শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

আল্লাহর পৃথিবীকে সবুজ রাখা আমাদের দায়িত্ব

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আল্লাহর পৃথিবীকে সবুজ রাখা আমাদের দায়িত্ব

বৃক্ষ-লতাপাতা আর সবুজ-শ্যামল ভূমিময় হচ্ছে বেহেশত। আমরা কি পারি না আমাদের দেশটাকে সবুজ-শ্যামল করে গড়ে তুলতে। গাছ প্রকৃতির অপূর্ব শোভা। গাছহীন পৃথিবী মলিন। গাছ মানবসহ তাবৎ প্রাণিকুলের বন্ধু। গাছের অস্তিত্ব মানে প্রাণের অস্তিত্ব, প্রাণীর অস্তিত্ব। যে অঞ্চলে যত গাছপালা, সেই অঞ্চল তত বেশি প্রাণবন্ত। গাছ ধৈর্যের প্রতীক, ধীরস্থির সাধনার প্রতীক, জীবনের সার্থকতার প্রতীক। অঙ্গার বাতাসে মিশে থাকে, গাছ তা নিগূঢ় শক্তিবলে শোষণ করে নিজের করে নেয়। গাছপালা মানব জীবনবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু। বরেণ্য সাহিত্যিক আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘এই পুষ্প, এই বৃক্ষ, তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, আমার মধ্যে কোনো একাকিত্ব, কোনো বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করতে পারিনে।’ গাছ ছাড়া বেঁচে থাকার উপায় নেই। গাছ থেকে পাওয়া অক্সিজেন আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। গাছ প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতীক। ঝুঁকিহীন এক নিরাপদ বিনিয়োগ গাছ। সবুজ-শ্যামল নিসর্গ মূলত গাছকেই ঘিরে। গাছ আমাদের জীবনের ছায়া। তাই ‘গাছ লাগানো’কে ধর্ম উত্তম ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। হাদিসের পরিভাষায় যাকে সদকায়ে জারিয়া নামকরণ করা হয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলমান একটি ফলবান বৃক্ষের চারা রোপণ করে, আর এতে ফল আসার পর সে নিজে অথবা অন্য কোনো মানুষ তা থেকে যা ভক্ষণ করে তা তার জন্য সদকা (দানস্বরূপ), যা চুরি হয়, যা কিছু গৃহপালিত পশু এবং অন্যান্য পাখপাখালি খাবে, এসবই তার জন্য সদকা।’ (বুখারি ও মুসলিম)। গাছ লাগানোর গুরুত্ব সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘তুমি যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পার যে, কেয়ামত এসে গেছে, আর তোমার হাতে একটি গাছের চারা আছে তার পরও তা লাগিয়ে দাও।’ প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গাছ অবিকল্প ভূমিকা পালন করছে। এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ, পাশাপাশি চলছে নগরায়ণ, বাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া, বাতাসে সীসার পরিমাণ। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত বিরূপতায় আমরা মুখোমুখি হচ্ছি খরা, বন্যা, ঝড়, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পসহ নানা ধরনের ভয়াবহ প্রতিকূলতার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে গাছ পালন করে উপকারী বন্ধুর ভূমিকা। গাছ সৃষ্টির এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার কথা উল্লেখ করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি বিস্তৃত করছি ভূমিকে, স্থাপন করছি পর্বতমালা এবং তা থেকে উদগত করেছি নয়নপ্রীতিকর সব ধরনের উদ্ভিদ। এটি আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ। আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি উপকারী বৃষ্টি এবং তা দিয়ে আমি সৃষ্টি করি উদ্যান, শস্যরাজি ও সমুন্নত খেজুর বৃক্ষ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর।’ (সূরা কাফ, আয়াত ৭-১০।) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ, বিভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট খাদ্যশস্য, জলপাই বাগিচা সৃষ্টি করেছেন। তারা একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশ। যখন গাছ ফলবান হয় তখন গাছের ফল আহার করবে। আর ফসল তোলার দিনে তার দেয় প্রদান করবে এবং অপচয় করবে না।’ (সূরা আনআম, আয়াত ১৪১)। ‘তারা কি জমিনের প্রতি লক্ষ্য করে না? আমি তাতে প্রত্যেক প্রকারের কত উত্কৃষ্ট উদ্ভিদ উদগত করেছি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়।’ (সূরা শুয়ারা, আয়াত ৭-৮)।

পৃথিবীর তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে বরফ গলে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষ। এমনকি পৃথিবীর কোনো কোনো এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশেরও সেই ঝুঁকি রয়েছে। গাছ অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি রোধ করে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা কমায় এবং শীতকালে বাড়ায়। গাছ ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী আলট্রাভায়োলেট রশ্মির প্রতিরোধক হিসেবে মানুষের উপকার করে। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ গাছ। এই সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। অকারণে আমরা গাছ কাটব না এবং শস্য নষ্ট করব না। জরুরি পরিস্থিতি তথা যুদ্ধের সময়ও রসুল (সা.) গাছ কাটতে নিষেধ করেছেন। সাহাবি ইবনে সাইদ (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মদিনার প্রত্যেক প্রান্তে সীমানা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যাতে গাছপালা মুণ্ডানো এবং কাটা না হয়। তবে যেগুলো উট খেয়ে ফেলে সেগুলো ছাড়া।’ (আবু দাউদ)। আল্লাহর সৃষ্ট এই পৃথিবীকে সুবজ রাখার দায়িত্বও আমাদের। কারণ আমরা আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি। তাই আমাদের উচিত বেশি করে গাছ লাগানো এবং অন্য মানুষকে গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা। যেদিন এ পৃথিবী সবুজে ভরে যাবে সেদিনই আমরা মাটির পৃথিবীতে জান্নাতের শীতল হাওয়া উপলব্ধি করতে পারব।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

 

সর্বশেষ খবর