মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

শ্রদ্ধেয়া ডা. মিলনের মা

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

শ্রদ্ধেয়া ডা. মিলনের মা

সব মা-ই প্রাতঃস্মরণীয়া, শ্রদ্ধেয়া। ছোট-বড় সব মা-ই মা। মায়ের জায়গা কেউ নিতে পারে না। আপনি এক গরবিনী মা। ১৯৬৯-এ আসাদের মৃত্যু পাকিস্তানকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে গণআন্দোলন সফল হয়েছিল। আপনার বুকের ধন ডা. মিলনের মৃত্যুও তেমনই স্বৈরাচার এরশাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে তার পতন এনেছিল। সেদিন দেখলাম প্রবীণ আইনবিদ ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টায় মিলনের মা হিসেবে আপনি অংশ নিয়েছেন। আমি খুবই খুশি হয়েছি। আপনাদের মতো মায়ের এখন খুবই দরকার। ভুল করে বললেন কিনা তাই বলছি, জনাব জি এম কাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন। তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধা নন। মুক্তিযুদ্ধের আশপাশেও ছিলেন না। তার ভাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন পাকিস্তানে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীলদের শাস্তি দেওয়া ছিল তার কাজ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে আপনার প্রাণের ধন ডা. মিলন নিহত হয়েছেন। ভাই হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাজের দায় নিশ্চয়ই জনাব জি এম কাদের নেবেন না। কিন্তু জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে অবশ্যই কিছু দায়দায়িত্ব নিতে হবে। কিছু মনে করবেন না। এটাই আমার কাজ।

আগস্ট জাতীয় দুর্যোগ ও শোকের মাস। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সমগ্র বাঙালি জাতির জীবনে এ মাস অভিশপ্ত হিসেবে চিহ্নিত। আমার জীবন আগস্টে চুরমার হয়ে গেছে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে নির্যাতন, অবহেলা আর নির্যাতন— এ নিয়েই কাটছে জীবন। সীমাহীন অস্বস্তি আর দুর্ভাবনা জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এই জীবনে আর কখনো এ থেকে নিষ্কৃতি পাব বলে মনে হয় না। কোনো কোনো সময় কোনো কোনো জিনিস সহ্য করতে পারি না। তখন না বলে থাকতে পারি না। ১ আগস্ট থেকেই বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলায় বড় মর্মাহত হয়েছি। কেন এমন হবে? আওয়ামী লীগে বা সরকারে মুক্ত বিচার কি কেউ নেই? বঙ্গবন্ধু ১ আগস্ট নিহত হননি। তিনি নিহত হয়েছেন ১৫ আগস্ট সকালে। ১৪ আগস্ট গভীর রাতে পিজি হাসপাতালে মাকে দেখে বাড়ি ফেরার পথে ৩২-এ গিয়েছিলাম। রাত ১টা ৪০ মিনিটে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ১ আগস্ট যদি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে শোক পালন শুরু হয় তাহলে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি এই দুনিয়ায় কীভাবে ছিলেন?

এসব নিয়ে অনেক বলেছি কেউ শোনেনি। দেশের আপামর জনসাধারণ এখনো দু-চার কথা শুনলেও আওয়ামী ঘরানার তেমন কেউ আমাদের ভালো কথাও শোনে না। প্রবীণরা দু-চার জন এখনো কিছুটা চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু তাদের কোনো নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নেই। এখন ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। তারা অপূর্ণ, বেশির ভাগ স্বার্থান্ধ। তাদের উছিলা দরকার। দরকার পয়সাকড়ি। তাই তারা বিশেষ দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকে সেটা জন্ম হোক আর মৃত্যু, তাদের কাছে সবই সমান। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ৭ মার্চের ভাষণ শ্রদ্ধাভরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজালেও মৃত্যুবার্ষিকীতে কাঙালি ভোজের আলু, পটোল, পিয়াজ, রসুন কাটার সময় বাজানো তার প্রতি অবিচার এবং অশ্রদ্ধার কাজ। আমার দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। বঙ্গবন্ধু কী অপরাধ করেছেন, যে তার মৃত্যুদিনেও মুক্তি নেই? মরে গিয়েও তাকে চিৎকার করতে হয়? আর অপদার্থরা ফায়দা লোটে! জানি না আওয়ামী ঘরানার লোকজনের কবে বোধোদয় হবে।

ভয়াবহ বন্যার ছোবলে দেশ ক্ষতবিক্ষত। ঘরে বসে থাকতে না পেরে উত্তরবঙ্গে বন্যাদুর্গতদের পাশে গিয়েছিলাম। জানি না এটাই ধলেশ্বরী-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে জীবনের শেষ নৌযাত্রা কিনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মানকার চর থেকে নৌপথে একবার জামালপুরের বাউশী পর্যন্ত গিয়েছিলাম। চারদিকে হানাদার। কোনো স্বস্তি ছিল না। সামান্য অসতর্ক হলে জীবননাশের আশঙ্কা। তবুও গিয়েছিলাম। কয়েকবার আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু বেঁচে ছিলাম। সাড়ে তিন-চার বছর পর আবার জিঞ্জিরাম নদী হয়ে সানন্দ বাড়ি দিয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিরোধযুদ্ধে ভাটিপথে ছিলাম। সেবার বগুড়ার সারিয়াকান্দির আবদুল খালেক খসরু ছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা হেলিকপ্টার নিয়ে সিরাজগঞ্জের নিশ্চিন্তপুর চরে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমার পাশে বগুড়া যুবলীগের সভাপতি আবদুল খালেক খসরু বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাতবরণ করে। আমাদের আর কোনো ক্ষতি হয়নি। শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু খসরুকে হারানোর ক্ষতি আমি আর সামলে উঠতে পারিনি। আমরা কেউ কারও শত্রু ছিলাম না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনি সরকার আমাদের মুখোমুখি হয়েছিল। এবার যখন রৌমারীর সীমান্ত দাঁতভাঙ্গা পূর্ব পাখিউড়া থেকে শ্যালোতে, ফেরার পথে সানন্দ বাড়ির বিশাল জিঞ্জিরাম নদীতে এই ভরা বর্ষায়ও আমার স্পিডবোট ঢোকাতে পারিনি তখন আমার কবি নজরুলের— ‘নদীর এপার ভাঙ্গে ওপার গড়ে এই তো নদীর খেলা/  সকাল বেলার আমীর রে ভাই  ফকির সন্ধ্যা বেলা’। মনে পড়ছিল। রৌমারী আমার পুরনো পরিচিত জায়গা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন টিমকে সাক্ষাৎকার দিতে প্রথম রৌমারী গিয়েছিলাম। সেবার উঠেছিলাম হুমায়ুন কবিরের মামা আজিজ মাস্টারের বাড়ি। এবারও তার বাড়িতে এক রাত কাটিয়েছি। বড় ছেলে মাসুম বাড়ি ছিল না, মামুন ছিল। বড় আদর-যত্ন করেছে। একেবারে নিজের বাড়ির মতো মনে হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামী হান্নান, জয়নাল, আজিজুল, মশিউর ওরা পাগল হয়ে গিয়েছিল। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা দারুণ সহযোগিতা করেছে। যে কারণে ঢাকায় ফিরেই মতিঝিলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছি, যেখানে উচ্চ পদের সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি-বাড়ি, পিয়ন-চাপরাশি নানা সুবিধাসহ লাখ টাকা বেতন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা কেন? তাদের অনতিবিলম্বে ৫০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা দেওয়া হোক। আর ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযোদ্ধাদের জাতীয় স্বীকৃতি এবং প্রতি মাসে ৪৯ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা ও ’৭৫-এর পরবর্তী সরকারগুলো প্রতিরোধযোদ্ধাদের যে ক্ষতি করেছে— জমিজমা, বাড়িঘর দখল করেছে; সেগুলো ফিরিয়ে দিয়ে তাদের মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়া হোক। সত্য কথা বলতে কি, মনে হয় বর্তমান সরকারের কাছে জঙ্গিদেরও অত ভয় বা অসুবিধা নেই। পুলিশ প্রশাসন টোপ দিয়েছে, যারা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের পথ থেকে ফিরে আসবে এবং খবর দেবে তাদের ২০ লাখ করে পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু ’৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধাদের মোশতাক ও জিয়া সরকার যখনই গ্রেফতার করেছে, কাউকে কাউকে বন্দুকের আগায় উড়িয়ে দিয়েছে। আবার কাউকে কাউকে ফাঁসি, যাবজ্জীবন এবং নানা মেয়াদে জেল-জরিমানা করেছে। যেহেতু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম, সেহেতু তখন মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর একজনও পরিচয় দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের কাছ থেকে রাজাকার-আলবদরের চেয়েও জঘন্য ব্যবহার পেয়েছে। কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা আশায় বুক বেঁধে ছিল, কখন আমি দেশে ফিরলে অবস্থার পরিবর্তন হবে, তারা স্বীকৃতি পাবে। জাতির জন্য, জাতির পিতার জন্য তারা যে যৌবন ঝরিয়েছে তার মূল্যায়ন হবে। ৪১ বছরেও তারা যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে এখনো বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকারের কাছে স্বীকৃতি পায়নি, তখন তাদের হতাশ না হয়ে উপায় কী? এবার বাংলাদেশ প্রতিদিন ও বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল আমাকে আড়াল করে হলেও ’৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধাদের সম্পর্কে দেশবাসীকে কিছুটা জানানোর চেষ্টা করেছে। ঠিক আছে, আমাকে কোরবানি দিয়েও যদি মুক্তিযোদ্ধাদের বা ’৭৫-এর জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধযোদ্ধাদের কল্যাণ হয় সেখানে আমার আপত্তি কী? তাই সময় থাকতে বর্তমান সরকার কাদেরিয়া বাহিনী ও ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযোদ্ধাদের যথার্থ মূল্যায়ন করবে এমনটাই আশা করি।

বন্যার পানিতে সব ভাসিয়ে নেওয়ার সাত-আট দিন পর আমরা সেখানে পৌঁছেছিলাম। সাধারণ মানুষ কিছুটা সামলে নিয়েছিল। বন্যাদুর্গতদের বিশুদ্ধ পানি পেতে কষ্ট এমনটা ভেবে কয়েকশ প্লাস্টিকের বোতল ও হাজার লিটারের ট্যাংক নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম অন্যান্য কষ্ট থাকলে পানীয় জলের তেমন কষ্ট নেই। অনেক জায়গায় টিউবওয়েল আছে এবং বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় তারা বিশুদ্ধ পানীয় জল পাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির কারণে অনেক ক্ষেত্রে পেটের পীড়া ও অন্যান্য অসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়নি। ৯ আগস্ট সকালে পূর্ব পাখিউড়ার কয়েকটি ভাঙা বাড়ির মাঝে বাঁশঝোপের নিচে খুবই নোংরা একটা জায়গা আমরা নির্বাচন করেছিলাম। কিন্তু আমার সঙ্গীরা এবং এলাকার মানুষ সেই নোংরা জায়গা মুহূর্তের মধ্যে ঝাড়পোঁছ করে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলেছিল। প্রথম প্রথম আমি নদীর পাড়ে বসেছিলাম। তারপর গিয়ে বসেছিলাম একটা ভাঙা বাড়ির পাশে আম গাছের নিচে বাঁশের মাচার পাশে। আমার পাশে আড়াই-তিন বছরের বৃষ্টি নামের একটি মেয়ে বার বার বাঁশের মাচায় বসছিল আর পড়ে যাচ্ছিল। পাঁচ-ছয় বছরের ঊর্মি তাকে টেনে তুলছিল। আমার চিরাচরিত অভ্যাসমতো বসে বসে চকলেট বিলাচ্ছিলাম। তখনই প্রথম বৃষ্টির মাচা থেকে পড়ে যাওয়া আর ঊর্মির টেনে তোলা নজরে আসে। গত বছর ৩০৮ দিন অবস্থান কর্মসূচিতে ঘরের বাইরে ছিলাম। তখন একটা ছোট ক্যাম্প খাট সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেটা এ যাত্রায় নেওয়া হয়েছিল। যেটা দুজনে অনায়াসে নড়াচড়া করা যায়। তক্তার ওপর চাদর বিছিয়ে অনায়াসে শোয়া যায়। উত্তর পাখিউড়াতে একসময় সেটাতে শুয়েছিলাম। বসে যখন অনেকের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন খালি গায়ে বৃষ্টি আমার কোলে বসেছিল। আমাদের কাছে বাচ্চাদের কাপড় ছিল। একসময় বৃষ্টি আর ঊর্মির জন্য সোহেলকে দুটো কাপড় আনতে বলেছিলাম। এ যাত্রায় হাবিব-উন-নবী সোহেল অসাধারণ দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যেমন সবুর খান বীরবিক্রম, হামিদুল হক বীরপ্রতীক, শাহজাহান, ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান কিংবা ফজলুল হক বীরপ্রতীক অসাধারণ দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সোহেল, শহিদ, সাদেক, রফিকের মধ্যে অনেকটা তেমন দেখেছি। আনিস, ইঞ্জিনিয়ার খলিল, মজিদ কল্পনাতীত কাজ করেছে। মাইকম্যান শাহিন, আনোয়ার, রাঁধুনি তাহের বিশেষ করে কালু পাগলা যে ভূমিকা রেখেছে তার তুলনা হয় না।

সেটা ছিল ত্রাণকাজে আমাদের প্রথম দিন। বড় বড় কয়েক ডেকচি খিচুড়ি রান্না করেছিল। আমি যখন খেতে বসি তখন বাচ্চা, বুড়ো, মেয়ে, ছেলে মিলে পাঁচ-ছয়শ জন হবে। রৌমারীর কয়েকজন সাংবাদিক, শিক্ষক এবং সরকারি কর্মচারীও ছিলেন। বহুদিন পর তপ্ত খিচুড়ি মুখে দিয়ে বড় খুশি হয়েছিলাম। আমার বাড়িতেও অমন সুস্বাদু খিচুড়ি হয় না। রাঁধুনি তাহেরকে সঙ্গে সঙ্গে হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলাম। ওই অবস্থায়ও কয়েকজন দরিদ্র মহিলা কয়েক মুঠো ভাত এবং ছোট মাছের তরকারি এনেছিল। সেখান থেকেও কিছুটা তৃপ্তিসহকারে খেয়েছিলাম। সকালে একবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফেইচকার চর গিয়েছিলাম। পাখিউড়ার পশ্চিমে ভয়াল ব্রহ্মপুত্র যেখানে বড় নৌকা ধরতেই ভয় হয় সেখানে ছোট্ট স্পিডবোট ঢেউয়ের সঙ্গে তাল সামলাতে পারছিল না। ফেইচকার চরের ভাঙন এবং মানুষের দুর্দশা দেখে মনটা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। এত রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, মানুষের বিপদে এখন আমরা কিছুই করতে পারি না! পাখিউড়া থেকে দেড়-দুই ঘণ্টা ভাটিপথে শ্যালো চালিয়ে আমরা ঢোশমারী ডাটিয়ার চরে শ্যালো বেঁধেছিলাম। শ্যালোচালকদের মনে হয় জায়গাটা জানা ছিল না। ১০০ গজ ভাটিতেই চমৎকার জায়গা। কিন্তু তারা ১০০ গজ উজানে নৌকা বেঁধেছিল। হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক, আবদুল হাই, হাসমত নেতা, আনিস, সোহেল, সাদেক নেমে এদিক-ওদিক ঘুরছিল। ১০০ গজের মধ্যেই ছিল ঢোশমারী বাজার। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে লোকজন আসা শুরু করেছিল। শ্যালো থেকে নামার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কিছু প্রবীণ লোক কথা বলতে চাচ্ছিলেন। সেখানে করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র যারা ওখানে শিক্ষকতা করে তারাও ছিলেন। আমি নেমে দেখি নানা বয়সের হাজারো লোকের ভিড়। মাইকম্যান শাহিন ততক্ষণে জেনারেটরের আলো জ্বেলেছিল। আলোয় জায়গাটা ঝকঝক করছিল। লোকজন আবদার করছিল কিছু বলুন। আমার তেমন কিছুই বলার ছিল না। এ যাত্রায় কোথাও তেমন কিছু বলিনি। রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে এবং ঢোশমারীতে চাপাচাপির জন্য দুই কথা বলতে বাধ্য হয়েছি। কথা শেষে প্রবীণ মেম্বার মোকরম আলী জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় থাকবেন? বললাম কেন শ্যালোতে। বেশ বড় শ্যালো। যাতে দু-তিনশ লোক অনায়াসে থাকা যায়। তাতে থাকতে অসুবিধা কী। কিন্তু না, নবীন-প্রবীণ বহু লোকের অনুরোধ— আমাদের বাড়ি চলুন, আমাদের বাড়ি চলুন। সব থেকে কাছে মেম্বারের বাড়ি। তার স্ত্রী ছালমাও এখন মেম্বার (সংরক্ষিত)। কত আর হবে বড়জোর ১০০ গজ। দু-তিনটি ভাঙা টিনের ঘর। ঘরে সৌরবিদ্যুতের আলো জ্বলছিল। খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না, তবুও একটি রুটি খেয়েছিলাম। মানুষ যে কত দরিদ্র আর ভালো হতে পারে ঢোশমারী চরে তা লক্ষ্য করেছি। মকরম মেম্বার নদীতে বাড়ি ভাঙা মানুষ। তাকে ১৫ ডিসিমল জায়গা দিয়ে পাশের বাড়ির একজন সাহায্য করেছে। সে মেম্বারের চেয়েও দরিদ্র। কিন্তু জমির দাম নেয়নি। নদীর ঘাটে হাজার-বারোশ লোক এসেছিল। মেম্বারের বাড়িতেও ছেলে, বুড়ো, মহিলা সব মিলিয়ে তিন-চারশ হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই আবার ভিড়। ফজরের নামাজের পর একটু শুয়েছিলাম। মনে হয় সাড়ে ৬টায় আবার উঠে পড়ি। মেম্বার, বাড়ির ভিতর কয়েকটি চেয়ার দিয়েছিল। আমি বাড়ির বাইরে বসেছিলাম। ধীরে ধীরে লোকজন আসা শুরু করে। তখন বাজারের মধ্য দিয়ে ঘাটপাড়ে যেতে ইচ্ছা হয়। রান্নাবান্না কীভাবে করবে— সকালের নাস্তার কী হলো। এসব দেখতে গিয়ে দেখি বাচ্চারা রুটি খাচ্ছে। ১০-১২ জন মহিলা রুটি বানাচ্ছেন, গ্যাসের চুলায় চার সেকছেন আর বাচ্চারা নিচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে আনন্দে মন ভরে গেল। রান্নাবান্নার কাজে নিয়োজিত আনিসকে বললাম, তোমার রান্না শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে আসবে তাকেই রুটি দেবে। আমি একটু উত্তরে অষ্টমী ইউনিয়নের বড় চর দেখে আসি। এসি জামাল স্পিডবোট চালাতে তার খুব শখ। এ যাত্রায় সে খুব কষ্ট করেছে। সাধ্যমতো যতটা করার করেছে। সে এক টানে ইঞ্জিন স্টার্ট করে ফেলত। ৫ বা ৬ কিলোমিটার যেতে আমাদের ৭ মিনিট লেগেছিল। সঙ্গে ছিল ঢোশমারীর বিশ্ববিদ্যালরেছাত্র সজীব, মামাতো ভাই এ টি এম সালেক হিটলু, শহিদ। বড় চরে নামতেই অষ্টমীর চেয়ারম্যান আবু তালেব ছুটে এসেছিল। তাকে নিয়ে আরও উত্তরে ভাঙন দেখতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল নদীর মধ্যে পানি ফিকে উঁচু হয়ে আছে। চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করলে বলল তিন তলা প্রাইমারি স্কুল ভেঙে পড়েছে। সেটা ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার নদীর মধ্যে। জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম কম করে ২-৩ কিলোমিটার এবার ভেঙেছে। অষ্টমীর বড় চর এবার ছোট চরে রূপ নিয়েছে। পাশেই এক হাইস্কুল। প্রায় ২ মাইল পুবে প্রাইমারি স্কুল ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় হাইস্কুলের বিল্ডিং ভেঙে ফেলতে শুরু করে। হাইস্কুলের দালান ভাঙা প্রায় ৭৫-৮০ ভাগ শেষ। নদীও ভাঙতে ভাঙতে ভাঙা স্কুলের ২০০ গজের মধ্যে এসে গেছে। শেষ আগস্ট অথবা সেপ্টেম্বরে শুনছি আবার বন্যা হবে। এ যাত্রায়ই নদী সেখানে পৌঁছে কিনা কেউ বলতে পারে না।

লেখক : রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর