সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

জজ মিয়াকে নিয়ে আদালতে বিরিয়ানি খান তদন্ত কর্মকর্তা

জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী সিকদার পিএসসি (অব.)

জজ মিয়াকে নিয়ে আদালতে বিরিয়ানি খান তদন্ত কর্মকর্তা

আগস্ট মাসে লেখার বিষয় নির্ধারণের ভাবনায় ১৫ ও ২১ আগস্ট সবকিছুকে ছাপিয়ে সর্বাগ্রে মনে ওঠে। কয়েক দিন আগেই গেল ১৫ আগস্ট, আর গতকাল ছিল ২১ আগস্ট। দুটি ঘটনার বৈশিষ্ট্য, আক্রমণকারী ও টার্গেট ভিন্ন, সময়ের ব্যবধান ২৯ বছর। তবে প্রকাশিত ও দৃশ্যমান তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলা যায় আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন। একইভাবে বলা যায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ও তত্পরতার পেছনেও রয়েছে একই উদ্দেশ্য। ১৫ ও ২১ আগস্টের আদ্যোপান্ত উপলব্ধি করলে আজকের জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি তত্পরতার গডফাদার ও মেন্টরদের সহজে চেনা যাবে এবং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কেও সব বিভ্রান্তি দূর হবে। উল্লিখিত ঘটনাবলির কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আর লড়াইটাও নতুন নয়। ২১ আগস্ট সম্পর্কে লেখার উদ্দেশ্যে পুরনো খবরের কাগজে চোখ বোলাতেই দেখি ২০০৯ সালের ২৬ আগস্ট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার বক্স হেডলাইন, ‘সাজানো জবানবন্দির পর জজ মিয়াকে নিয়ে আদালতে বিরিয়ানি খান তদন্ত কর্মকর্তা।’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের সমাবেশের ওপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড আক্রমণ সংক্রান্ত মামলা বিচারিক আদালতে এখন শেষ পর্যায়ে আছে। দোষী ও আক্রমণে জড়িতদের ব্যাপারে আদালতই চূড়ান্ত কথা বলবেন। তবে সে সময়ের জামায়াত-বিএনপি সরকার প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য কীভাবে জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিলেন তার কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায় ২০০৯ সালের ২৬ আগস্টের ওই পত্রিকার প্রতিবেদনে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মিথ্যা অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার পর পত্রিকার প্রতিবেদকের কাছে সেই করুণ ও নির্মম কাহিনীর বর্ণনা দেন আলোচিত নোয়াখালীর দিনমজুর জজ মিয়া। ২১ দিনের রিমান্ডসহ ২৭ দিন ঢাকার সিআইডির কার্যালয়ে বন্দী করে অমানুষিক নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের ভয়, আবার প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের জন্য প্রস্তুত করা হয় জজ মিয়াকে। জবানবন্দি দেওয়ার অভিজ্ঞতা প্রতিবেদকের কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে জজ মিয়া বলেন, ‘হাত-মুখ ধুয়ে আবার ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় আসি। আসার পর ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, জজ মিয়া তুমি এখানে সই দাও। আমি বলি, স্যার, আমার কোনো অসুবিধা হবে না তো?

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, তুমি রাজসাক্ষী হবে। পরে তোমাকে ওনারা (সিআইডি কর্মকর্তাদের দেখিয়ে) ছাড়িয়ে নেবেন। যদি সই না দাও, তাহলে তুমি আসামি হবে, তোমার ফাঁসি হবে। আমি সই দিই। এরপর ওই রুমে বিরিয়ানির প্যাকেট আনা হয়। আমি, ম্যাজিস্ট্রেট, মুন্সি আতিক, আবদুর রশিদ একসঙ্গে বিরিয়ানি খাই।’ ২১ আগস্টের মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে আছেন বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান, তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, আরেক প্রতিমন্ত্রী আবদুস ছালাম পিন্টুসহ জামায়াত-বিএনপির আরও কিছু নেতা, মন্ত্রী এবং পুলিশের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। অভিযুক্তরা যদি আদালতে দোষী প্রমাণিত হন তাহলে আলোচ্য ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনাটি ইতিহাসের সবচাইতে বৃহৎ এবং নিকৃষ্টতম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জামায়াত-বিএনপি সরকার জজ মিয়ার মতো একজন নিরীহ দিনমজুরের জীবনকে বাজি রেখে প্রকৃত আক্রমণকারীদের বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার মধ্যদিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সব সাজানো নাটক ও ষড়যন্ত্র তছনছ হয়ে যায়। অভিযুক্ত জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে তা মানুষের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। মামলার চার্জশিট, সাক্ষীদের জেরা ও মিডিয়ার প্রতিবেদনে এ পর্যন্ত যতটুকু বেরিয়েছে তাতে বোঝা যায় হাওয়া ভবনের পরিকল্পনা ও উদ্যোগে আক্রমণের ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করে হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা। সেদিন আক্রমণকারীরা সফল হলে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সব সিনিয়র নেতা নিহত হতেন। কিন্তু কেন এই আক্রমণ? এ প্রশ্নের প্রেক্ষাপট ও লেগেসির শুরু পাকিস্তান আমলে যার জোয়াল থেকে এখনো আমরা মুক্ত হতে পারিনি বলেই আজ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্পত্তি ও বিস্তার। লড়াইটা মূলত রাজনৈতিক আদর্শিক। অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতিপ্রসূত দর্শন ভার্সেস সাম্প্রদায়িক ও ধর্মতান্ত্রিক আদর্শ। ধর্মীয় বিদ্বেষ-হানাহানি, নির্যাতন, বঞ্চনা ও ধর্মের অপব্যাখ্যার হাতিয়ার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক আদর্শকে আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করেছিলাম। কিন্তু যুদ্ধটা শেষ হয়েও হলো না শেষ। একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক পক্ষ ও তাদের সঙ্গী দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের কাউন্টার অ্যাটাক বা প্রতিআক্রমণে আবার সব উল্টে যায়, ফিরে আসে প্রত্যাখ্যাত ও পরাজিত দর্শন। কিন্তু একাত্তরে এত বড় বিজয় অর্জনকারী বাঙালি জাতি তা মেনে নেয়নি। আবার শুরু হয় পুরনো যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা এখনো চলছে। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। বিপরীত পক্ষে রয়েছেন জামায়াত-বিএনপি ও তার সঙ্গীরা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের আক্রমণের সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত। আদর্শের লড়াইয়ের জায়গা, বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত হত্যাকারীদের বিএনপির সব সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় পদ প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা এবং ২০০২ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড আক্রমণের পরপর বিএনপি সরকারের জজ মিয়া নাটক সাজানোর কাহিনী ও কর্মকাণ্ড কী প্রমাণ করে তা কারও বুঝতে কষ্ট হয় না। ২১ আগস্টের আক্রমণের আগেও বহুবার শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেদিন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নিঃশেষ হয়ে গেলে কী হতো? প্রথমত স্বঘোষিত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হতো না। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার ক্ষমতা বলে সবাই জেল থেকে ছাড়া পেতেন। আগের মতো আবারও তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হতেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো দিনও হতো না, বরং রাষ্ট্র পরিচালনায় জামায়াতেরই প্রাধান্য থাকত। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তার সমীকরণে স্রোতের উল্টা দিকে পড়ে বাংলাদেশের অস্তিত্ব আজ সংকটাপন্ন হয়ে উঠত। কারণ তখন ২০০১-২০০৬ মেয়াদের মতো পাকিস্তান বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর জন্য সব রকম সহায়তা অব্যাহত রাখার সুযোগ পেত। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে চালান করার মতো আরও ঘটনা ঘটত। তার জের ধরে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভয়ানক হুমকির মুখে পড়ত, আর নয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করদ রাষ্ট্র হয়ে থাকা লাগত। কিন্তু সেদিন শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ আজ শুধু ওইসব আশঙ্কা ও ঝুঁকি থেকে মুক্তই হয়নি, বিস্ময়কর উন্নয়ন ঘটিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু দুর্নীতির লাগামটা টেনে ধরতে পারলে আর পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হতো না। দুর্নীতির কারণেই মানুষের মন থেকে শঙ্কা কাটছে না। টাকা হচ্ছে অঘটন ঘটন পটীয়সী। জামায়াতের রয়েছে পাহাড় সমান টাকা। তারা টাকা ছড়াচ্ছে দেশে-বিদেশে সর্বত্র। ব্রুটাস, মীরজাফর, জগৎ শেঠ যুগে যুগে ছিল, এখনো আছে। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে বিশ্বাসী প্রায় সব মানুষের ধারণা রাষ্ট্রযন্ত্রের সব সেক্টরে তারা এখনো ঘাপটি মেরে বসে আছে। আওয়ামী লীগের এক গুরুত্বপূর্ণ এমপি, যিনি বোধ হয় সংবেদনশীল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তিনি কয়েকদিন আগে আরেকটি সংসদীয় কমিটির সভায় আলোচনার প্রসঙ্গক্রমে নাকি বলেছেন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। যদিও পরের দিন তিনি সংবাদ সম্মেলন করে তা অস্বীকার করেছেন। তবে মিডিয়ায় যেভাবে এসেছে এবং আলোচ্য সংসদ সদস্যের ব্যাকগ্রাউন্ড পর্যালোচনায় তরুণ প্রজন্ম সামাজিক মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন। কার মনে কী আছে তা একমাত্র আলেমুল গায়েবই জানেন। আলোচ্য সংসদ সদস্য এক সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা ও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ না নিয়ে তিনি রাজাকার আবদুর রহমানের পক্ষ নিয়ে নির্বাচন বানচালের ঘোট পাকাচ্ছিলেন বলে মানুষ এখনো বলাবলি করে। বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। মোশতাক, তাহের ঠাকুর, ওবায়দুর রহমানদের মতো ছদ্মবেশীদের আমরা চিনতে পারিনি। জঙ্গিদের এখনো প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা। সুতরাং ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণকারীদের বাঁচানোর জন্য যারা জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছেন, আদালতে বসে বিরিয়ানি খেয়েছেন, তাদের পৃষ্ঠপোষক সাম্প্রদায়িক ও ধর্মতন্ত্রী দর্শনে বিশ্বাসীদের একাত্তরের মতো আবার চূড়ান্ত পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর