মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে না

স্বপন দাশগুপ্ত

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় দেওয়ার ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গিবাদীরা বাংলাদেশের চরিত্রই পাল্টে দিতে চাচ্ছে। আমরা কি এটা মেনে নিতে পারি? গুলশান হত্যাকাণ্ডের আগেও গত দুই বছরে ব্লগার, বৌদ্ধবিহার ও খ্রিস্টান দোকানির ওপর হামলা, হিন্দু পুরোহিতকে হত্যাসহ ৫০ জনকে হত্যা করেছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় যতটা তত্পর হয়েছে, এর আগের কোনো হত্যাকাণ্ডেই এত তত্পরতা দেখা যায়নি। জঙ্গি মতবাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে দেশব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সভা-সমাবেশ ও মিছিল করতে হবে। এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, এভাবে গণজাগরণ সৃষ্টি হলেই উগ্র জঙ্গিবাদ পরাস্ত হবে। মনে রাখতে হবে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। তবে এমন ভাবে প্রচারণা চালাতে হবে যাতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ গড়ে তোলা যায়। প্রত্যেক বাঙালি তাদের স্ব স্ব ধর্ম পালন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। জবরদস্তি করে কারও ধর্মীয় আচরণ পালন করতে বাধা দেওয়া উচিত নয়। অতিসম্প্রতি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে হামলা হয়েছে। তাদের দেবতার মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এটা কারও জন্যেই কাম্য নয়। এই বাংলাদেশের জন্য কি আমরা যুদ্ধ করেছিলাম?

আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, তারা তো জীবনবাজি রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। পাক হানাদার বাহিনীকে ৯ মাসে পরাস্ত করে এ দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আকাঙ্ক্ষাগুলো বঙ্গবন্ধু সংবিধানে সন্নিবেশিত করেন। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের আর রাজনীতি করার অধিকার থাকেনি। বাংলাদেশ কাগজে কলমে সত্যি সত্যিই অসাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অকাল মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতিসহ সংবিধানের অনেক পরিবর্তন করেন। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। আর তখন থেকেই রাষ্ট্রের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগ পায়। মুসলিম লীগ, নেজামি ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজনীতি করা শুরু করে। কালের পরিক্রমায় মুসলিম লীগ, নেজামি ইসলাম ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগসহ বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। গত ৪০ বছরে এসব দলের অনেক ডালপালা গজিয়েছে।

দেশে এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। একাত্তর সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদসহ অনেকেরই বিচার শেষ হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারের পর এদের রায়ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন করার ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জেএমবি, হিযবুত তাহরির, আনসারউল্লাহ বাংলাটিমসহ কয়েকটি ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমান সরকার এসব দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও তাদের গোপন তত্পরতা অব্যাহত রয়েছে।

সাধারণত সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য। মধ্যবিত্ত সমাজ অস্থির প্রকৃতির বলে তারা সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। মূলত হতাশা থেকেই সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা কখনই সন্ত্রাসবাদের অনুকূলে নয়। ব্রিটিশ শাসনামলে গোপন সংগঠন যুগান্তর কিংবা অনুশীলন দলও সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিয়েছিল। তবে তা সফল হয়নি। পাকিস্তান আমলেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেসব চীনাপন্থি রাজনৈতিক দল তাদের গোপন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন তারাও ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতার পর সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি কিংবা জাসদের গণবাহিনীর তত্পরতা সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা করার মতো সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বাংলাদেশে নেই। তাই নতুন করে সন্ত্রাসী কিংবা আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড করে কিছু সময়ের জন্য দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা যাবে, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সন্ত্রাসবাদ কখনই জয়ী হতে পারবে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী বোমা হামলা ও সন্ত্রাস করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল এলটিটি। এখন আর এলটিটি সন্ত্রাস এর পথে নেই। ভারতেও চারু মজুমদাররা নকশালবাড়ী আন্দোলন শুরু করেছিল। ভারতে শিক্ষায় দীক্ষায় দক্ষ যুবকরা দলে দলে এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু সেই আন্দোলনও সফল হয়নি।

আমাদের দেশে ধর্মের নামে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের ছেলেরা আজ সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ৩০ বছরের নিচের তরুণরাই গুলশান ও শোলাকিয়ার মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ধর্মীয় উন্মাদনায় বিভোর হয়ে এসব তরুণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে। এর পিছনে একটি ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পাহাড় প্রমাণ জনপ্রিয়তার সময়েও শতকরা ৩০ ভাগ ভোটার বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শের বিরুদ্ধে ছিল। এরাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী গঠন করে পাক বাহিনীকে সমর্থন করেছিল। এই ৩০ ভাগ মানুষের মানসিকতা রাতারাতি তো পরিবর্তন হয়ে যাবে না। স্বাধীনতার পর এরা এদেশেই অবস্থান করেছেন। মরহুম জিয়ার শাসনামলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ নিয়ে এদের ডালপালা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব তরুণদের সবাই তো আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত পরিবার থেকে আসেনি। মধ্যবিত্তরা স্বাধীনতার পর উচ্চবিত্ত হয়েছে, কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। তরুণদের উগ্র জঙ্গিবাদী মানসিকতার পিছনে এ বিষয়টিও পর্যালোচনা করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ ও গণআন্দোলন এক নয়। এভাবে ক্ষমতার পরিবর্তনও সম্ভব নয়। নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তন কিংবা ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করলে অনেক সময় ভালো ফল বয়ে আনে না এটাও বুঝতে হবে।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে একটি প্লাটফরমে আনতে হবে। এই প্লাটফরম থেকে ইউনিয়ন, থানা ও জেলাপর্যায়ে সভা, সমাবেশ ও মিছিল করতে হবে। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগ হচ্ছে এ দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এ দলকে সংবিধানের ৪ মূলনীতি প্রতিষ্ঠা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্লাটফরম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তরের ন্যায় প্লাটফরম গড়ে তুলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তবেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি হবে। আর গণজাগরণ সৃষ্টি না হলে দেশের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই জেলা পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করছেন। ১৪ দল রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ করেছে। কিন্তু এ ধরনের সমাবেশ করতে হবে দেশব্যাপী। আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের মাঠে নামতে হবে। এ জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে প্রতিটি জেলা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করা দরকার। না হলে আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মী রাজপথে বেরিয়ে আসবে না, কারণ প্রায় আট বছর ক্ষমতাশীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আর আওয়ামী লীগ মাঠে নামলেই তার সহযোগী সংগঠন এবং ১৪ দল ও সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও মাঠে নামবে। তাহলেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণজাগরণের সৃষ্টি হবে।

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর