শিরোনাম
রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘বাতাসে লাশের গন্ধ...মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য’

রোবায়েত ফেরদৌস

‘বাতাসে লাশের গন্ধ...মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য’

খবরের কাগজ উল্টাতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ব্যাক পেইজের ছোট্ট একটি নিউজে চোখ আটকে গেল; এক কলামের প্রকাশিত ওই খবরের শিরোনাম : ‘শোলাকিয়ায় হামলার এক মাস : আজও কান্না ঝরনা রানীর পরিবারে’; কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার এক মাস পূর্ণ হওয়ার দিন ওই রিপোর্টটি কিশোরগঞ্জের প্রতিবেদক লেনিনের নামে ছাপা হয়েছে; খুবই করুণ আর হৃদয়বিদারক বর্ণনা : সময়ের আবর্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি জঙ্গি হামলায় নিহত ঝরনা রানীর পরিবার। স্বামী ও সন্তানরা ঝরনা রানীর স্মৃতি ধারণ করে নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন। যে মা নিজ হাতে খাইয়ে দিত, পরাত, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াত ছোট ছেলে শুভকে, ওর সেই মা আজ নেই— এটা ভাবতেই কষ্ট হয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলের। ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া হয় না ওর, পড়ালেখায় মন বসে না। ওর খেলার সঙ্গীই ছিলেন মা। তাকে হারিয়ে শুভ এখন বাকরুদ্ধের মতো। কর্মচঞ্চল ঝরনার স্বামী গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিকও যেন নিথর হয়ে গেছেন। মা-বিহীন সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তারও। ঘটনাটি তার কাছে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো। (বাংলাদেশ প্রতিদিন ৭ আগস্ট ২০১৬) পাঠক জানেন, গত ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রায় চারশ গজ পশ্চিমে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে পুলিশের চেকপোস্টে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে দুই পুলিশ, এলাকার গৃহবধূ ঝরনা রানী ও আবির রহমান নামে এক জঙ্গি নিহত হয়।

জঙ্গিদের নির্মমতায় কেবল কিশোরগঞ্জ আর গুলশানের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে এমন নয়; কান্নার গুঞ্জরন সাত সমুদ্র তের নদীর পারে গিয়েও লেগেছে— গুলশানের জঙ্গি হামলায় নিহত ইতালি আর জাপানি নাগরিকদের পরিবারও আজ কান্নারত। গত ১১ জুন ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম আরও মর্মস্পর্শী : ‘ওরা আমার সিঁদুর কেড়ে নিল’। এই আর্তনাদ, এই আর্তচিৎকার ঝিনাইদহের নলডাঙ্গার নিহত পুরোহিত আনন্দ গোপালের স্ত্রী শেফালী গাঙ্গুলীর। ১৯৭১-এ আমরা স্বাধীনতা পেলাম তা কী এই জন্য যে, এখানে সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন হবে, প্রতিদিন তারা নিপীড়িত হবেন? কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন : ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা; তোমাকে পাওয়ার জন্য আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন? তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।’ হায়! প্রিয় পাঠক, হায়! এই কবিতা কী ভয়ঙ্করভাবে এখনো প্রাসঙ্গিক!

স্বাধীন দেশে চাপাতি-রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আততায়ীরা; যাকে যখন তখন মওকা বুঝে খুন করার মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহী। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারপর চলে যাচ্ছে। গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় রেস্টুরেন্টে ঢুকে জিম্মি নাটক সাজিয়ে ২৩ জন দেশি-বিদেশি মানুষকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হলো। এও কি হয়? হয় কি কখনো? আমরা বলছি এটা জঙ্গিবাদ। আমি মনে করি, জঙ্গিবাদ সাম্প্রদায়িকতারই এক উগ্র রূপ— ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’-এর নামে যে তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। আফগান ফেরত মুজাহিদদের অংশগ্রহণে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়; আর নৃশংস গুলশান হত্যাযজ্ঞের পর দেশে জঙ্গিবাদ বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর স্তরে উপনীত হয়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জঙ্গি হামলায় ২৭৬ জন নিহত আর ১৬৭৭ জন আহত হয়েছেন (প্রথম আলো ৬ আগস্ট ২০১৬) বিভিন্ন সংবাদপত্রে ‘কিলিং মিশনের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক’ কিংবা ‘জঙ্গি হামলা ও হত্যা বেড়েই চলেছে’ শিরোনামের  প্রতিবেদন আমরা হামেশাই দেখছি। একের পর এক টার্গেট বাস্তবায়ন করছে জঙ্গি নেটওয়ার্কের দুর্ধর্ষ সব সদস্যরা। হিসেবে দেখা গেছে বিগত কয়েক বছরে দেশে জঙ্গি হামলা ও হত্যার হার বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। ২০১৫ সালে বইমেলায় লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার মধ্য দিয়ে জঙ্গি হামলার ঘটনা নতুন করে দেশে-বিদেশে আলোচনায় আসে।

এটি নতুন মাত্রা পায় গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ইতালি নাগরিক  তাভেলা সিজার ও এর পাঁচ দিনের মাথায় ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ডে। এরপর ১ জুলাই গুলশানে ১৮ জন বিদেশিসহ ২৮ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের পর পুরো পৃথিবীর নজর এখন বাংলাদেশে। হামলাকারীদের কৌশলের কাছে বার বার পর্যুদস্ত হচ্ছেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে চলে আসছে জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর, আনসার আল ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, নব্য জেএমবির নাম; আসছে ‘আইএসে’র দায় স্বীকারের বার্তা। নিহতের তালিকায় আছেন বিদেশি নাগরিক, লেখক, প্রকাশক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ ও পুলিশের স্ত্রী, পুরোহিত, সাধু, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান ধর্মযাজক, শিয়া, বাউল, লালন-সাধক, পীরের অনুসারী, সমকামীদের অধিকারকর্মী, ব্লগার, মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম। এ তালিকা দীর্ঘতর। কে নেই এর ভিতরে? সবাই কোপ খাচ্ছেন, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন। বীভৎস সব হত্যাকাণ্ড! মুসলিম অমুসলিম সবাই কোপ খাচ্ছেন; ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল এই আততায়ীরা। এরপর ২০১৪ ও ১৫ সালে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে তারা নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। গত দুই বছরে অন্তত ৩০ জন ব্লগার নিরাপত্তা না পেয়ে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছেন, দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়ায় আরও ঠিক কতজন আছেন, তার কোনো হিসাব নেই; নিয়মিত হুমকি মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন অনেকেই। এই যদি হয় বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র, তবে আপনার-আমার নিরাপত্তা কোথায়? জননিরাপত্তা কি অরণ্যেই রোদন করবে? স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা তবে কে কাকে দেবে? সরকারের তরফ থেকে আগে বলা হতো, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু একের পর এক একই আদলে হামলা হতে থাকলে সেটা আর বিচ্ছিন্ন থাকে না, একই সূত্রে গাথা হয়ে যায়, হত্যার একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সংস্থাও বলছে একটির সঙ্গে অপরটির মিল আছে।

এর মাঝে সাধারণ মানুষের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে বড় দুই দলের দোষারোপের রাজনীতি। যা অতীতের সব রেকর্ডকে ভেঙে ফেলেছে বলেই মনে হচ্ছে। একদল আরেক দলের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতারা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একে অপরকে দোষ চাপায় তখন সেটাকে পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু মনে হওয়ার সুযোগ আছে কি? চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পরই দেখা গেছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি বিরোধী দলের কাজ। বিপরীতে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের দমন করতে এ হত্যাকাণ্ড সরকার ঘটিয়েছে। দেশের মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তখন দোষারোপের রাজনীতি দেখে যে কারও মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করতে পারে। এখন সরকারের উচিত এসব পরিহার করে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ দেশ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিনই এখানে ওখানে, দেশের এপ্রান্তে ওপ্রান্তে লাশ পড়ছে। কিন্তু এ অবস্থা থেকে বের হতে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা কী আশা-জাগানিয়া?

আমাদের প্রত্যাশা, ঘাতক ও তাদের মাস্টারমাইন্ডদের চিহ্নিত করা হোক। চিহ্নিতদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির বিধান করা হোক। কারণ জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, ব্যবসাপাতি, রপ্তানি-বাণিজ্য ও দেশের ইমেজ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের উচিত এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা, বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা। মানুষের জীবন, জীবিকা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

কারণ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে, মানুষ তার জীবন আর জীবিকার নিরাপত্তা পাবে, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাবে, এটাই কী আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল না? ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্তে এ কোন হায়েনার হানা?  দুধে-ভাতে এ কোন উৎপাত?  রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জবানিতে বলতে চাই, এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়? তবে আজও কেন জাতির পতাকা খামচে ধরছে সেই পুরনো শকুন? তবে কি স্বাধীনতার মৌলভিত অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক চেতনা আর বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আত্মম্ভর আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি?  প্রশ্ন রইল।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; [email protected]

সর্বশেষ খবর