মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

আইএস সৃষ্টি আমেরিকার কীর্তি

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

আইএস সৃষ্টি আমেরিকার কীর্তি

১৯৯০ সালের আগে সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকা তামাম দুনিয়া দুই ভাগে শাসন করত। পৃথিবীতে ক্ষমতার একটা ভারসাম্য বজায় ছিল। ১৯৯০ সালে বার্লিন দেয়াল ভাঙার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। একমাত্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বেসামাল আচরণ দেখাতে শুরু করল। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর তাদের অস্ত্র বিক্রির মার্কেটে মন্দা দেখা দিল। যুদ্ধ ছাড়া বিশাল সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ জোগানো হাতি পালার শামিল। বিশাল সামরিক বাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ, অস্ত্রের ব্যবসা করার পথ সংকুচিত হয়ে আসায় তাদের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে মাথা ঘামাতে হলো। বিশ্ব বাস্তবতায় গবেষণায় পেল জাপান, চীন, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এ ধরনের দেশ শান্তিতে আছে; তারা শান্তিতে বিশ্বাস করে। আফ্রিকার দেশগুলোর তেমন কোনো নগদনারায়ণ সম্পদ নেই যে অস্ত্র-গোলাবারুদ কিনতে পারবে, তা ছাড়া পৈতৃক সম্পত্তির মতো আফ্রিকা ভাগবাটোয়ারা করে আমেরিকা ও পশ্চিমারা কলোনি করে নিয়েছে। একমাত্র মধ্যপ্রাচ্য যেখানে সম্পদ আছে, একনায়কতন্ত্র আছে, ধর্মীয় গোঁড়ামি আছে সেখানে গণতন্ত্রের দাওয়া দিলে তারা খাবে এবং মার্কিনিদের আয়-রোজগার বেড়ে যাবে। সুপরিকল্পিত আগ্রাসনের প্রথম পর্বে মুসলমান রাষ্ট্রগুলোকে টার্গেট করা হলো। তারপর গণতন্ত্রের সালসা খাওয়ালো একনায়কতন্ত্রী শাসকের বিরুদ্ধবাদীদের। একদিকে স্বৈরশাসককে বলছে প্রতিবাদকারীদের শক্ত হাতে দমন কর, অন্যদিকে মুক্তিপাগল মানুষকে উসকে দিচ্ছে স্বৈরশাসককে উত্খাত করতে। দুই পক্ষকে মুখোমুখি করে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে উভয় পক্ষের কাছে চড়া দামে অস্ত্র বিক্রি করছে। আবার নিজেরা আম্পায়ারের দায়িত্বও পালন করছে।

স্যামুয়েল হান্টিংটন তার বিখ্যাত বই Clashes of civilization-এ লিখেছেন স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্ব পরিস্থিতি কী হতে পারে। মার্কিনিরা টিকে থাকতে কী করবে তার ইঙ্গিত রয়েছে ওই বইটিতে। West versus the Rest শিরোনামে তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমা ও আমেরিকার বিরুদ্ধে অন্য জাতির অবস্থান কী হতে পারে। পশ্চিমা দেশে জঙ্গি হামলা হান্টিংটনের শঙ্কাই প্রমাণ করছে। আমেরিকার জন্য একমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদশালী মুসলিম দেশগুলো হবে সফট টার্গেট, টাকা কামানোর আর ক্ষমতা জাহির করার মোক্ষম উর্বর ভূমি। তাদের গবেষক, রাজনীতিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনী এক ধ্যানে এক জ্ঞানে চলে। নীতিনির্ধারকরা যে পথ দেখাচ্ছেন অন্ধের মতো তারা দেখানো পথে হাঁটছে। কী অবাক কাণ্ড এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে হত্যা করছে। এ ভয়াবহ রক্তের খেলায় নিরীহ দেশগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না। একই ধর্মের লোক হানাহানি, খুন-খারাবিতে লিপ্ত তা বিশ্বকে দেখিয়ে দেদার তেল-অস্ত্র-গোলাবারুদের সওদা করছে। আকাশ থেকে বোমা মেরে ট্যাঙ্ক দিয়ে দেশকে মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।

জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদ শব্দ ১৯৯০ সালের আগে এমন গনিমতের মালের মতো ব্যবহৃত হয়নি। সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ও অস্ত্র বিক্রির মার্কেট তৈরি করতে তারা ইসলামে কালিমা লেপনের ফন্দিফিকির এঁটেছে। তাদের পালিত প্রচারযন্ত্র দিয়ে কাল্পনিক উদ্ভট কল্পকাহিনী প্রচার করে মুসলমানদের একঘরে করার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে।

আইএস ২০১৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে। ইরাকের আল-কায়েদার অণু থেকে বিস্তার লাভ করে আমেরিকার মদদে। ইরাকের গেরিলারা সিরিয়া সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করছে দেশি-বিদেশি যোদ্ধা নিয়ে।

প্রফেসর পিটার, (কিং কলেজ লন্ডন) বলেন, আশি ভাগ যোদ্ধা পশ্চিমা দেশের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করছে। তারা দাবি করছে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা ও আরব দেশের অনেক যোদ্ধা তাদের হয়ে লড়াই করছে।

২০১৪ সালে আইএস মসুল দখল করার পর ইরাকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা থেকে প্রচুর ডলার লুটে নেয়। এখন তাদের মূলধন দাঁড়িয়েছে দুই বিলিয়নে। তেল বিক্রির অর্থও তাদের হাতে যাচ্ছে। সৌদি আরব ও কাতার বিদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছে মোড়লের ইঙ্গিতে।

সিআইএ ১৯৭০ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডকে মদদ দিত সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা মার্কসবাদকে সামাল দিতে। ইন্দোনেশিয়ায় সারেকাত ইসলামকে সমর্থন করত সুকর্নকে রুখতে। পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করত জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আয়ত্তে রাখতে। আমেরিকার নীতি ঘুরপাক খায় তাদের পরম বন্ধু ইসরায়েল আর তেলের খনি লুটতরাজ নিয়ে। ইরান সিরিয়াকে সমর্থন করে বিধায় ফ্রি সিরিয়া আর্মির বিদ্রোহীদের ব্যবহার করে সিরিয়ার সরকার উত্খাতের চেষ্টা ও ইরানকে শাসাচ্ছে তারা।

মার্কিনিরা আইএস তিন কারণে পালে। এক. শত্রুদেশের ওপর আক্রমণ করে ধনসম্পদ লুট করা। দুই. দেশ দখলের অজুহাত হিসেবে আইএসের উৎপাত বিশ্বকে দেখানো। তিন. নিজ দেশের মানুষকে ধোঁকা দিতে তাদের দিয়ে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটানো।

জঙ্গিদের প্রথম ব্রিডিং গ্রাউন্ড তৈরি করেছিল আফগানিস্তানের তালেবান দিয়ে। তখন পশ্চিমারা অনেকে ছদ্মবেশে মসজিদ-মাদ্রাসায় গিয়েছে নওমুসলিম সেজে। আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সহজে তাদের পাতা ফাঁদে পা দেবে না জেনে মাদ্রাসাপড়ুয়া সরল অন্তকরণের কিশোর-যুবকদের নির্বাচিত করে জঙ্গি সৃষ্টির উপাদান হিসেবে। মোল্লা ওমর থেকে শুরু করে লাদেনের আল-কায়েদা সব জঙ্গি তাদের সৃষ্ট। ভুল বুঝিয়ে আফগানিস্তানে এদের দিয়ে যুদ্ধ করিয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।

তারা যুদ্ধ করতে নিরপেক্ষ দেশকে বেকায়দায় ফেলে তাদের সেনাবাহিনী ভাড়া করে। অনিচ্ছায় উন্নয়নশীল দেশগুলো বাধ্য হয় অর্থ আর ক্ষমতার মোহে মার্কিন কোয়ালিশনে যোগ দিতে। পরিণামে দেশের জন্য একটা মহাবিপদ ডেকে আনে, টার্গেট হয় জঙ্গিদের। বুশ ক্রুসেড যেমন ঘোষণা করেছিলেন তেমন আল-কায়েদা-আইএস এলান করেছে আমেরিকার সঙ্গে যাদের মিত্রতা তাদের ওপর আক্রমণ করা তাদের ইমানি দায়িত্ব। যে কারণে আক্রমণ আর কোনো একক দেশে সীমাবদ্ধ থাকছে না। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হলে নৈরাজ্য থামবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো তা চায় না। তাতে তাদের অস্ত্র ব্যবসা, তেলের লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বের সব মহাযুদ্ধই এই জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকা, ইংল্যান্ড গুটি চালাচালিতে বাধিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এ দেশগুলো গোঁয়ার্তুমি করে শান্তিপ্রিয় মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলেছিল।

বর্তমান বিশ্বে আদি ও খাঁটি জঙ্গি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারাই সারা পৃথিবীতে বিবাদ-বিসম্বাদ বাধিয়ে রেখেছে। জঙ্গির হাতে অর্থ-অস্ত্র দিয়ে ধান্দা হাসিল করছে। তাদের আছে পোষা মিডিয়া, গৃৃৃহপালিত মানবাধিকার সংস্থা, সর্বোপরি সেনাবল-অস্ত্রবল। জর্জ বুশের আমল থেকে মুসলমানদের জঙ্গি-সন্ত্রাস ব্রান্ডেড করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। ভাঁওতাবাজি করে ইরাক দখলে নেওয়ার পর প্রপাগান্ডা আরও বাড়িয়ে আরব বসন্তে গিয়ে ঠেকিয়েছে। আসল অপরাধীকে না ধরে আমরা শুধু উপসর্গ নিয়ে হৈচৈ করছি। জঙ্গি সমাধানের ক্লু পাওয়া যাবে জর্জ বুশ ও বর্তমান সিআইএ-প্রধানকে রিমান্ডে নিলে। বিশ্বে আইএস কোথায় কারা সব তরতর করে বের হবে। আমাদের নিন্দা করার দরকার হচ্ছে না, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। কদিন আগে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। নির্বাচনী জনসভায় ট্রাম্প বললেন, নব্বইয়ের আগে জঙ্গি ইস্যু ছিল না বিশ্বে। এসব জঙ্গি নাটক তৈরি করেছেন হিলারি ক্লিনটন আপা সেক্রেটারি অব স্টেট থাকাকালে। তালেবান-আইএস নাটকের রমরমা ব্যবসা করেছেন সবার চোখে ধুলা দিয়ে।

বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন হলো জঙ্গি আক্রমণ শুরু হয়েছে। ব্লগার থেকে শুরু করে বিদেশি, ধর্মযাজক হত্যা, এসব নির্দয় ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই জামায়াত-বিএনপি ঘটিয়েছে বলে জিকির তুলে প্রকৃত ঘটনার গভীরে তদন্ত সংস্থা যেতে পারেনি বলে মনে হয়। সরকার শুধু ক্ষমতা পোক্ত আছে কিনা এ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ঘরে তুলতে এত ব্যস্ত যে দেশে যুবসমাজের মধ্যে কীভাবে বিপথগামিতার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তা তারা ভাবনায় নিতে পারেনি। এতদিন শুধু মাদ্রাসাকে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দোষারোপের কেন্দ্রে রেখে মতলববাজরা পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে। মাদ্রাসায় পড়ে গরিব-দুঃখী সাধারণ অভাবী ঘরের সন্তানরা, তাদের দোষ দেওয়া সোজা কারণ তাদের কেউ মিডিয়ায় নেই, অর্থ-প্রতিপত্তিও নেই, দোষারোপের প্রচার জাতিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারছে না।

বিত্তবান পরিবারের আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানরা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, এ কঠিন রোগ সহজে নিরাময়যোগ্য নয়। যারা মৃত্যু আলিঙ্গনে আসক্ত তাদের বুলেট প্রয়োগে সম্পূর্ণ দমানো কঠিন কাজ। শুধু বল প্রয়োগে সাময়িক কিছু লোক দেখানো আত্মতৃপ্তি পাওয়া যাবে কিন্তু শেকড়ে যাওয়া যাবে না। সরকার নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করে ঘোঙ্গর টেনে ঘুমিয়েছে এতদিন। এখন দেখা যাচ্ছে নির্দোষ সরকারি দলের নেতাদের সন্তানেরা অভিভাবকের অজান্তে হেরোইনের নেশার মতো জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। ভাগ্যিস ধর্মের প্রতি আবেগপ্রবণ কোনো নেতার সন্তান জঙ্গিবাদে জড়িত নেই। একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়েছি। বাবা-মা নিজের সন্তানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, সন্দেহের আতঙ্কে তারা। বুকে চাপা আগুন রেখে বিপথে নিহত সন্তানের লাশ নিতে বাবা-মা অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। সবার মধ্যে অজানা আতঙ্ক, কে কোথায় আক্রান্ত হবে কেউ জানে না। এমন সংকট মোকাবিলার জন্য গভীর চিন্তাভাবনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া সমাধান দুরূহ। রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। জাতির চরম দুর্যোগে ভেদাভেদ ভুলে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। গুলশান ঘটনার পর সরকারের দাবি জাতীয় ঐক্য হয়েছে। জাতীয় ঐক্য নিয়ে হেলাফেলা বন্ধ করতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে ক্যান্সার রোগে ওরস্যালাইন দিয়ে রোগী ভালো হবে না।

বাংলাদেশে জঙ্গি বিকাশের কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। দেশের মানুষ চরম কোনো পন্থা পছন্দ করে না। জঙ্গিবাদ নামের নৈরাজ্যের শেকড়ে যেতে হবে। অনেকে বলেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেশ হামলার শিকার হচ্ছে, তাদের দেশে হামলার কারণ তারা নিজেরাই সৃৃষ্টি করেছে। হামলার কারণ তাদের আগ্রাসী তন্ত্র।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবতা প্রতিষ্ঠা করে লুটপাট-দুর্নীতি পরিহার করে যুবকদের সামনে আদর্শের নেতৃত্বের মডেল তুলে ধরতে হবে। যে নেতৃত্বের ক্যারিশমায় কোমলমতি যুবকরা ফিরে আসবে শান্তির পথে। গড়ে তুলবে সুখী-সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলাদেশ।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর