পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রসুল (সা.)-এর জীবনের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরাতুল আহজাব : ২১) বস্তুত যারাই নবীজীর আদর্শে জীবন গড়েছে তারাই দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার মুখ দেখেছে। তাদের জীবন শান্তিময় হয়েছে। শান্তিতে বসবাস করতে পেরেছে। সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে রসুল (সা.)-এর আদর্শ ও নমুনা রয়েছে। রসুল (সা.) পুরো জীবনই অনুসরণ ও অনুকরণীয়। তিনি কীভাবে শৈশবকাল কাটিয়েছেন, কীভাবে যৌবনকাল কাটিয়েছেন এবং কীভাবে আখেরি জীবন কাটিয়েছেন। প্রতিটি শ্রেণি এবং প্রতিটি স্তরের লোকদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। আজকের ক্ষুদ্র লেখায় পুরো বিষয়টি লেখা সম্ভব নয়। এখানে শুধু নমুনা হিসেবে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইশারা করা হলো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’ (সূরা নিসা : ৫৯) অপর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রসুল (সা.)-এর আনুগত্য করল সে যেন আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে ব্যক্তি বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে (হে মোহাম্মদ!) তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি। (সূরা নিসা : ৮০) সূরা নূরের ৬৩নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘রসুলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরকে আহ্বানের মতো গণ্য কর না। আল্লাহ তাদের জানেন, যারা তোমাদের মধ্যে চুপিসারে সরে পড়ে। অতএব, যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের স্পর্শ করবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদের গ্রাস করবে।’ আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহতায়ালা বান্দার ইবাদত এবং রসুল (সা.)-এর আদেশ অমান্যকারীদের ব্যাপারে সীমারেখা বাতলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ ও রসুল (সা.) কর্তৃক আদেশকৃত হুকুম-আহকামকে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা, জবান দ্বারা স্বীকার করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা বাস্তবায়ন করাই হলো একজন প্রকৃত ইমানদারের কাজ। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যারা ইবাদত করবে তাদের ইবাদতই আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয় হবে। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ ও রসুল (সা.)-এর বাতলানো পথ বাদ দিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তি বা জাতির পন্থা অবলম্বন করবে তা হবে শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার। তাদের দুনিয়াতে আল্লাহতায়ালা বড় শাস্তি দেওয়ার আগে হালকা শাস্তি দিবেন। যদি তারা আল্লাহ ও রসুল (সা.)-এর বিধান মেনে সঠিক পথে ফিরে না আসে, তাহলে তাদের দুনিয়া ও পরকালে কঠিন শাস্তি আস্বাদন করানো হবে। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, আল্লাহ ও রসুল (সা.)-এর প্রতিটি বিধান ও কর্মপন্থার মধ্যে রয়েছে হিকমত এবং নেয়ামতে পূর্ণ। আল্লাহ ও রসুল (সা.)-এর বাতলানো পথে চলার মধ্যে রয়েছে দুনিয়াতে নিরাপত্তা আর পরকালে অনাবিল শান্তি জান্নাত। যেমন : লেবাস-পোশাক, আচার-বিচার এবং সামাজিক বিবাহ-শাদি। এক কথায় সব ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন উত্তম নিদর্শন। লেবাসে-পোশাকে শালীন পোশাকের বিধান রেখে গেছেন। পুরুষের জন্য এক ধরনের পোশাক হবে, নারীর জন্য ভিন্ন পোশাক হবে। পুরুষের পোশাক নারী পরিধান করলে কিংবা নারীর পোশাক পুরুষে পরিধান করলে সামাজিক অবক্ষয় নেমে আসবে। যা বর্তমান বিশ্বে অহরহ ঘটছে। নারী হারাচ্ছে ইজ্জত-আবরু, বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য অধিকার থেকে। আচার-বিচারে তিনি ইনসাফের ফায়সালা করতেন, কোনো মুসলিমও যদি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। তিনি মুসলমানের পক্ষাবলম্বন করতেন না। বরং ন্যায়সঙ্গতভাবে ইনসাফের ফয়সালা করতেন। শুধু তাই নয় সামাজিক প্রতিটি কর্মকাণ্ডে মানুষের জন্য সহজ ও নিরাপদ পদ্ধতি আবিষ্কার করে গেছেন। যেমন : বিবাহ-শাদিতে। নিজ কন্যা হজরত মা ফাতেমা (রা.)কে হজরত আলী (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার সময় অতি উত্তম এক নমুনা দেখিয়ে গেছেন। যার মধ্যে ছিল না বেহুদা খরচাদি। লোক দেখানো আহামরি কোনো মোহরও ধার্য করেননি। মাত্র চারশত আশি দেরহাম দেনমোহর ধার্য করেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ দানবীর। কোনো ভিক্ষুককে কখনো ফিরিয়ে দিতেন না। কোনো প্রার্থী তাঁর কাছে কিছু চেয়ে নিরাশ হয়নি। যদি কখনো এমন হতো যে, তাঁর হাত একেবারেই খালি প্রার্থনাকারীকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তখন তাকে কোমল স্বরে বিদায় দিতেন এবং বুঝিয়ে দিতেন অন্য সময়ে দিবেন বলে ওয়াদা করতেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যবাদী। কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না। তাঁর স্বভাব ছিল অতি কোমল। কেউ যেন কোনোভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকে সার্বক্ষণিক লক্ষ্য রাখতেন। এমনকি রাতে কখনো কোনো কাজে বের হলে পায়ের পাদুকাটিও পরতেন খুব ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে দরজা খুলতেন। ধীরগতিতে চলতেন। ঘরে প্রবেশ করে গৃহবাসীকে শায়িত দেখলে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে এই ভেবে চুপিসারে নিজের কাজ নিজেই সম্পাদন করতেন। তিনি সাধারণত নিজের কাজ নিজেই করতেন। গৃহের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। ব্যবহার ছিল নম্র ও ভদ্র, কারও সঙ্গে কর্কশ ভাষায় কথা বলতেন না। আল্লাহপাক আমাদের রসুল (সা.)-এর বাতলানো পথ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।