায় না নেওয়া এবং (ছ) প্রতিদিনের ক্লাস রুটিনে গড়ে চার-পাঁচটি ক্লাস না হওয়া এবং পদায়িত শিক্ষকরাও রীতিমতো ক্লাস না নেওয়ায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান আহরণের অনীহা সৃষ্টি ইত্যাদি। এসব কারণে সরকারি কলেজে উন্নত শিক্ষা লাভের প্রত্যাশায় যেসব কোমলমতি ও মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল তাদের শিক্ষাজীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে কোনো কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেল করায় তাদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এসব শিক্ষার্থী তাদের পরিবারে চরমভাবে অবহেলিত হচ্ছে। আর অন্যদিকে সেই ব্যর্থ শিক্ষার্থীর সতীর্থ ও শ্রেণিবন্ধু একই উপজেলার পার্শ্ববর্তী বেসরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ অথবা ‘অ’ গ্রেডে পাস করে উচ্চশিক্ষার সোপানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তার পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করছে।

উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কলেজগুলোর বেহাল অবস্থা ও ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য মূলত শিক্ষক স্বল্পতাই দায়ী। এ প্রসঙ্গে ইউনেস্কো ইএফএ গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট-২০১৩-১৪ এ শিক্ষক সংকট সমাধানের জন্য যে ১০টি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়েছে তার মধ্যে ১নং প্রস্তাবে ‘শিক্ষক ঘাটতি পূরণ’ করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ শিক্ষকদের প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সুশিক্ষা ও মানসম্পন্ন শিক্ষক’। সুশিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা এবং এমনকি সাধারণ মানের শিক্ষাদানের জন্য পাঠদানকারী শিক্ষকদের কোনো বিকল্প নেই। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা বিভিন্ন বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে তাদের সবাই মেধাবী ও মানসম্পন্ন শিক্ষক। কিন্তু তাদের যদি উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজে রাখা না যায় বা পদায়ন করা না যায় তাহলে উপজেলা পর্যায়ে উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষাদান তো দূরের কথা শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাস করার মতো শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়।

প্রতি উপজেলায় একটি কলেজ সরকারিকরণ বা একটি সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নের আগে কুমিল্লা বোর্ডের উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজ ও বিশেষ করে দাউদকান্দি উপজেলার দুটি সরকারি কলেজের বিদ্যমান পরিস্থিতি, শিক্ষার মান ও ফলাফল বিপর্যয়ের ঘটনাকে বিবেচনায় আনা আবশ্যক। এসব কলেজে প্রতিনিয়ত যে ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে তার সন্তোষজনক সমাধান মাথায় রেখে এ কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় লক্ষ্য অর্জনের পরিবর্তে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজসমূহে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সরকারি কলেজগুলোর মতোই মুখ থুবড়ে পড়বে এবং উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার মানের আরও অধঃপতন ঘটবে। উপজেলা পর্যায়ে একটি কলেজকে সরকারিকরণের আগে যেসব বিষয় সবিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে তা হলো : (১) উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কোনো বেসরকারি কলেজকে সরকারিকরণ না করে নতুন একটি সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। নতুন কলেজের মানসম্মত অবকাঠামো, শিক্ষকদের বাসস্থান, শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ও আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করা, (২) নতুন সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলে সেই উপজেলায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় অসমর্থ, ফলাফলের দিক দিয়ে সর্বনিম্ন ও দুর্বল বেসরকারি কলেজকে সরকারিকরণ করে উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণ করে সচল করা, (৩) উপজেলা পর্যায়ে নতুন সরকারি কলেজ বা সরকারিকরণকৃত কলেজের যেন সব বিষয়ে পাঠদানের জন্য সব শিক্ষক সারা বছর কলেজে থাকে, এরকম ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা, (৪) রাজনৈতিক বিবেচনায় বা ব্যক্তির ইচ্ছায় বা আবেগের বশবর্তী না হয়ে নতুন সরকারি কলেজ বা সরকারিকরণ করা, (৫) সরকারি কলেজ বা সরকারিকরণ করা কলেজের স্থান নির্বাচনকালে উপজেলা সদরকে অগ্রাধিকার প্রদান। উপজেলা সদরে সরকারি কলেজ প্রয়োজন না হলে কলেজের জন্য এমন স্থান নির্বাচন করা যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো এবং তা কোনো বড় বাজার বা গ্রোথ সেন্টারে অবস্থিত, (৬) সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা বা বেসরকারি কলেজ সরকারিকরণের ক্ষেত্রে সর্বোপরি পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও শিক্ষার পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় আনা, (৭) সরকারি কলেজের তদারকি করার জন্য বেসরকারি কলেজের গভর্নিং বডির অনুরূপ সরকারি কলেজ পরিচালনা কমিটির ব্যবস্থা করা।

প্রতি উপজেলায় একটি কলেজ সরকারিকরণ অথবা একটি নতুন সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ইতিমধ্যে উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত সরকারি কলেজগুলোর অভিজ্ঞতাকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের অগ্রিম কার্যক্রম গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষ করে শিক্ষক স্বল্পতার বিষয়টি এবং শিক্ষকদের উপজেলা পর্যায়ে রাখার যথাযথ ব্যবস্থা না করে রাজনৈতিক বিবেচনা বা ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে এ ধরনের মহৎ একটি উদ্যোগ কার্যত হিতে বিপরীত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট মহল বর্ণিত বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন বলে সবার প্রত্যাশা।

লেখক : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর