বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

পশুত্বের দাসত্ব মানা যাবে না

ডা. এম এ হাসান

পশুত্বের দাসত্ব মানা যাবে না

বর্তমান সময়টায় সারা বিশ্ব যেন সন্ত্রাসের অগ্নিমুখে নিপতিত হয়ে আছে। এর প্রধান কারণ যেমন বৈশ্বিক নষ্ট রাজনীতি, তেমনি দেশ ও সমাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন ভারসাম্যহীনতা এবং রিয়াকটিভ অসহিষ্ণুতা। স্পষ্ট-অস্পষ্ট সংঘাত, ক্ষোভ, ক্রোধ, হতাশা এবং অমোচনীয় দ্বন্দ্বের ওপর বসে আছে সারা বিশ্ব। ওপর থেকে জল সিঞ্চন করে এই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ শান্ত ও নিস্তব্ধ করার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এই কারণে প্রতিটি দেশে জনগণের জীবনে ন্যায়, সাম্য, শান্তি ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে পৃথিবীর কোথাও নিরবচ্ছিন্ন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সন্ত্রাস নির্মূল অতি দূরের কথা।

পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো যতক্ষণ না পরদেশ ও পরসম্পদ লুণ্ঠন থেকে হাত না গুটাচ্ছে, যুদ্ধ ও সংঘাতের ইতি না টানছে, ভিনদেশিদের অধিকার ও জীবনের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করছে, ততক্ষণ নানা ক্রোধান্বিত শক্তির সহিংস উত্থান থামিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

বৈশ্বিক নানা সংঘাত তথা সমষ্টির মনোজাগতিক বিপর্যয়ের কারণে বিচ্ছিন্ন ও বিধ্বস্ত মানুষের মন ও আত্মপরিচয়কে যতক্ষণ না কাছের এক জীবিত মানুষের শরীরের মতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ বুনট হিসেবে কল্পনা করা না যাচ্ছে ততক্ষণ প্রতিটি সমাজ ও রাষ্ট্র অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণ ও আঘাতের মুখেই থেকে যাচ্ছে। এতে করে বিপন্ন হচ্ছে সাধারণের জীবন ও বিত্ত। অর্থাৎ শেষ বিচারে মূল্যটা দিচ্ছে বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

সংঘাত ও দুর্দশা নিরসনের নামে আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক সংঘাত আরও উসকিয়ে দিচ্ছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ঘৃণাভিত্তিক দর্শন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ফায়দালোভী গোষ্ঠীর নষ্ট দর্শন তথা ঘৃণ্য রাজনীতি এবং শক্তিধরদের কূটকৌশলের কারণে দেশে দেশে যে ত্রুটিপূর্ণ রাজনীতি ও সমাজ ভাবনার উদ্ভব হচ্ছে তা সারা বিশ্বের মানুষকে এক ধরনের জীবন সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। এই সংকট শুধু প্রাণের সংকট নয়— এ সংকট শরীর, মন, আত্মা ও অস্তিত্বের। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যে দর্শন ও দিকনির্দেশনার প্রয়োজন তা খুঁজে নিতে হবে সাধারণ মানুষকেই। সাধারণের মধ্যে নিবিড় ঐক্য, ভালোবাসাসিক্ত সমঝোতা, ইন্টিগ্রেশন এবং সময়োপযোগী জ্ঞানই ভাঙতে পারে ফায়দালোভী নষ্ট শক্তির অপকৌশল।

এ কারণে ঐক্য হতে হবে সাধারণের সঙ্গে সাধারণের, মানুষের সঙ্গে মানুষের। দূরে ঠেলে দিতে হবে ক্ষমতালোভী দল, তথা ফায়দালোভী গোষ্ঠীকে। এই ঐক্য নির্মাণ বাস্তবায়ন করতে পারে বিশ্বের নানা কোণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মেধাবী মানুষগুলো। তাদের মেলবন্ধন নিশ্চিত করতে পারে সাধারণ তথা তরুণ থেকে উঠে আসা শুভশক্তি। সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাসের সব শক্তি ও শিকড় ছিন্ন করতে হবে, তাদের নষ্ট পরিচয় স্পষ্ট করতে হবে প্রতিটি হৃদয়ে। পাশ্চাত্য বিশ্বকে আস্থা ও বিশ্বাসে আপন করতে হবে ইসলাম বিশ্বাসী শুভশক্তিকে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে সব মানুষের ঐক্য এবং Commonality-কে। 

ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা ছাড়া যে শান্তি ও সমঝোতা নির্মাণ সম্ভব নয়, সেটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আলোচনা হওয়া উচিত। পারিবারিক তথা সামাজিক ইন্টেগ্রেশন এবং সহমর্মিতা ছাড়া ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতা রোধ করা সম্ভব নয়, ভারসাম্যহীন চিন্তানির্ভর নষ্ট পরিচয় নির্মাণ রোধ সম্ভব নয়— তা পৃথিবীর সবাইকে বুঝতে হবে। একই সঙ্গে বোঝা ও বোধের প্রকাশটিকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনতে হবে। অর্থাৎ প্রায়োগিক চিন্তার প্রয়োগটি বাস্তবায়ন করতে হবে। ধর্মচিন্তার সঙ্গে যুক্তিনির্ভর বোধ এবং মানবতাকে সমন্বিত করতে হবে এখনই।

ভিনদেশি, ভিনধর্মী, ভিন্ন পরিচয়ের মানুষটিকে আপন করতে না পারলে, সমাজের শরীরে তাদের মিশিয়ে নিতে না পারলে যে ক্ষত তৈরি হচ্ছে তা সমষ্টির বিনাশ টেনে নিয়ে আসছে তা সবাইকে বুঝতে হবে। ভূরাজনীতিতে শঠতা ও ডবল স্ট্যান্ডার্ড প্রয়োগ তথা শক্তি প্রদর্শনের দিন যে ফুরিয়ে আসছে তা শক্তিধরদের বুঝতে হবে। রক্ত ঝরিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা মত প্রতিষ্ঠা যে কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয় তা সবাইকে বুঝতে হবে। 

বৈশ্বিক সংঘাত নিরসনে পাশ্চাত্য বিশ্ব যা কিছু করছে এবং বলছে তা যে শান্তির সমার্থক নয়, বিবেক, বিবেচনা ও বোধের কথা নয়— এই বাস্তবতা অনুভবের মধ্যদিয়েই নানা দেশ ও সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা খুঁজতে হবে। আরব ও আফ্রিকার মাটিতে নবউপনিবেশ থেকে হাত না গুটালে, অভিবাসীদের অন্তরের ব্যথা না ঘুচালে, সামাজিক ইন্টেগ্রিশনের পথ ব্যাপকভাবে না খুলে দিলে, ব্যক্তির মনোজাগতিক শূন্যতাকে আমলে না নিলে পৃথিবীর সব স্থানে সাধারণের জীবনে নিরাপত্তা তথা শান্তি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যাবে। ইউরোপের নানা দেশে, বিশেষ করে যে সব দেশে অভিবাসী রয়েছে তাদের সমাজে অমোচনীয় দ্বন্দ্ব নিরসন না করলে সন্ত্রাসের কাছে পরাভূত হবে শক্তিধরদের শক্তির অহংকার। ইসরায়েলের মতো একটি পশ্চাৎমুখী ধর্মনির্ভর দেশের রাজনীতি তথা কূটকৌশলের কাছে পরাভূত হচ্ছে বাস্তিল দুর্গজয়ী মানুষগুলো। ব্যক্তি সন্ত্রাস তথা ভারসাম্যহীন চিন্তা-চেতনা গ্রাস করেছে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মুক্তজীবন এবং স্বপ্ন। রক্তাক্ত ও বিধ্বস্ত আজ নিস, মিউনিখ, আনবাক ও টোকিও।  

যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষের ক্রোধ মসিলিপ্ত করছে আব্রাহাম লিংকনের সাহসী উচ্চরণকে। বিদ্বেষ ও বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ কালো মানুষগুলো আমেরিকার অপ্রকাশিত চিত্র ও চরিত্রটি নতুন করে প্রকাশ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হবে যে, গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের গণতন্ত্রের কাঠামোটি ভিতরে ভিতরে ফাঁকা হয়ে গেছে— রপ্তানি করতে গিয়ে এটি অন্তঃসারশূন্য হয়ে গেছে। এখন তাদের কাজ করতে হবে অর্থবহ বৈশ্বিক শান্তি ও সামাজিক গণতন্ত্রের জন্য। শান্তির অন্বেষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঢেলে সাজাতে হবে তাদের জনপ্রশাসন, পররাষ্ট্রনীতি ও সমরনীতি। যুদ্ধ দিয়ে দেশ জয় যে সেকেলে হয়ে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কাউন্টার প্রোডাকটিভ হয়ে গেছে তা তাদের ও তাদের সহযোগীদের বুঝতে হবে। বিশ্বের কাণ্ডারি হিসেবে পরিচিত সেরা শক্তিশালী ও সম্পদশালী দেশটি প্রকৃত ন্যায়, সত্য ও শান্তির পক্ষে না দাঁড়ালে শান্তি অধরা থেকে যাবে। ক্ষুদ্রাস্ত্র ও বিস্ফোরক উত্পাদন ও প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এবং সমঝোতা ছাড়া হত্যা-সংস্কৃতি বন্ধ করা যাবে না।  

ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তারা যে মধ্যপ্রাচ্যকে পশ্চাৎমুখী চিন্তা-চেতনা ও সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়েছে তা তাদের বুঝতে হবে এবং কৃত ভুল স্বীকার করতে হবে। ইরাক যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ এবং লিবিয়া ও সিরিয়ার সংঘাত যে সারা বিশ্বকে জ্বলন্ত আগুনের মুখে নিক্ষেপ করেছে তার প্রধান দায় তাদেরই নিতে হবে। বিশ্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে হলে এই দায় স্বীকারের মধ্যদিয়ে নষ্ট ভূরাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এবং মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো বিশ্ব নেতাদের জোড় গলায় আওয়াজ তুললেই হবে না, তাদের দৃশ্যমান কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব সন্ত্রাস নির্মূলের কাজটি শুরুটা হবে এখান থেকে। ধর্মনির্ভর দল ও গোষ্ঠীকে যারা সমর্থন দেবে, যুদ্ধের মধ্যদিয়ে দ্বন্দ্ব নিরসনে যারা চেষ্টা করবে বা পররাজ্যে আগ্রাসন করবে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে আইনানুগ প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং অহিংস আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসরোধে উদ্যোগী হতে হবে প্রতিটি রাষ্ট্রকে। সাধারণের জীবন রক্ষা, শান্তি রক্ষা যে কোনো রাষ্ট্র ও সংঘের প্রধান দায়িত্ব। কেবল ব্যর্থ রাষ্ট্রই এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে থাকে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অর্থপ্রবাহ এবং তথ্যপ্রবাহ বন্ধে প্রযুক্তিভিত্তিক নানা দুয়ার (Gate) প্রচলনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে সারা বিশ্বকে।

এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এবং তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে জোটবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ জোট থেকে এবং এককভাবে প্রত্যেক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা প্রয়োজন যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে এবং নষ্ট ভূরাজনীতির কারণেই মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং জীবন ও সম্পদের বিনাস হচ্ছে। এতে মানবতার যে মৃত্যু হচ্ছে তার করুণ চিত্র নতুন প্রজন্মের মনে এমন ক্ষোভ ও বেদনা তৈরি করছে যা নব নব সন্ত্রাস সৃষ্টিতে নবতর জ্বালানি সরবরাহ করছে। এতে তৃতীয় বিশ্বের তরুণ সম্প্রদায়ের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। ডিজঅরগানইজড (Disorganized) চিন্তা ও চেতনা তাদের আচ্ছন্ন করছে— কেউ কেউ হয়ে উঠেছে Psychopath— এদের কেউ কেউ ধর্মান্ধগোষ্ঠী বা নষ্টশক্তির নষ্ট চিন্তায় দীক্ষিত হচ্ছে। এর দায় ও দোষ কেবল ধর্মান্ধগোষ্ঠীর নয়, যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীরও।

সন্ত্রাস রুখতে গিয়ে পাশ্চত্য বিশ্বে যে প্রক্রিয়ায় অভিবাসীদের জীবনে পরিবর্তন আনছে অথবা তৃতীয় বিশ্বেকে শৃঙ্খলিত করতে চাচ্ছে তা তাদের আত্মঘাতী জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মনে করছে তাদের কাছে সন্ত্রাস দমনে প্রযোজ্য এমন জ্ঞান ও কৌশল রয়েছে, এমন মূল্যবোধ রয়েছে যা হতে পারে তাদের জীবনের বর্ম।

বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এটি সত্য থেকে যে কতটা দূরে তা তাদের ধারণায় নেই, অথবা তারা ইচ্ছে করেই সত্য বিস্মৃত হচ্ছে।

বোধের উন্মেষ ঘটাতে চিলকটের জন্য ১৩ বছর সময় লেগেছে, হয়তো তা প্রয়োগিক পর্যায় যেতে আরও ১৩ বছর সময় লাগবে। এর ক্ষতিপূরণটা কীভাবে হবে তা ভাবনার বিষয়। এ সময়টায় সারা বিশ্বে প্রতিবাদী তরুণ সম্প্রদায় কতটা বেপথু হবে তা হিসাব করা কঠিন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ তরুণদের অধিকাংশ মুসলিম— এটিই আমাদের চরম লজ্জা। এতে আমাদের যে ক্ষয় হচ্ছে, সম্মানহানি হচ্ছে তা আমাদের সাধারণ শত্রু তথা বৈশ্বিক অসুরদের চাওয়া। এ সময় তৃতীয় বিশ্বের কাণ্ডারিদের বলতে হবে— ‘enough is enough, জনগণের অধিকার আদায় এবং গণতন্ত্রের নামে আপনারা যা করেছেন তা অনেক হয়েছে, এবার আপনারা প্রকৃত শান্তির জন্য কাজ করুণ; আমরা আমাদের জনগণকে ধর্মান্ধ তথা নষ্টচিন্তা থেকে সরিয়ে এনে সঠিক আত্মপরিচয় নির্মাণে মনোযোগী হচ্ছি।’

সংঘাত নয়, আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহমত সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তির পক্ষে ইতি টানতে হবে সব সংঘাতের। আঞ্চলিক শান্তির জন্য ক্ষমতা ও অধিকারের বণ্টনটি জরুরি। এ আলোকে বিভাজন রেখা টানতে হবে শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের আবাসভূমিতে।

সন্ত্রাসরোধে শিশু ও তরুণদের চিত্তে সন্ত্রাস ও সংঘাতের বীজ বুনে দেওয়া বন্ধ করতে হবে নানামুখী কর্মকাণ্ডের দিয়ে। এ লক্ষ্যে আইটিনির্ভর খেলা থেকে শুরু করে খেলার উপকরণ, বিনোদনের মাধ্যম ও শিক্ষায় বহুমুখী পরিবর্তন আনতে হবে। নানা ধর্ম, বর্ণ ও জাতির মধ্যে সাধারণ ঐক্যের বিষয় স্পষ্ট করে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষা কার্যক্রমে। এসব বিষয়ে জাতিসংঘ এবং ইউনেস্কোর একটা ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। 

অস্ত্র, যুদ্ধ ও সংঘাতনির্ভর সংস্কৃতিকে নির্বাসন দিতে হবে এখনই। ক্রোধের সীমারেখা টানতে হবে বোধের প্রয়োগের মাধ্যমে। পশুসুলভ ক্রোধ ও ঘৃণাকে কবর দিতে হবে অপার ভালোবাসার নিচে। শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর নানা গুণকে সামনে এনে ধী, মনন ও মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ আত্মপরিচয় নির্মাণ করতে হবে। Code of Conduct-এর একটি পাঠ চালু করা প্রয়োজন। সকল মানের শিক্ষালয়ে মূল্যবোধ এবং আত্মপরিচয় নির্মাণে শিক্ষামূলক সেমিনার চালু করতে হবে। সমাজের নানা স্তরে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন এবং সুশাসনটি আলোচনায় আনতে হবে।

সত্যিকার সভ্যতা ও নম্রতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শান্তিকে উন্নয়নের প্রধান সূচক হিসেবে দেখতে হবে। সামাজিক শান্তির জন্য যেমন উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি উন্নয়নের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার বলয়টি অতি আবশ্যক, তা কখনই ভোলা যাবে না। এ লক্ষ্যে, জননিরাপত্তা বিধানে আশু, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।   

সবাইকে বুঝতে হবে যে তার মূল পরিচয় মানবতানির্ভর— সেটাই তার শরীর ও আত্মার কাঠামো নির্মাণ করছে। মনুষ্য পরিচয় তার অস্তিত্বের সবটুকুজুড়ে— ধর্ম তার বিশ্বাস। তার জীবনের সেতু ও আত্মপরিচয়ের শিকড়টি ধরে আছে ভিন্ন একটি মানুষ। ‘তুমি আছো তাই আছি আমি’— এই বোধ থেকে এক সময় আমি লিখেছিলাম— Personal being exists and assume existence only with relation to external existence. The existence not only means to see and feel oneself from within. It means to reach oneself from beyond and reach beyond by asserting all images within and beyond.

অপরের অস্তিত্ব, অধিকার ও মর্যাদার প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল নয়— সে তো মানুষ নয়। ভিন্ন মত, ভিন্ন পথে চলা, ভিনদেশি মানুষের প্রতি অসহনশীল মানুষগুলোকে সভ্য পৃথিবীর মানুষ বা সমগোত্রীয় জীব হিসেবে কল্পনা করা কঠিন। যে ধর্ম বা বিশ্বাস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাস ও ঘৃণাকে সমর্থন করে তাকে পরিত্যাজ্য মনে করে ধর্মের ভালো দিকগুলো নিয়ে যুক্তি ও নৈতিকতানির্ভর বিশ্বাসের ভূমি ও আচরণবিধি নির্মাণ করা উচিত। এসব কাজ কেবল ধর্ম নেতা ও রাজনীতিবিদদের নয়। এ কাজ করতে হবে সমাজবিজ্ঞানী, সমাজ সংস্কারক ও অন্য বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করে।

যে ধর্ম, বিশ্বাস, জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে প্রতিপক্ষ মনে করে তা বর্জ্যতুল্য। পশুত্বের দাসত্ব মানা যাবে না কোনোভাবে। শক্তিধরদের অপকর্ম রুখতে হলে শক্তিধর হওয়া প্রয়োজন, এ কারণে জ্ঞানে ও সম্পদে শ্রেষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন, তবে তা মননে ও জ্ঞানে। এ কারণে তরুণদের মনোযোগী হতে হবে বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশে। আবার বিপথগামীকেও রুখতে হবে বুদ্ধিভিত্তিক নানা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। ঘৃণা, ভেদবুদ্ধি এবং নষ্ট শক্তির আঘাতগুলো রুখে দেওয়ার কৌশল শেখাতে হবে আমাদের তরুণদের। ভালো কাজের দৃষ্টান্তগুলো সামনে এনে সামাজিক উন্নয়ন তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে তাদের Engagement প্রয়োজন। এ কাজটি করতে হবে স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।

ভারসাম্যহীন চিন্তা-চেতনার বিকাশ এবং সন্ত্রাসের প্রকাশ রুখতে হলে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ঐক্য ও সমঝোতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে রুখতে হবে সমাজে নষ্ট চিন্তার অনুপ্রবেশ। রাজনৈতিক অভিসন্ধি এবং কূটকৌশল ছেড়ে সাধারণের মনোজগতে ভালো মানুষের ছবি ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে হবে। জ্ঞানী সোলায়মান, সিরাক, গৌতম বুদ্ধ, হজরত মুসা, যিশু এবং নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের ছবি ও কথাগুলোকে মোটা দাগে লিখতে হবে একক পত্রে। এসব মহামানবের অনুসারীদের বুঝতে হবে যে এমন কাজ করা যাবে না যা তাদের পথ প্রদর্শকদের অবনমিত করে। এক্ষণে সুস্থ প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত শুভ কর্মের, বুদ্ধিভিত্তিক সৃষ্টিশীল কর্মের— প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত সুরুচি প্রকাশের এবং ভালোবাসার। অহিংসা ও ভালোবাসার মাধ্যমেই নিশ্চিত হতে পারে বিশ্ব বিজয়। এ কাজটি করতে হবে Tolstoyan Thoroughness -এর মাধ্যমে। 

 লেখক : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি।

 Email: [email protected]

 

সর্বশেষ খবর