শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জাসদের রাজনীতি : লজিক কম, ম্যাজিক বেশি

ড. শেখ আবদুস সালাম

জাসদের রাজনীতি : লজিক কম, ম্যাজিক বেশি

কয়েক দিন আগে আমি বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ জামাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকের লেখা একটি বই পড়েছি। বইটির নাম : ‘নকশাল বাকশাল টাকশাল’। বইটির ৫৫ থেকে ৬৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত স্বাধীনতার পরপরই সে সময়ের কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একটি চমৎকার এবং বিস্তৃত বয়ান রয়েছে।  ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে যায়। এ ভাঙনের পেছনে থাকা রাজনীতিক কুশীলবরা তখন থেকেই একটি আলাদা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং তা পূর্ণতা পায় একই বছর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনের মধ্য দিয়ে। শুরু থেকেই দলটির মুখ্য স্লোগান এবং দর্শন ঘোষিত হয় ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কায়েম করা। জাসদ নিজেদের দ্রুত তখন সারা দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে এবং বেড়ে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টা চালায় এবং এক-দুই বছরের মধ্যেই একটি বড় দলে পরিণত হয়।

গত শতকের ষাট এবং সত্তর দশকে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বাংলাদেশ বর্ডার সংলগ্ন রাজ্যগুলোতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশাল আন্দোলন ব্যাপক জোরদার হয়ে ওঠে। বিশেষত, পশ্চিম বাংলায় এ আন্দোলনে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র তরুণ অংশগ্রহণ করে। ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ মাও সে তুং-এর এমন একটি তত্ত্বের প্রতি আসক্ত হয়ে তরুণেরা সেদিন ওই আন্দোলনে যোগ দিয়ে হাতে বন্দুক-রাইফেল তুলে নিয়ে নির্বিচারে তথাকথিত শ্রেণি শত্রু খতম করার নামে মানুষ হত্যাকে তাদের মূল কর্মকাণ্ড হিসেবে বেছে নেয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও তখন আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোহা এবং সিরাজ শিকদার প্রমুখের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম এবং শ্রেণি শত্রু খতম (!) এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে বহু দল, উপ-দল গড়ে ওঠে। এদের কেউ কেউ ‘চারু মজুমদারের পথ ধর-শ্রেণি শত্রু ক্ষতম কর’ এ ধরনের স্লোগানও মুখে তুলে নেয়। জাসদ শুরু থেকেই মেধা আর তারুণ্যে ভরা সমাজের একটি ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে দল গঠনে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এ ব্যাপারে শফিক সিদ্দিক তার বইয়ে বিশিষ্ট আওয়ামী রাজনীতিক ডা. মালেকের একটি পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার আর এক সহযোগী শক্তি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সশস্ত্র হওয়ার কারণে এদের ভেতর রেডিক্যাল চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। কোন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কী বাস্তব পরিস্থিতির ভিতর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে অথবা আন্তর্জাতিক চক্রের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এ অংশ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ স্লোগান দিয়ে শ্রেণি সংগ্রামের নামে তৎকালীন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ব্যাংক ডাকাতি করে, থানা লুট করে, রেললাইন উপড়ে ফেলে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ সমর্থককে হত্যা করে তারা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উত্খাত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে তারা স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের পরোক্ষ সমর্থন লাভে সমর্থ হয়।’ এ সময়ে পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যেমন : মুসলিম লীগ, জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস তারাও জাসদকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করতে থাকে, তাদের অনেকে ছদ্মবেশে এ দলে যোগদানও করে।

এভাবে জাসদ দ্রুতই সারা দেশে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠে। দলটি শুরু থেকেই সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের চরম বিরোধিতার আশ্রয় নেয়। ১৯৭৪ সাল নাগদ জাসদের সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সে বছর ১৭ মার্চ পল্টন ময়দানে তারা এক সভা ডাকে। জনসভাকে সফল করার জন্য ঢাকাসহ দেশের সবখানে তারা ব্যাপক প্রচার চালায়। ঢাকায় প্রচার মাইকিংয়ে তারা দলে দলে সেই সভায় যোগদানের জন্য জনগণকে আহ্বান জানায় এবং স্লোগান তোলে— ‘বাংলার মীরজাফর, মুজিবর মুজিবর’। শফিক সিদ্দিক তার বইয়ে লিখেছেন, যে নেতা সারাটি জীবন বাংলা ও বাঙালির স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন, ফাঁসির মঞ্চে এগিয়ে যেতেও পিছপা হন নাই, যে নেতা না হলে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতাই পেতাম না সেই নেতাকে কোনো বাঙালি ‘মীরজাফর’ বলে গালি দিতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবা যায় না; এমনকি পাকিস্তানিরাও তাকে ‘মীরজাফর’ বলে গালি দিতে পারে নাই। বাঙালিদের জন্য সবচেয়ে ঘৃণিত গালি হচ্ছে ‘মীরজাফর’, যেমনিভাবে মুসলমানের জন্য ‘কাফের’।

যা হোক ১৭ মার্চের ওই জনসভা থেকে এক পর্যায়ে জাসদ নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শহীদ মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করতে যায়। সেখানে পুলিশ এবং জাসদ উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। তখনকার জাসদের তাত্ত্বিকদের বক্তব্য উল্লেখ করে বইটিতে লেখা হয়েছে মাঝে মাঝে তারা বলত ‘শেখ মুজিব উইল বি দ্য প্রিন্স সিহানুক অব বাংলাদেশ’। কাজেই তাকে ক্ষমতা থেকে হঠানো জরুরি। এখন উনিশশ’ সত্তর কিংবা আশির দশকের রাজনীতিকদের অনেকেই বলেন, জাসদ সে সময় শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর কথা বলত। বর্তমান সরকারের খুবই উঁচু পদে কাজ করছেন বা করেছেন সে সময়ের এমন জাসদ ছাত্রলীগ নেতাদের বলতে শুনেছি— ‘শেখ মুজিব ইজ অ্যা বিট্রেয়ার, তার মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত’। যা হোক ১৯৭৪ সালে গোটা সময়টিতে সোভিয়েতবিরোধী আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল এবং দেশের অভ্যন্তরে অতি উগ্রবাদী কিছু দল, সর্বহারা পার্টি, জাসদ প্রভৃতি একযোগে সরকারের ওপর এক প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। জাসদের হঠকারী কর্মকাণ্ড এমন স্তরে পৌঁছে যে এক সময়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে পর্যন্ত ‘কিডন্যাপ’ করতে উদ্যোগ নেয় এবং এটা করতে গিয়ে সেদিন কর্নেল তাহেরের এক ভাই পর্যন্ত সেখানে প্রাণ হারান। কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসব নিয়ে চায়ের টেবিলে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপকালে একজন বলে ফেললেন— জাসদের রাজনীতি ছিল থ্রিলে ভরা, ওখানে লজিক ছিল কম। ওই বন্ধুটির সেই বক্তব্য থেকে আমি আমার এ লেখাটির শিরোনাম করেছি। উল্লেখ্য, জাসদের ওইসব কর্মকাণ্ডে সরকারও তখন মরিয়া হয়ে ওঠে। গোটা পরিস্থিতি যেন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২৫/৯/১৯৯৯ তারিখ রিয়াজউদ্দিন আহমেদ দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় লেখেন— ‘অনেকটা দিশেহারা হয়ে শেখ মুজিব ১৯৭৪ এর ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন’। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন চালু করা হয়। ২৬ তারিখ থেকে বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি জাতীয় দল বা ফ্রন্ট সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন হয়। এর মাত্র কয়েক মাস পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত হয় ইতিহাসের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। জাতির জনকের এ হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মাথায় গঠিত মোশতাক সরকারের সঙ্গে তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতাও যোগ দেন। দেশে শুরু হয় ষড়যন্ত্র ও বেইমানির রাজনীতি। একই বছর ৭ নভেম্বর এক সেনাবিদ্রোহ সংঘটিত হয় যাকে জাসদ ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করে। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের দাবিদার হন জেনারেল জিয়া এবং জাসদের গণবাহিনীর নেতা কর্নেল (অব.) তাহের। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এতে জিয়াউর রহমান জয়ী হন এবং কর্নেল তাহেরকে তিনিই ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ফাঁসিতে ঝুলান।

১৯৭৮-১৯৭৯ সালের দিকে এসে জাসদ সম্ভবত উপলব্ধি করে যে এতদিন তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল ভ্রান্ত এবং হঠকারীমূলক। বিশেষ করে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ তখন থেকে নতুনভাবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করে। হঠকারিতা থেকে তারা গণতান্ত্রিক ধারায় সম্পৃক্ত থেকে রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে চায়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো এর পরে জাসদ আর এক থাকতে পারেনি। জাসদ থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাসদ এর। এ সময়ে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেজর জলিলও একটি আলাদা দল ‘ইসলামিক মুক্তি আন্দোলন’ গঠন করেন। উল্লেখ্য, মেজর জলিলের এ দলটির আদর্শ, উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয় মূল জাসদ রাজনীতির সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান নিয়ে। অন্যদিকে এক সময়ে দাপুটে ছাত্রলীগ নেতা জাসদের সাধারণ সম্পাদক অ স ম আবদুর রবও জাসদ থেকে দলছুট কিছু ব্যক্তি নিয়ে জাসদ (রব) নামে আর একটি পৃথক দল গঠন করেন। এক পর্যায়ে তিনি দলবল নিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের সহযোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এরশাদ আমলে তারই আনুকূল্যে এক সময় তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। এরশাদ সরকারের সঙ্গে সখ্যের কারণে সে সময় তাকে মানুষ এরশাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করত। এভাবে জাসদ এক সময় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নেতা-কর্মীরা কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কেউ আবার বিভিন্ন দলে যোগ দেয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে আজও জাসদ নেতাদের ছড়াছড়ি। ঠিক এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগেই মন্ত্রী- এমপিসহ রয়েছেন ডজনখানেক নেতা। বিএনপিতে অর্ধশত এবং জাপায় সাবেক তিন মহাসচিবই ছিলেন এক সময়ের জাসদ নেতা।

মোটকথা এভাবে সেদিন হাজার হাজার তরুণ বিভ্রান্ত হয়েছিল জাসদের তথাকথিক ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-র স্লোগানে। সমাজতন্ত্র ব্যবস্থাটিই সমাজ সম্পর্কে একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। সমাজতন্ত্র সমাজের একটি উন্নত স্তর এবং বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাও। কাজেই সমাজতন্ত্রের আগে বৈজ্ঞানিক শব্দটি লাগিয়ে তারা কি বোঝাতে কিংবা কি হাসিল করতে চেয়েছিলেন তা অনেকের কাছে আজও বোধগম্য নয়। সে কারণে অনেকেই জাসদকে ‘রেড ফ্লাগ ইজ টু অপোজ দ্য রেড ফ্লাগ’ তত্ত্বের সৃষ্টি কিংবা ফসল বলে মনে করত। জাসদ নামটির ইংরেজি অনুবাদ হলো ঘধঃরড়হধষ ঝড়পরধষরংঃ চধত্ঃু. জানা যায় হিটলারের দলের নামও ছিল এমনটিই।

সন্দেহ নেই যে সেসময় দেশপ্রেমে টগবগে তরুণেরা অনেকেই রাতারাতি লেখাপড়া ছেড়ে এই দলটিতে যোগ দিয়ে অপরিণামদর্শী নেতৃত্ব আর ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে এক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে খুনখারাপি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল। তারা ঈদের জামাতে গুলি চালিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমপি-নেতাদের পর্যন্ত হত্যা করেছিল। তারা গঠন করেছিল গণবাহিনী নামে একটি বাহিনী যাদের অনেকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল অবৈধ অস্ত্র। এ বাহিনীর ওপর এক সময় জাসদের নিয়ন্ত্রণও শিথিল হয়ে পড়ে। এদের অনেকের বিচরণ ছিল অন্ধকার ঘিরে। আর এসব অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল যত্রতত্র। কর্নেল (অব.) তাহেরের মৃত্যু আর জাসদের বিভিন্ন দল-উপদলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া জাসদ রাজনীতিতে এক বিরাট হতাশার জন্ম দেয়। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো আজও তাদের পক্ষে আর আগের মতো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

তবে জাসদের মূল ধারাটি সম্ভবত আবর্তিত হতে থাকে দলটির বর্তমান সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং তার সহযোগী নেতৃত্বকে ঘিরে। এখানে একটি বিষয় বলা দরকার যে, জাসদ তার রাজনীতির পথচলায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপথগামিতার আশ্রয় (বিভ্রান্ত মেজর জলিল ঘোষিত দলটি ছাড়া) নিলেও দলের আদর্শ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা এসব স্লোগান থেকে সরে যায়নি; সেভাবে জাসদ থেকে সৃষ্ট অন্য কোনো উপদলও নয়। অন্যদিকে তারা জন্ম থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তাদের বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে বলেও আমাদের জানা নেই। জাসদ (বিশেষ করে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে) মূলত ১৯৭৯ সাল থেকে ফিরে আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত জোটের রাজনীতির ধারায়। এ সময় থেকে জোট এবং যুগপৎ আন্দোলনে থেকে জাসদ তাদের রাজনীতি অব্যাহত রেখেছে। ২০০১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের সখ্য বেড়েছে প্রচুর। এ সময় দেশে খুন, গুপ্তহত্যা যেমন বেড়ে যায় তেমনি উত্থান ঘটে ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে বিভিন্ন মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনের। সে সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে এ জন্য অনেকটা দায়ী করা হয়। তাদের জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতার বিপক্ষে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে তখন থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ও জাসদ পরিপূরক ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদ একাকার হয়ে কাজ করেছে। নির্বাচনে জাসদের প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে কিংবা আওয়ামী লীগ জাসদ প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক দিয়ে তারা একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক নৈকট্য প্রদর্শন করতেও কার্পণ্য করেনি। জাসদ এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সরকারেরই অংশ। জাসদের মূল ভ্রুণের আধার যেহেতু আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মধ্যে সে কারণেও এই ধরনের নৈকট্য তৈরি হওয়া এমনকি একই কারণে ভবিষ্যতে কখনো দল দুটি মিলিয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সেখানে রাজনৈতিক দোষারোপেরও খুব বেশি অবকাশ থাকবে বলেও মনে হয় না।

জাসদের জন্মলাভের পরে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় দল হিসেবে বাকশাল গঠন করেন তখন জাসদ তাতে শরিক হয়নি বরং প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলকে তখন তারা ‘দুঃশাসন’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের পর জিয়াউর রহমান এসে পুনরায় বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রচলন ঘটান। পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশনস (চচজ)-এর আওতায় এ সময় এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের বহুদল এমনকি জামায়াত, মুসলিম লীগ পর্যন্ত এই পিপিআরের আওতায় এদেশে রাজনীতি করা এবং দল গঠনের সুযোগ পায়। এসব দল ১৯৭৫ সালের পরে একযোগে বঙ্গবন্ধুকে এবং আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি যেসব দল স্বাধীনতার জন্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তাদের এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পরম পরীক্ষিত বন্ধু দেশ ভারত এবং রাশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়ন)-কে সত্য-মিথ্যার বাদ বিচার না করে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয় বরং রাজনৈতিক শত্রু গণ্য করে রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকে।  এ ব্যাপারে জাসদের ভূমিকাও তখন এই দলগুলো থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না বরং কখনো কখনো তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ছিল লাগামহীন এবং অধিকতর বিদ্বেষ প্রসূত।

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

ই-মেইল: [email protected]

সর্বশেষ খবর