শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ! ভূত ও ভবিষ্যৎ!

গোলাম মাওলা রনি

বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ! ভূত ও ভবিষ্যৎ!

জঙ্গিবাদ নিয়ে ইদানীং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ভয়-ভীতি, আবেগ-উত্তেজনা, মিথ্যাচার-অনাচার, সিনেমা, নাটক, বায়স্কোপ ইত্যাদির শেষ নেই। মধ্যযুগে যেমন বাচ্চাদের বর্গী দস্যুদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা হতো তেমনি সাম্প্রতিককালে জঙ্গি আতঙ্ক দ্বারা কেবল শিশু ছাড়া সব বয়সী নারী-পুরুষ, দেশি-বিদেশি, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জাতি-উপজাতি, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় এবং পেশাজীবীদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের লেফট-রাইট করার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন, ধার্মিকেরা ধর্মকর্মে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছেন, মসজিদ-মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাতে চলছে বিশেষ দোয়ার মাহফিল, শিক্ষক, ছাত্র-সাহিত্যিক, সাংবাদিক বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে পরখ করে নিচ্ছেন শরীরে কোনো জঙ্গিবাদের জীবাণু রয়েছে কিনা। বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া, রিকশাওয়ালা, দোকানদার, মাছ-মুরগি-মাংস বিক্রেতা, নাপিত, মেথর, কাঠুরিয়া থেকে ঝাড়ুদারেরা পর্যন্ত জঙ্গিবাদের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের সহায় সম্পত্তি, জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার এবং ব্যবসার পুঁজি হাতে নিয়ে ইয়া নফসি ইয়া নফসি শুরু করে দিয়েছেন।

বাঙালিদের হাজার বছরের ইতিহাসের বহু বাঁকে বহু ঘটনা-দুর্ঘটনা আমাদের বহুভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছিল। চোর, ডাকাত, হানাদার, গুণ্ডা-বদমাশ ইত্যাদি প্রজাতি সব সময়ই ছিল এবং এখনো আছে। এর বাইরে দৈত্য-দানব, ভূত-প্রেত, জিনপরী, শয়তান খবিশ ছাড়াও সাপ-গোপ, শিয়াল-বেজি, সজারু, ভালুুক-উল্লুক এবং বন মানুষের আক্রমণের ভয় আমাদের তাড়িত করে থাকে। কলেরা, গুটিবসন্ত, ক্যান্সার এইডস থেকে শুরু করে কালাজ্বর, জেঙ্গু, যক্ষ্মা, কুষ্ঠরোগ ইত্যাদিও আমাদের কম আতঙ্কে রাখে না। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, নদীভাঙন, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দুর্ভোগ, ভয়-ভীতি এবং আতঙ্ক পুরো বাঙালি জাতির নিত্যদিনের সঙ্গী। সামাজিক নির্যাতন, রাজনৈতিক জুলুম অত্যাচার, হত্যা, গুম, মামলা হামলার ভয় ছাড়াও ঘুষ দুর্নীতি, পদে পদে বঞ্চনা এবং লাঞ্ছনার ভয় পুরো জাতিকে অন্তহীন ভয়ের সাগরে হররোজ নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে। বীর বাঙালির সহস্রাব্দের প্রাত্যহিক জীবনে এমনতরো শত সহস্র ভয়ের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদের আতঙ্ক যা ইতিমধ্যেই মহামারী আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমাদের আরও ভীতু বানিয়ে দিচ্ছে।

ভয়-ভীতি, আতঙ্ক আমাদের জীবনে ভাত-মাছ, দুধ, কলা ইত্যাদি খাদ্য ও পানীয়ের মতোই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন, ভয় ছাড়া আমাদের একদম চলেই না, আমরা ভয় পেতে ভালোবাসি এবং তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি ভয় দেখাতে। এ কারণে আমাদের দেশে দিনের তুলনায় প্রায়ই রাতের পরিধি লম্বা হয়ে যায়। দিনের কর্মের চেয়ে রাতের কর্মের কদর বেশি। আমরা আলোর চেয়ে অন্ধকারকে বেশি ভালোবাসি। আমাদের আহার বিহার, চিত্ত বিনোদন, আদর আপ্যায়ন, নাটক সিনেমা, যাত্রাপালা, জারি, ভাটিয়ালি এবং মোহন বাঁশির বায়রাম বায়রাম সুর যেন রাতের অন্ধকার ছাড়া পূর্ণতা লাভ করে না। আমাদের প্রেম ভালোবাসা, গালগপ্প, সভা-সমিতি, ষড়যন্ত্র, চুরি করা চোর ধরা, অপমান-অপদস্ত, গ্রেফতার, বিচার-শালিস— সব কিছুতেই যেন রাতের আঁধার এক মৌলিক নিয়ামক হিসেবে আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

অতীতের সেই ধারাবাহিকতার ভয় এবং রাতের আঁধারের সঙ্গে মিলতাল রেখেই জঙ্গিবাদ নামক এক অদ্ভুত এবং অজানা রোগের আতঙ্ক আমাদের পেয়ে বসেছে। আমি এটাকে অদ্ভুত বললাম এ কারণে যে, জঙ্গিবাদ বলতে তাবৎ দুনিয়ায় যা বোঝানো হচ্ছে বা জঙ্গিবাদের নামে অন্যান্য দেশে যা করা হয় আমাদের দেশে ঠিক সেভাবে তার কিছুই হচ্ছে না। আমাদের দেশের কথিত জঙ্গিবাদের ধরন, প্রকৃতি, কায়দা-কানুন, উদ্দেশ্য ইত্যাদি সবকিছুই রাতের আঁধারের মতো অজানা, দুঃসাধ্য এবং ভয়ঙ্কর রূপে ভীতিকর। প্রতিটি দেশের জঙ্গিবাদের পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। ভারতের মাওবাদী জঙ্গগোষ্ঠী, উত্তর প্রদেশের বিস্তৃত জঙ্গলে ফুলন দেবী, কুসুমা নাইন প্রমুখের ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদী আচরণ, আল-কায়েদা, তালেবান, আইএস, নুসরা ফ্রন্ট, হিজবুল্লাহ, ফাতাহ গ্রুপ, দক্ষিণ আমেরিকার কন্ট্রা জঙ্গি, আয়ারল্যান্ডের জঙ্গি, রোমান ক্যাথলিক জঙ্গি, প্রটেস্ট্যান্ট জঙ্গি, মিয়ানমারের বৌদ্ধ জঙ্গি, কারেন জঙ্গি, মধ্য এশিয়ার চেচেন জঙ্গি, চীনের উইসর জঙ্গি ইত্যাদি গ্রুপগুলোর কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপট, তাদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে বিশ্ববাসী সবাই কমবেশি ওয়াকিবহাল। কিন্তু বাংলাদেশে কেন জেএমবি হলো, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম এদেশে কী করতে চায় অথবা হরকাতুল জিহাদ এবং হিজবুত তাহরীর নামক সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্য কী তা আমরা অর্থাৎ দেশবাসী কিছুই জানি না!

আজকের নিবন্ধে আমি সন্ত্রাস, বিপথগামিতা, ধর্মের নামে উগ্রবাদ বোঝাতে জঙ্গি শব্দটি ব্যবহার করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। পশ্চিমা বিশ্বের খ্রিস্ট-ইহুদিবাদ গত নয়শ বছর ধরে নিজেদের অপমানজনক পরাজয় এবং সীমাহীন কুকীর্তি ঢাকার জন্য ইচ্ছা করেই জঙ্গি নামক আরবি ভাষার একটি মহাতাত্পর্যময় সম্মানিত শব্দকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে এবং পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছে। অন্যদিকে বর্তমান জমানার কতিপয় মুসলমান এবং তথাকথিত অন্য ধর্মের বুদ্ধিজীবী অনেকটা না জেনেই শব্দটি ব্যবহার করছেন। সে অর্থে আমার বিষয়টা একটু আলাদা। কারণ আমি শব্দটির ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুটা জানি বলেই দুঃখ প্রকাশ করলাম। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, মুসলমানদের প্রায় দেড় হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাসে মাত্র দুজন মহামানবের নামের পাশে জঙ্গি নামটি শোভা পায়। তাবৎ দুনিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞ, ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ধর্মবেত্তাগণ ইতিহাসের মহাসংকটকালের মহাসন্ধিক্ষণে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় অনবদ্য ভূমিকা রাখার জন্য দশম শতাব্দীর মহাবীর, সিরিয়ার বাদশাহ ইমামউদ্দিন এবং নুরউদ্দীনের নামের শেষে জঙ্গি শব্দটিকে ব্যবহার করে আসছেন সম্মানিত উপাধি হিসেবে।

জঙ্গি শব্দটির হুবহু বাংলা বা ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। এটির অর্থ বোঝানোর জন্য অনেক বাক্যের দরকার পড়ে। জঙ্গি বলতে এমন এক দুর্লভ সামরিক প্রতিভা এবং মহাবীরকে বুঝায় যিনি মানবের কল্যাণে অমানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন এবং একটি মানবগোষ্ঠীকে জমিনের সংঘবদ্ধ দুরাচার এবং দুর্বৃত্তদের সামরিক অভিযানের ফলে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন। তিনি অসীম সাহসী, মহাধার্মিক, আল্লাহর অলি এবং সর্বোত্তম মানবিক গুণাবলির অধিকারী। তিনি একটি জাতিকে রক্ষা করেন এবং সেই জাতিকে ধ্বংস করতে উদ্যত গোষ্ঠীকে পরাজিত অথবা নির্মূল করেন। তিনি জমিনে অত্যন্ত সম্মানিত বান্দা এবং আল্লাহর রসুল (সা.) এর অতীব প্রিয় এবং আস্থাভাজন হিসেবে ইতিহাস প্রসিদ্ধ। কাজেই এমন একটি মহত্তম শব্দকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করার আগে সবার উচিত আরবি ভাষা, সংস্কৃতি, আরব ভূখণ্ড এবং মুসলমান জাতি সম্পর্কে সম্যকভাবে ধারণা নেওয়া।

ইদানীং সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়ামেন এবং প্যালেস্টাইন নিয়ে যেমন পশ্চিমা দুনিয়া ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে তেমনিভাবে দশম শতাব্দীতে পুরো ইউরোপের খ্রিস্টান রাজা বাদশাহ, উগ্রপন্থি ধর্মীয় নেতারা বিপথগামী তরুণেরা এবং নির্বোধ কট্টরপন্থিরা ঐক্যবদ্ধভাবে ক্রুসেডের নামে মধ্যপ্রাচ্যে বছরের পর বছর ধরে আক্রমণ চালিয়ে আসছিল। লাখ লাখ নিরপরাধ আরববাসী মুসলমানের রক্ত, লাখ লাখ ধর্ষিতা মা বোনের আহজারি, শিশুদের কান্নায় আরবের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। খ্রিস্টান উগ্রবাদীরা লাখ লাখ মানুষকে হত্যার পর মুসলিম অধ্যুষিত শহর বন্দর-জনপদ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। লাখ লাখ নারী-শিশু এবং যুবকদের বন্দী করার মাধ্যমে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল। প্রায় একশ বছর ধরে ক্রুসেডের নামে খ্রিস্টান উগ্রবাদীদের পরিচালিত তাণ্ডবের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বে কোনো রাজা-বাদশাহ রুখে দাঁড়ানো তো দূরের কথা— টুঁ শব্দটি উচ্চারণে সাহস পাননি। ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার আলেপ্পো নগরীর শাসক মহাবীর ইমামুদ্দীন সর্বপ্রথম উগ্রবাদী খ্রিস্টান আক্রমণকারী হানাদারদের বিরুদ্ধে তলোয়ার উঁচু করেন এবং প্রতিটি রণক্ষেত্রে খ্রিস্টানদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে থাকেন। ফলে আরব জাতি পশ্চিমা চক্রান্তে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা লাভের আশ্রয় খুঁজে পায়।

বাদশাহ ইমামুদ্দীনের পর তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী নুরুউদ্দিন অমিত বিক্রম এবং সাহস নিয়ে পশ্চিমা হানাদারদের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তার প্রতিনিধি গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবীর দ্বারা খ্রিস্টান উগ্রবাদীরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয় এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমারা বিতাড়িত হয় এবং জেরুজালেম মুসলমানদের অধিকারে আসে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সেমেটিক এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা, মুসলমান জাতিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়া এবং সর্বোপরি মানবতার রক্ষাকর্তা হিসেবে ইতিহাসবেত্তারা বাদশাহ ইমামউদ্দিন ও বাদশাহ নুরুউদ্দিনকে জঙ্গি উপাধি প্রদান করে সম্মানিত করেন।

ইদানীং বাংলাদেশে অথবা অন্যান্য মুসলিম দেশে যাদের জঙ্গি বলা হয় তারা কেউ বিপথগামী, কেউবা বিভ্রান্ত অথবা কেউ সশস্ত্র বিদ্রোহী। অন্যদিকে পৃথিবীর যেসব প্রান্তরে গত সত্তর বছর ধরে মুসলমানরা যেসব কারণে সশস্ত্র লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে তার একটি কারণও বাংলাদেশে গত সত্তর বছর ঘটেনি। এ ছাড়াও যেসব কারণে আরব, আফ্রিকা এবং আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী বা দল বছরের পর বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারছে তার একটি কারণও বাংলাদেশে বিদ্যমান নেই। ফলে এদেশে যদি কেউ আরব-আফ্রিকা অথবা আফগানিস্তানের মতো উগ্রপন্থা অবলম্বন করতে চায় তবে তা দীর্ঘমেয়াদ তো দূরের কথা স্বল্প মেয়াদেও অব্যাহত রাখতে পারবে না। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে উগ্রবাদীরা গাঙ্গেয় বদ্বীপে গত পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে একটি বছরের জন্যও বসতি গড়তে পারেনি। তাদের আলো-বাতাস-মাটি, পাহাড়-পর্বত, পানি এবং মানুষের মন-মানসিকতা উগ্রবাদের জন্য একটুও উপযুক্ত নয়। ফলে এদেশে তথাকথিত জঙ্গিবাদ ওরফে বিপথগামীদের উগ্রবাদিতা হালে পানি পাবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যেসব তরুণ উগ্রবাদিতার নামে গুলশান বা শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছিল তারা ব্যক্তিগত জীবনে স্বভাবগতভাবে কেউই উগ্র ছিলেন না। শারীরিকভাবে যুদ্ধংদেহী ভাবসাব এবং মানসিকভাবে বদরাগী স্বভাবের কোনো অতীত ইতিহাস সম্পর্কে কোনো মহল থেকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়নি। আমাদের দেশে কার্যত অপরাধী বলে বিবেচনা করা হয় এমনতরো কোনো অপকর্মের কারণে তাদের বিরুদ্ধে অথবা তাদের পরিবার পরিজনের বিরুদ্ধে কোনো থানায় মামলা-মোকদ্দমাও নেই। তাদের সমস্যাটি ছিল শতভাগ মনস্তাত্ত্বিক যা পৃথিবীর কোনো স্বাভাবিক জ্ঞান গরিমা, বুদ্ধিশুদ্ধি অথবা যন্ত্রপাতি দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এক দুর্বোধ্য মনোজাগতিক চিন্তার দ্বারা প্রতারিত হয়ে তরুণ ও যুবকেরা ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিয়েছিল। কাজেই কোনো গতানুগতিক পদ্ধতি, শক্তিপ্রয়োগ কিংবা দুর্বল মস্তিষ্কজাত কোনো অনুসিদ্ধান্ত দ্বারা সমস্যাটি যদি সমাধানের চেষ্টা করা না হয় তবে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য।

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিবর্গকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান অথবা উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মতো উগ্রবাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো অসম্ভব। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান, জনগণের মনমানসিকতা এবং অর্থনৈতিক সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে উগ্রবাদীরা কোনো দিন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, পট পরিবর্তন অথবা রাজনৈতিকভাবে প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করতে পারবেন না। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় যত দেশি-বিদেশি মদদই থাকুক না কেন শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক নিয়মেই তারা ব্যর্থ হবে। সরকার যদি পরিস্থিতিকে সত্যিকারভাবে মূল্যায়ন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে বাঙালির চিরায়ত স্বভাব অনুসারে অতিরিক্ত ভয় পেয়ে যায় এবং অতিরিক্ত অস্থিরতা অথবা উত্তেজনা প্রদর্শন করে তাহলে উগ্রবাদের কিছুই হবে না। বরং আমাদের সামাজিক সংহতি, পারিবারিক বন্ধন, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আস্থা ভেঙে পড়বে। মানুষের মন অবদমিত হয়ে পড়বে। শুরু হবে সামাজিক অস্থিরতা যা দেশজ উৎপাদন কমিয়ে দেবে এবং আমাদের দারিদ্র্যের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।

তুলনামূলক বিচারে আমাদের সমাজ এবং পরিবার এখনো পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো। ফলে রাষ্ট্র ও সরকারের শত ভুল-ত্রুটি, অন্যায় অবিচার এবং নানান অভিযোগ সত্ত্বেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের উন্নয়ন সব সময়ই মাইক্রো লেভেল থেকে হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ যার যার অবস্থান থেকে রাষ্ট্রের প্রতি কোনো নির্ভরতা না দেখিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে রাষ্ট্র যদি উন্নয়নের এ তিনটি ধারার মধ্যে নিজের ভয়-ভীতি এবং অদক্ষতাকে জোর করে ঢুকিয়ে দেয় তাহলে অনাগত দিনে আমাদের অধঃপতনের জন্য নতুন কিছু লাগবে না।

লেখক : কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর