রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

গুলশান হত্যাকাণ্ড : পাপ, অন্যায় নাকি অপরাধ?

তুষার কণা খোন্দকার

গুলশান হত্যাকাণ্ড : পাপ, অন্যায় নাকি অপরাধ?

ইংরেজি টেরোরিজম শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সন্ত্রাসবাদ। হিন্দি ভাষায় টেরোরিজমকে বলে আতঙ্কবাদ। আমার মনে হয় টেরোরিজমের প্রতিশব্দ আতঙ্কবাদ শব্দটি মানুষের সত্যিকার অনুভূতিকে চাক্ষুষ করে তুলতে পারে। আতঙ্কবাদ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের গভীরে আমরা ভয়ের গুড়গুড় আওয়াজ শুনতে পাই। কয়েকদিন আগে শোলাকিয়া ঈদের জামাতে ভয়ঙ্কর আক্রমণ হতে চলেছিল। পুলিশের বাধার মুখে কয়েকজনের প্রাণনাশের মধ্যদিয়ে আক্রমণকারীদের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছে। শোলাকিয়ায় হামলার বিষয়ে গণমাধ্যম বলেছে, শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমামকে হত্যার লক্ষ্য নিয়ে সেখানে হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ধর্ম পেশাজীবী মানুষের মধ্যে অন্য পেশাজীবীদের মতো পেশাগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকতে পারে। অতীতে এই ধরনের দ্বন্দ্বকে ঘিরে বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের নজির বাংলাদেশে আছে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে কেউ হিংস্র হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাউকে হত্যা করে ফেললে আমরা দুঃখ পাই, হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণা বোধ করি। কিন্তু তাই বলে তাতে আতঙ্কিত বোধ করি না। ব্যক্তিগত হিংসা-প্রতিহিংসা থেকে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটে সেগুলোকে মানুষ ব্যক্তির সীমায় বিচার করে এবং ঘটনা নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে তাদের দুঃখ ঘৃণা প্রকাশ করে। এই ধরনের হিংস্র ঘটনার খবর পেলে মানুষ দুঃখ পায় কিংবা ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিকার দাবি করে কিন্তু নিজের কিংবা আত্মীয়-পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত বোধ করে না। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের জিঘাংসাপূর্ণ হত্যাকাণ্ড দেখে মানুষের মনের অবস্থা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সীমায় বাঁধা নেই বরং দেশবাসীর মনের মধ্যে নির্জলা আতঙ্ক ভর করেছে। আতঙ্কের কারণ, ভয়ঙ্কর খুনে স্বভাবের মানুষগুলো কেন নিরীহ ২২ জনকে পৈশাচিক বর্বরতায় হত্যা করল তার কারণ আমরা জানি না। আমরা আতঙ্কিত কারণ কয়েকটি অল্প বয়সী ছেলে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ডিনার খেতে আসা দেশি-বিদেশি নিরীহ মানুষগুলোকে ঠাণ্ডা মাথায় কুপিয়ে-খুঁচিয়ে ভয়ঙ্কর উপায়ে খুন করেছে। খুন করার আগে খুনিরা নিরীহ মানুষগুলোকে জিম্মি করে বিশেষ কোনো দাবি-দাওয়া পেশ করলে আমরা তাদের ক্ষোভের কারণ জানতে পারতাম। কিন্তু তেমন কোনো দাবি-দাওয়ার কথা গণমাধ্যমে আসেনি যা থেকে আমরা খুনিদের মতলব সম্পর্কে কোনো ধারণা পেতে পারি। যে খুনিরা এমন ভয়ঙ্কর কাজ করেছে তাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি মানুষগুলোর ব্যক্তিগত শত্রুতা দূরে থাক ব্যক্তিগত পরিচয়টুকুও ছিল না। তবুও তারা নিষ্ঠুরভাবে এই মানুষগুলোকে কেন মারল সেটা আমরা অনুমান পর্যন্ত করতে পারছি না। নিষ্ঠুর বিকৃত স্বভাবের হত্যাকারী তরুণেরা দেশি-বিদেশি মানুষকে জিম্মি করে কার কাছে কী চেয়েছিল সেটাও আমাদের অজানা। ইতিহাসের পাতা উল্টালে অনেক রকমের জিম্মি কাহিনী পাওয়া যায়। সে সব ঘটনা বিস্তারিত পড়লে জানা যায় কে, কাকে, কেন জিম্মি করেছিল কিংবা তারা কার কাছে কী দাবি করেছিল।

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে কিছু মানুষকে জিম্মি করা হলো, তাদের কুপিয়ে-খুঁচিয়ে বীভৎস আনন্দে হত্যা করা হলো— এ পর্যন্ত আমরা জানি। কিন্তু কেন মানুষগুলোকে জিম্মি করা হয়েছিল সেটা আমরা কেউ জানি না। হত্যাকারীরা মানুষগুলোকে জিম্মি করে কারও কাছে কি কোনো দাবি পেশ করেছিল যা না পেয়ে তারা এমন হিংস্র আচরণ করল? কে জানে এসব প্রশ্নের জবাব কার কাছে আছে।

হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের টাটকা স্মৃতি আমাদের দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফিরছে। এই নারকীয় ঘটনা আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যার জবাব না পেয়ে আমরা আতঙ্কে ভুগছি। আতঙ্কের সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর বিস্ময় আমাদের ক্রমাগত গ্রাস করছে। আমরা ভেবে ঠাহর করতে পারছি না, যারা এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড চালাল তারা সবাই বাঙালি এবং কম বয়সী তরুণ। হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে একজন-দুজন মানুষকে খুন করার পরে যদি খুনিরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করত কিংবা স্নায়ু চাপে ভুগে স্রেফ অস্ত্র হাতে রক্তের দিকে তাকিয়ে ভীত চোখে বসে থাকত তাহলে আমি এত আতঙ্কিত হতাম না। খুনিরা স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধির সামান্য পরিচয় না দিয়ে অস্বাভাবিক বিকৃতির সঙ্গে ক্রমাগত হত্যা চালিয়ে গেছে। খুনিরা ২২ জন মানুষকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করে রক্তাক্ত মেঝেতে বসে সাহরি খেয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এরপরও সাধারণ বোধ-বুদ্ধির মানুষ আতঙ্কিত না হয়ে থাকতে পারে! 

হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একাত্তর সালের পাকিস্তান বাহিনীর সৈন্যদের এবং তাদের সহযোগী রাজাকার আলবদরদের নৃশংসতার মিল আছে। পাকিস্তান বাহিনী এবং রাজাকার-আলবদররা বাঙালি জাতিকে জিম্মি করে আমাদের কাছে কী চেয়েছিল সেটি আমরা জানতাম। একাত্তর সালে সমাজচিত্র অনেক স্বচ্ছ ছিল। রাজনীতির পানি এমন ঘোলা ছিল না। একাত্তর সালে শত্রু-মিত্র চিনতে কোনো বাঙালিকে বেগ পেতে হয়নি। সব প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা ছিল বলে আমরা স্বচ্ছন্দে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম এবং অস্ত্র হাতে খুব সোজা সাপটা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। একাত্তর সালে বাঙালি এবং পাকিস্তানি দুই পক্ষের স্লোগানও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাকিস্তানি সৈন্যরা যেখানে সেখানে মানুষকে জড় করে বলত, তোমরা গাদ্দার বাঙালি জাত অনেকদিন ধরে বহুত বেত্তমিজি করেছ। তোমরা বাঙালিরা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য লম্বা লম্বা মিছিল করে গলা ফুলিয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার করেছ। জয় বাংলার দিন শেষ, এবার ইসলামের তরক্কি। কাজেই এবার গলার রগ ফুলিয়ে নাড়া লাগাও। জনতা মনে মনে নিশ্চয়ই জয় বাংলা বলত। মনে মনে জয় বাংলা না বললে বাংলাদেশের জন্ম হলো কী করে। তবে সেই মুহূর্তে মুখে নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে জালেমদের হাত থেকে জান বাঁচানোর চেষ্টা করত। নারায়ে তকবির বলেও যে সবার জান বাঁচত তা নয়।

একাত্তর সালে বাঙালির বাঁচা-মরা পাকিস্তানি সৈন্য কিংবা রাজাকার আলবদরদের খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করত। আমাদের বাঁচা-মরার সিদ্ধান্ত রাজাকার আলবদরদের খেয়াল খুশির ওপর দোল খেলেও জয় বাংলা নিয়ে আমাদের মনে সন্দেহের দোলাচল ছিল না। আমরা জানতাম, আমরা জয় বাংলার পক্ষে আছি, থাকব এবং এই যুদ্ধে আমরা জিতব। নয় মাসের যুদ্ধে আমরা জিতেছিলাম। কিন্তু বাঙালির কী দুর্ভাগ্য! পঁয়তাল্লিশ বছর পরে পুরনো বীভৎস লড়াই আমাদের জীবনে ফিরে এলো। শুধু ফিরে এলো বললে অল্প বলা হয়। পুরনো লড়াই এমন ভয়ানক অস্বচ্ছ অন্ধকার রূপ নিয়ে ফিরে এলো যে, এবার আমরা শত্রু-মিত্র চিনতে হিমশিম খাচ্ছি। এখন রাজনীতির আঙিনায় কে যে নাড়া লাগায় আর কে জয় বাংলা বলে সেটাও তো ঠিক বুঝতে পারি না।

প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেন, জঙ্গিরা কেমন মুসলমান তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি জঙ্গিদের ধর্মবোধ বুঝতে পারেন না কারণ মসজিদে আজান দেওয়ার পরে জঙ্গিরা মসজিদে নামাজ পড়তে না গিয়ে অস্ত্র হাতে মানুষ খুন করতে যায়। প্রধানমন্ত্রীর এই কথার বিপরীতে খুনিরা কী যুক্তি দেখাতে পারে সেটি তারাই ভালো বলতে পারবে। তারা কেমন মুসলমান সেটি তারা ব্যাখ্যা করতে পারবে। মানুষ খুন করার পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়ে তারা বলতে পারে তারা ভালো মুসলমান। ধর্মের বিধান অনুযায়ী সে সব যুক্তি-পাল্টা যুক্তি নিয়ে আগামী বছরগুলোতে চমৎকার বাহাস চলতে পারে। সেটি একান্তই তাদের বিষয় যারা এমন বাহাসের মধ্যদিয়ে নিজেদের মতলব পুরা করতে পারবেন। কিন্তু আমরা জানি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটি, মানুষ এবং বুদ্ধির মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে আমরা লড়াই করেছি এবং ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন করে সব বাহাসের ইতি টেনেছি। ২০১৬ সালে আমরা পুরনো বাহাস নতুন করে কেন শুরু করব। আমরা চাই ধর্মনিরপেক্ষ আইনে দেশ চলবে যেটি ১৯৭১ সালে নির্ধারিত হয়ে গেছে। ফৌজদারি আইনে যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করবে তারা আইনের আওতায় শাস্তি ভোগ করবে। কে কোন মতবাদে বিশ্বাস স্থাপন করে নরহত্যা করেছে, সেই মতবাদ ভ্রান্ত নাকি অভ্রান্ত সেটি দেখার সাধ সাধারণ মানুষ একাত্তর সালেই মিটিয়ে ফেলেছে। এখন রাজনীতিবিদরা নতুন করে সেই ফ্যাকড়া তুলে আমাদের জীবনে অশান্তি নামিয়ে আনবেন না বলেই আমরা আশা করি। সাধারণ মানুষ সমাজে শান্তি চায় যাতে তাদের জীবন-জীবিকা নির্ঝঞ্ঝাট থাকে। রাষ্ট্রের কাছে ন্যায়বিচার চায় যাতে দুর্বৃত্তরা জনজীবনে বার বার হানা দিতে না পারে।

সাধারণ মানুষ বাংলা তিনটি শব্দের মানে স্পষ্ট করে জানে। এক. ‘অন্যায়’ যা সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর একটি শব্দ ‘পাপ’, যেটি নির্ধারণের মানদণ্ড ধর্মীয় বিধান। জনজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শব্দ অপরাধ যেটি রাষ্ট্রের আইনে শাস্তিযোগ্য একটি কাজ। সরকার এবং আদালতের কাছে আমরা অপরাধের বিচার চাই। অন্যায় কিংবা পাপের সংজ্ঞা নির্ধারণের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে আমরা অপরাধীকে দায়মুক্তি দিতে নারাজ। সরকার ধর্ম-অধর্মের বাহাসে না জড়িয়ে আমাদের নির্জলা শান্তি উপহার দিলে আমরা কৃতজ্ঞ হব।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর