মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সন্ত্রাসবাদের কারণ রাজনৈতিক উগ্রবাদ

মইনুল হোসেন

সন্ত্রাসবাদের কারণ রাজনৈতিক উগ্রবাদ

সম্প্রতি মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই আমেরিকান কর্মকর্তা নিশা দেশাই বাংলাদেশে একটি পরিচিত নাম। সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার বিষয়াদি দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত বিসওয়াল ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। গেল সোমবার তিনি ইউএস অ্যাম্বাসেডর মার্শা বার্নিকাট, কানাডিয়ান হাইকমিশনার এবং ব্রিটিশ ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণব্যাপী একটা অভিন্ন কর্মকৌশল অবলম্বনের ব্যাপারে একমত হওয়ার প্রশ্নেও আলোচনা করেন।

আলোচনার বিষয়াদি প্রকাশ করা না হলেও আকার-ইঙ্গিত থেকে অনুমান করা যায় যে, বহুমুখী বাণিজ্যিক সম্পর্কে জড়িত বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বন্ধুভাবাপন্ন সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য একটা ইনফর্মাল কোয়ালিশন গড়ে তোলার প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা ভয় পাচ্ছি গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাস মোকাবিলায় সংকল্পবদ্ধ না করে বাইরের শক্তির সাহায্য নিয়ে সন্ত্রাস মোকাবিলায় নামলে তা হিতে বিপরীত প্রমাণিত হতে পারে। কারণ, বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর জনপ্রিয় ভিত্তি নেই এবং সে অবাধ নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। গুলশান এবং শোলাকিয়ার সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর বিসওয়ালের এ সফরকে অনেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছে এবং আশা করছে গভীর সংকটের একটা সঠিক সমাধান যদি তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়। তিনি সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে সভায় বসেছেন। তাদের সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন।

গুলশান আর্টিজান ক্যাফের সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত ২২ জনের কমপক্ষে ১৮ জন বিদেশি। এ ঘটনায় ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মলিন হয়েছে, আমাদের লজ্জায় মাথানত হয়েছে’, এটাই সব নয়। দেশি-বিদেশি সবার মনে নিরাপত্তাহীনতার বিরাট আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে বিদেশিরা আসছেন না। বড় বড় হোটেলে বিদেশিদের লাখ লাখ টাকার বুকিং বাতিল করা হয়েছে। বিদেশি অ্যাম্বাসির লোকজন অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। গার্মেন্টস সেক্টর সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। বিদেশি ক্রেতারা নতুন করে কাজ দিতে ভরসা পাচ্ছেন না। জনশক্তি রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি রক্ষা পাবে না। আমাদের সরকার জেনেশুনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের দেশের মেয়েদের পাঠাচ্ছে নির্যাতিত হওয়ার জন্য। তাদের মান-সম্ভ্রম বিক্রি করা হচ্ছে অর্থের জন্য। তাদের জন্যও দেশে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। উন্নয়ন হোক বা না হোক আমাদের বিদেশি আয় বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে।

বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হয় জনজীবনে নিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। জনজীবনে নিরাপত্তা নেই। কিন্তু দুর্নীতির নিরাপত্তার অভাব নেই। সন্ত্রাসী তত্পরতা রোধের নামে শুধু পুলিশের ওপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারাও মনে করেন তারাই পুলিশি শক্তি দিয়ে সন্ত্রাস দমন করতে পারবেন।

সন্ত্রাসী খুন-খারাবির যতই পাগলামি মনে করা হোক তারাও এক ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ। সন্ত্রাসী রাজনীতি সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কারণে। অর্থাৎ ন্যায়ভিত্তিক সুশাসনের অবর্তমানে। রাজনৈতিক নৈরাজ্য সন্ত্রাসী রাজনীতির জন্মদাতা।

সন্ত্রাসীরা আমার মতে সাহসীও নয়, সুস্থ চিন্তারও নয়— তারা মূলত চরম হতাশাগ্রস্ত উগ্রপন্থি। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। যে কোনো অজুহাতে পুলিশ সন্ত্রাস দমনের নামে নির্বিচারে গ্রেফতার করছে। তরুণরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সংকটে আছে। পুলিশ সন্দেহ করলে যে কাউকে সন্ত্রাসী অভিযোগে গ্রেফতার করছে। সন্ত্রাসী অভিযোগে গ্রেফতার হলে সে যে সন্ত্রাসী তা প্রমাণের ব্যাপারে কোনো তাড়া নেই। কোর্ট তাকে জামিন দিলে সরকারের চেলা-চামুণ্ডারা বলবেন, কোর্ট সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে জামিনে মুক্ত না পাওয়াটাই হবে তার জন্য স্বাভাবিক। তরুণ বয়সের ছেলেরা বিনা বিচারে সন্ত্রাসী হিসেবে জেল খাটতে থাকবে। সাধারণভাবেই তরুণরা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের নামে অনৈক্যের রাজনীতিকে উৎসাহ দেওয়া শান্তি-শৃঙ্খলার জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি নয়। সন্ত্রাসের কারণ সম্পর্কে আমাদের ব্যাখ্যা গ্রহণ না করা সরকারের ব্যাপার। কিন্তু সরকার যে সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ তা তো অস্বীকার করা যাবে না। দেশব্যাপী সন্ত্রাসের যে আতঙ্ক সে কথাও তো অস্বীকার করা যাবে না। পুলিশি ক্ষমতার প্রয়োগে কোনো ঘাটতি ছিল এমন তো নয়। 

মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস মোকাবিলায় যে ধরনের সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র করছে নিশা দেশাই বিসওয়াল একই ধরনের সাহায্য করার প্রস্তাব দিচ্ছেন কিনা বাংলাদেশ সরকারকে তা জানা নেই। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সুশাসন বা মানবাধিকারের প্রশ্নে কোনো বক্তব্য তিনি দেননি।

এটা বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে না যে, আমাদের দেশের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মূল কারণ রাজনীতি। সবাই স্বীকার করবেন যে, আমাদের জনগণ ধর্মীয় উগ্রবাদে বিশ্বাসী নয়। তারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে, যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা দেওয়ার কথা ভারত, আমেরিকা, জাপান ও ইতালি বলেই যাচ্ছে।

আমাদের সন্ত্রাসী তত্পরতার সঠিক কারণ কী তা না জেনে ধর্মীয় সন্ত্রাসী দমনে সহযোগিতা কোনো কাজে আসবে না। সন্ত্রাসী তত্পরতা বেড়েই চলবে। তরুণদের জন্য যে অসহায় অবস্থা করা হয়েছে তা উপলব্ধি করতে হবে। আর্টিজান ক্যাফের সন্ত্রাসী আক্রমণ এটাই পরিষ্কার করেছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও ক্ষুব্ধ। আমাদের সন্ত্রাসবাদ ধর্মীয় নয়।

আমাদের জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় যে কোনো আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে আমরা স্বাগত জানাই, তবে তার ভিত্তি হতে হবে সঠিক। সে সহযোগিতা তো জনগণের গণতান্ত্রিক সুশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে না।

বাংলাদেশের সংকটের রাজনৈতিক দিক উপেক্ষা করে বিসওয়াল মার্কিন দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলাদেশকে সন্ত্রাস মোকাবিলায় যে ধরনের সহযোগিতা দিতে চাইছে (পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবর অনুযায়ী) তাতে সন্ত্রাসের ইতি ঘটবে না।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর