বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়াকে খোলা চিঠি

জাফরুল্লাহ চৌধুরী

খালেদা জিয়াকে খোলা চিঠি

ভালো কাজ করেছেন

দেশের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে ১৫ আগস্ট আপনার জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান বাতিল করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি মন্তব্য করেছেন তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি জিতেছেন।  একই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু শিশুর জন্ম হবে। কিছু মানুষের মৃত্যু হবে, কতক বিয়ে হবে, তালাক হবে, এমনকি শিশুর আকিকাও হবে। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভিন্ন গুরুত্ব আছে। এদিন দেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান দুই কন্যা ছাড়া তার পরিবারের অন্য সবাই নিহত হয়েছিলেন। এটা শোকের দিন। এদিনে জন্ম দিবস পালন না করাটা অবশ্যই ভালো কাজ।

খালেদা জিয়াকে ১৯৭২ সালে আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম যেদিন দেখি তখন তার চেহারায় বুদ্ধির দীপ্তি দেখিনি। কর্নেল জিয়াউর রহমান তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করার জন্য আমাকে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মইনুল রোডের ৬নং বাংলোতে বৈকালিক চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। স্টাফ রোডের প্রথম বাড়িতে থাকতেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। তার সঙ্গে দেখা করে পরে জিয়াউর রহমানের বাড়িতে পৌঁছি। জিয়া ডাকলেন, ‘পুতুল দেখ, বিলেত থেকে আসা ডাক্তার জাফরুল্লাহ এসেছেন’। ধীরপদে খাবার নিয়ে এলেন ২৪-২৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। সুন্দরী বটে, ধবধবে ফর্সা চেহারা, তবে আজকের বুদ্ধির ঝলক সেদিন দেখিনি। সামরিক অফিসাররা সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করেন, বুদ্ধিদীপ্তি বা লেখাপড়া তাদের বিবেচ্য নয়। নাশতার সময় খালেদা জিয়া কম কথা বললেন, কেবল খাবার উঠিয়ে দিলেন এবং বিদায়ের সময় বললেন ‘আবার আসবেন’। ছোট তারেক তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছিল।

ওই বছর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেওয়া প্রধানমন্ত্রী মুজিবুর রহমান জিয়াকে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্ব দেন। পরে বন্দর ও নৌমন্ত্রী জেনারেল এমএজি ওসমানীর পরামর্শে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেন ও ক্যান্টনমেন্টে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে বলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহ ও জিয়াকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে কমান্ডার ইন চিফ ও মেজর জেনারেল জিয়াকে ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ মনোনীত  করেন। জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধু যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সে দায়িত্ব নিতে তাকে রাজি করাতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনাটি ঘটত না- সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কারণে।

কিছু ভুল করছেন

৩৮ বছরের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পরে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা, কমিটির বড় সাইজ বা ক্রমানুক্রমে বয়োজ্যেষ্ঠতার হিসাব না মানা কিংবা পর্যাপ্ত নারী নেত্রীর স্থান না হওয়া অথবা নবীন তরুণদের সংখ্যাধিক্য ভুল কাজ নয়। ভুলটা হয়েছে অন্য জায়গায়। আপনার দলের কিছু চাটুকার দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক, সরকারের দমন নীতিতে ভীতসন্ত্রস্ত সিনিয়র নেতৃবৃন্দ যারা সম্ভবত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’র প্রাসঙ্গিকতা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে পুরো জাতীয় কমিটির মনোনয়নের দায়িত্ব আপনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আপনাকে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাস ও সম্মান প্রদর্শন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা তাদের দলের প্রতি আনুগত্যের অভাব ও দায়িত্ব এড়ানোর প্রচেষ্টা মাত্র এবং আপনাকে সবার চোখে আপনার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার প্রমাণের সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া।

শাস্ত্রী মহাশয়ের ‘তৈল’ লেখাটার অংশবিশেষের উদৃ্লতি সময়োপযোগী। তিনি লিখেছেন, ‘যে তৈল দিতে পারিবে তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে, আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।’

এসব নেতা প্রকৃতপক্ষে ভীত মেষশাবক সমতুল্য। বিভিন্ন অজুহাতে তারা আপনাকে আন্দোলনের পথে না নিয়ে গুলশানের দুই বাড়িতে অন্তরীণ করে রেখেছেন।

আমার মনে হয়, দীর্ঘদিন আপনি বিএনপির গঠনতন্ত্র পড়েননি এবং আপনার মনোনীত নির্বাহী কমিটির সদস্যদের অধিকাংশও পড়েননি। আপনার স্থায়ী কমিটির নেতাদের উচিত ছিল আপনাকে অযথা তেল না দিয়ে, গঠনতন্ত্রের নির্ধারিত বিষয়সমূহ আপনার সামনে তুলে ধরা এবং গঠনতন্ত্র মোতাবেক আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য দেওয়া। আপনাদের গঠনতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮ সালে আগস্ট মাসে। ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র তৈরিতে জিয়াউর রহমানকে প্রভাবিত করেছিলেন প্রবাসী সরকারের বৈদেশিক সচিব খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রিয়জন মাহবুবুল আলম চাষী, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সচিব ড. এম এ সাত্তার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্যারামেডিকদের সঙ্গে আলাপ করে জিয়াউর রহমান বুঝেছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দেশে স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার সঠিক পথে এগোচ্ছে। তাই এটা তার ১৯ দফার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদভিত্তিক গণঐক্য, জনগণের গণতন্ত্র, সামাজিক অন্যায় ও বৈষম্য দূরীকরণ, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন, স্থানীয় এলাকা সরকার ও বিকেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ক্ষমতা সৃষ্টি, নারী সমাজের প্রগতি, যুবশক্তির সদ্ব্যবহার, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পল্লী উন্নয়ন, গণমুখী কৃষিনীতি, সমবায় ও গণতান্ত্রিক শ্রমনীতি, সার্বিক উন্নয়নভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, জীবননির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম, প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনী, ধর্মীয় শিক্ষা প্রভৃতি ছিল জিয়াউর রহমানের বিএনপি সৃষ্টির ২৯ লক্ষ্য ও আদর্শের অন্তর্ভুক্ত।

ঘোষণায় ২৯টি লক্ষ্য ও আদর্শের কথা থাকলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের গঠনতন্ত্রে ১৭টি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা লেখা আছে। কোথাও বলা হয়নি বা লেখা হয়নি যে, চেয়ারপারসন একলা সব কমিটির সদস্যদের মনোনয়ন দেবেন। চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়ার ক্ষমতা ১০% সদস্য মনোনয়নদানে সীমাবদ্ধ। তবে তার মত নিয়ে স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও জাতীয় কাউন্সিলের মিটিং ডাকতে হবে। প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং কমিটির মেয়াদ তিন বছর এবং সদস্য সংখ্যা হবে ৩৫১ জন + চেয়ারপারসনের মনোনীত ১০%। বছরে অন্তত পক্ষে একবার জাতীয় কাউন্সিলের সভা হবে এবং প্রতি তিন মাস পর জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা হতে হবে। প্রয়োজনে চেয়ারম্যান যে কোনো সময় তার ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা আহ্বান করতে পারবেন।

সব মনোনয়নদানের জন্য গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তবে পরিষ্কারভাবে লিখিত আছে যে, ‘দলের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে চেয়ারম্যান দলের সর্বময় কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ, তদারক ও সমন্বয় সাধন করবেন।’

আপনার সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বিশেষত একজন ছাড়া নামের আদ্যাক্ষরে এম অলঙ্কৃত নেতারা আপনাকে দিয়ে গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করিয়েছেন, যে ক্ষমতা আপনাকে দেওয়া হয়নি সে ক্ষমতা ব্যবহার করিয়ে কর্মীদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করিয়েছেন। আপনাকে পক্ষান্তরে একরোখা একনায়ক রূপে চিত্রিত করেছেন। তাদের উচিত ছিল আপনাকে এসে বলা, আপনার মনোনীত তালিকাটি প্রকাশের আগে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং অন্যান্য আরও ৮-১০ জন সিনিয়র নেতাকে দেখান। তা হলে বিবিধ প্রশ্নের উদ্ভব হতো না, ক্ষেভের সৃষ্টি হতো না, পরিবারতন্ত্র এত পাখা বিস্তার করতে পারত না। সুখবর যে, তারেক ছাড়া আপনার পরিবারের অন্য কেউ এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। দলে গণতন্ত্র না থাকলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।  

একলা দু-তিনজন কাছের মানুষের কান কথা শুনে এত বড় একটা জাতীয় কমিটি গঠন করার পরও সবার মন রক্ষা করতে পারেননি। পদ পাওয়ার পরও খুশি হয়নি, যেমন হয়েছে শিরীন সুলতানার ক্ষেত্রে। নারী দলে তার উল্লেখযোগ্য কাজ আছে, সবার প্রিয়, সব সময় খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন তাকে করা হয়েছে স্বনির্ভর সম্পাদক। যেখানে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারার সম্ভাবনা নেই। যুগ্ম মহাসচিব ৭ জনের মধ্যে একজন মহিলাও নেই, ঠিক একই ভুল হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদকের ক্ষেত্রে সাতজনের মধ্যে একজনও মহিলা নেত্রী নেই। ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপিকাকে পাওয়া গেল না?

ধর্ম বিষয়ে তিনজন সহ-সম্পাদকের যৌক্তিকতা কি?

জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধার স্থান হয়নি। স্থায়ী কমিটিতে ১৯ জনের মধ্যে মাত্র একজন মহিলা। মহাসচিবসহ বিভিন্ন সম্পাদক সংখ্যা ৬৪ জন, তন্মধ্যে মহিলা আছেন মাত্র চারজন। পুরো দফতরে সব বিশিষ্ট পদ ও সহ-সম্পাদক, সহকর্মী সংখ্যা ১২২ জন, তন্মধ্যে মহিলা সংখ্যা সাতজন।

এটা দুর্ভাগ্যজনক। গঠনতন্ত্র অনুসারে জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ন্যূনতম ১০ ভাগ মহিলা সদস্য হওয়ার কথা যা ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩% উন্নীত হবে। ১২২ জন কর্মকর্তা জাতীয় কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার বিধানও পালিত হয়নি।

বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের জন্য জিয়াউর রহমান প্রথম ১৯৮০ সালে মঈদুল ইসলামের নেতৃত্বে নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট ড. আমেনা রহমান ও আমাকে নিয়ে নারী উন্নয়ন কমিটি করেছিলেন। কমিটির সুপারিশ ছিল প্রাইমারি স্কুলে ন্যূনতম ৫০% মহিলা শিক্ষক নিয়োগ, সব সরকারি ও অনুদানপ্রাপ্ত হাইস্কুলে কমপক্ষে দুজন শিক্ষিকা নিয়োগ, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রী সংখ্যা ক্রমে ৩৩% উন্নীতকরণ এবং সব সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মহিলাদের ন্যূনতম ১০% নিয়োগ নিশ্চিতকরণ যা ক্রমে বাড়িয়ে ২০% পৌঁছার চেষ্টার কথা। জিয়াউর রহমান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্যারামেডিকদের সাইকেল চালানো দেখে উদ্ধুদ্ধ হন এবং পুলিশে মহিলা নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুজন কর্মী ঢাকা পুলিশের প্রথম রিক্রুট।

চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা কাউন্সিলে ১৫ জন উপদেষ্টা থাকার কথা, অবশ্য প্রয়োজনে সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষমতা চেয়ারম্যানকে দেওয়া আছে। তাই বলে কি অতিরিক্ত ৫৮ জন উপদেষ্টা। বাজারে প্রচলিত ধারণা যে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তচিন্তার পর্যাপ্ত একাডেমিকদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ নেই। বিএনপির একনিষ্ঠ সুহৃদ অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের নাম উপদেষ্টার তালিকায় নেই। তাকে খালেদা জিয়ার প্রধান উপদেষ্টা করলে বিএনপির লাভ হবে এবং খালেদা জিয়া দেশবাসীর প্রশংসা পাবেন। গুণী শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহী ও সাহসী হতেন গুণীজনের কদর দেখে। জাতীয় স্থায়ী কমিটি ও উপদেষ্টা কাউন্সিলের মেয়াদ নির্দিষ্ট করা নেই গঠনতন্ত্রে।

গঠনতন্ত্রকে সুনির্দিষ্টভাবে অনুসরণ না করায় কেবল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। তাই নয়, জাতীয় কমিটির অনেক সদস্য সুপরিচিত নন এবং অধিকাংশের সাধারণ সদস্য পদের চাঁদা দেওয়া নেই। কয়েকজনকে জাতীয় কমিটির পরিবর্তে মহানগর কমিটির দায়িত্ব দিলে ন্যায্য হতো। বার্ষিক পাঁচ টাকা চাঁদার বিধান কি শেষ হবে না? বার্ষিক চাঁদার হার ন্যূনতম ১০০ টাকা ধার্য করা বাঞ্ছনীয়।

বিএনপির চাঁদা পরিশোধ করা সদস্য সংখ্যা কত? জাতীয় পরিকল্পনা ও অর্থ, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় শাসন ও পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা, শ্রম কল্যাণ, মহিলা ও যুব সম্প্রদায়, আন্তর্জাতিক বিষয় বিশেষত ভারতীয় আগ্রাসন, অনুপ্রবেশ, একাধিক ট্রানজিট ও বাংলাদেশের সঙ্গে সিকিম ভুটান তুল্য ব্যবহার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধ বিষয়ে ‘দলের (বিএনপি) সদস্য নয় অথচ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী যোগ্যতাসম্পন্ন ও সুদক্ষ ব্যক্তিদের কো-অপ্ট করার বিধান আছে।’ গণতন্ত্রে এসব বিষয়ে অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ফেরদৌস আজিম, উপাচার্য পারভীন হাসান, নারী পক্ষের শিরীন হক, সুজনের বদিউল আলম মজুমদার, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আইনুন নিশাত, অধ্যাপক (ড.) এম আর খান, বারডেমের ডা. এ কে আজাদ খান, আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞ ড. এস এ খান, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আইন বিশেষজ্ঞ ডা. শাহদীন মালিক, বিআইডিএসের বিনায়ক সেন, প্রাক্তন আমলা আলী ইমাম মজুমদার, সাদত হোসেন, শওকত আলী, আলী আকবর খান প্রভৃতি বিশিষ্টজনকে কমিটিসমূহে কো-অপ্ট করলে কমিটির কাজের গুরুত্ব বাড়বে এবং বিএনপি জ্ঞানসমৃদ্ধ হবে ও ভবিষ্যতে দেশ শাসনে আপনার সুবিধে হবে। অনুগ্রহ করে কূপমণ্ডূকতা পরিহার করুন। আপনি সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন, আপনার গঠনতন্ত্রের নির্দেশ মোতাবেক ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও মহানগর কমিটিসমূহ, নারী দল, ছাত্রদল ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনসমূহে দুই বছর পরপর যথাযথভাবে নির্বাচন করে উৎসাহী কর্মীদের বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ না দিয়ে। পার্টির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ভিত না নিলে জাতির জন্য গণতান্ত্রিক সুবিধা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। ঘরকুণো কর্মীরা সন্ধ্যায় আপনার গুলশান অফিসে ভিড় করবে, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনার ডাকে মাঠে নামবে না। এরা সুখের পায়রা এবং কতক বয়োবৃদ্ধ। তারা তাদের পরিজনকে জাতীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার কাজে বেশি ব্যাপৃত থাকবেন যেমন ঘটেছে ২০১৬ সালের আপনার জাতীয় কমিটির ক্ষেত্রে। যতদিন গয়েশ্বর নিতাই তাদের মেয়েদের কমিটিতে ঢুকাতে ব্যস্ত থাকবেন, ততদিন সংখ্যালঘু রাজনৈতিক কর্মীরা বিএনপিতে ভিড়তে উৎসাহী হবেন না। বিএনপি জাতীয় কমিটিতে পরিবারতন্ত্র জিন্দাবাদ-১০ নেতার স্ত্রী, ১১ নেতার ছেলে, ৬ ভাইবোন স্থান পেয়েছেন অথচ শিষ্টাচার বজায় রেখে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আপনি ছেলের বউকে জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে স্থান দেননি। স্থায়ী কমিটিতে কমপক্ষে চারজন মহিলা অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। ৪-৬ কোটি মানুষের প্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা গঠনতন্ত্র সংশোধন করে প্রয়োজনে ২৫ জন করলে আপত্তি কোথায়? সদস্যরা পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ২-৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন, মনোনীত নন। চেয়ারম্যানের মনোনয়নে আসবেন ৩-৪ জন মাত্র। জাতীয় কমিটিতে ’৭১ যুদ্ধাপরাধী আবদুল আলীম এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্থান অযৌক্তিক ও ভুল সিদ্ধান্ত। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে তো কোনো দলীয় রাজনীতিতে নেই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের নিয়ন্ত্রণ

এটা সর্বজনবিদিত যে, ভারত সুকৌশলে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে, ভারতের জাতীয় স্বার্থে এবং ভারতকে অখণ্ড রাখার অব্যাহত প্রচেষ্টায়। ৫ জানুয়ারি (২০১৪)র ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার কৃতজ্ঞতায় আওয়ামী লীগ সরকার বন্ধুত্বের নামে নতজানু নীতি মেনে নিয়েছে, মধ্যে মধ্যে আপনিও ভারতের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করছেন যা দেশবাসীর চোখে সুবিধাবাদী রাজনীতি বলে মনে হয়েছে। এ সরকারের বদান্যতায় প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে চার বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স যাচ্ছে, প্রতি সপ্তাহে একজন বাংলাদেশি মারা যাচ্ছে বিএসএফের হাতে, রামপালের উল্টোদিকে পশ্চিমবাংলার সুন্দরবন এলাকা রাঙ্গাবেলীতে (যা অতীতে আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র না করে মাত্র ১৫% মূলধন দিয়ে ভারত রামপালে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করতে উদ্ধত। আপনি এ সম্পর্কে মৃদু প্রতিবাদ করেছেন, আপনার দলকে অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যোগ দিতে নির্দেশ দেননি।

ধারণা করা হয় যে, সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় গোয়েন্দার (RAW) অনুচর রয়েছে বাংলাদেশে, প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে। তারা গুলশানে জঙ্গি ঘটনার প্রতিহত করেনি। বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাগত সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার বিল ভারত পাস করেছে। জেনারেল মঞ্জুর হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে দীর্ঘ কারাদণ্ডের ভয় দেখিয়ে জাতীয় পার্টির এরশাদকে আওয়ামী লীগের অনুগত করিয়েছেন। ভারত যেভাবে মাওবাদী ও অন্যান্য মুক্তিকামী দলের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছে, একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের স্বনির্বাচিত সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চুপ করাচ্ছে গুপ্তহত্যা ও ক্রসফায়ারে। ভারতের ইঙ্গিতে ১৪-১৫ হাজার বিএনপি কর্মী এখনো জেলে আছে। তাদের পুরো তালিকা আজও প্রকাশিত হয়নি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও কয়েক হাজার আছে। পুলিশের ঘুষবাণিজ্য বন্ধের বিরুদ্ধে একবারও রাস্তায় নামার চেষ্টা করেননি। আপনাকে বিব্রত করার জন্য সরকার জামায়াত ইস্যু প্রায়শ তুলে ধরছে। আপনি পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ইস্যু এনে যোগ করাচ্ছে।

জনগণ পরিবর্তন চায়, দুর্নীতিমুক্ত সুষ্ঠুু গণতন্ত্রের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে। দেশবাসী কেন্দ্রিকতা থেকেও মুক্তি চায়।

আপনার করণীয়

আজকে আপনি জিয়াউর রহমানের সুন্দরী বালিকা বধূ নন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আপনার পরিশ্রম ও ধীশক্তির বলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে দু-দুবার নির্বাচনে জয়ী করিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, চার-ছয় কোটি বাংলাদেশের মানুষ আপনার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তাদের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে, দায়িত্ব আছে ভালোভাবে তারেককে দেশে ফিরিয়ে এনে আপনার ন্যায় নিজগুণে এবং সততা ও পরিশ্রমে বলীয়ান হয়ে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আপনার স্থানটা নেওয়ার চেষ্টা করুক সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, দুর্নীতি ও গুণ্ডামির মাধ্যমে নয়, জিয়াউর রহমানের ন্যায় সততার ভিত্তিতে। 

বিএনপির গঠনতন্ত্র সংস্কার

জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণা ও গঠনতন্ত্রের সংশোধন প্রয়োজন। এ নিমিত্তে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন, দিলারা চৌধুরী, আসিফ নজরুল ও মাহবুবুল্লাহ প্রমুখকে দিয়ে কমিটি করে দিন, সময় দিন ১৫ দিন। তাদের সুপারিশসমূহ আলোচনা করুন জাতীয় কাউন্সিল ও স্থায়ী কমিটির জরুরি মিটিংয়ে। পরপরই ইউনিয়ন, উপজেলা ও মহানগর কমিটিসমূহ এবং ছাত্রদল, নারী দল ও শ্রমিক দলে নির্বাচন দিন। নির্বাচন হবে বিএনপির বার্ষিক ১০০ টাকা চাঁদা দেওয়া সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে। ইউনিয়নের ওয়ার্ড কাউন্সিলে ৫১ জনের নির্বাহী কমিটি অযৌক্তিক। ৭১ জনের ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটির যৌক্তিকতা কতটুকু তা বিবেচনায় নিতে হবে। ২৫ বছরের অধিক বয়সী কেউ ছাত্রদলের নেতৃত্বে থাকবে না। কে কোন নেতার বউ বা মেয়ে সেটা বিবেচ্য হবে না। বিবেচিত হবে ওয়ার্ডের বিএনপি সদস্যরা তাকে চিনে কিনা, তার ওপর বিভিন্ন শ্রেণির মহিলাদের ভরসা আছে কিনা। কোনো নেতাকে একাধিক পদের দায়িত্ব দেওয়া সমীচীন নয়।

পার্টিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। এতে পার্টির সর্বস্তরে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হবে। তারা দেশের জন্য জীবন দিতে পিছপা হবে না। যদি পার্টি তাদের পরিবারের দায়িত্ব নেয়। জেলে থাকা কর্মীদের পরিবারের সঙ্গে অনুগ্রহ করে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। জেল থেকে বেরুলে অবশ্যই তাদের আপনার অফিসে ডেকে এনে আলাপ করবেন, সাহস দেবেন। এরূপ মিটিংয়ে অবশ্যই মহাসচিব ও আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে সঙ্গে রাখবেন। 

দলে সংখ্যালঘু সদস্যদের স্বল্পতার ন্যায় বিএনপিতে বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যার দরিদ্রতা আছে।

স্থায়ী কমিটি ও উপদেষ্টাদের মেয়াদ দুই বছরের মেয়াদে সীমিত করুন। উপদেষ্টাদের বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত করুন, কতককে জেলা কমিটির সঙ্গেও যুক্ত করে দিতে পারেন।

জনগণের সনদ

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সিনিয়র নেতা, ছাত্রদল, যুবদল ও মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে স্থির করা ‘জনগণের সনদ’।

জনগণের সদস্যদের রূপরেখার খসড়া দুই মাসের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা করে চূড়ান্ত করুন। কিছু সুপারিশ—

সামরিক বাহিনীর দরে সব শ্রমিক ও দরিদ্র পরিবারদের রেশন সুবিধা প্রদান, জীবনযাত্রা ব্যয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে স্থির হবে শ্রমিকের বেতন।

সব শ্রেণির জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে শুরুতে দুজন এবং ২০২৫ সালের মধ্যে চারজন গ্রাজুয়েট ডাক্তারের সার্বক্ষণিক অবস্থান নিশ্চিতকরণ। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে ইসিজি, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও অপারেশন ব্যবস্থা থাকবে। রেফারেল পদ্ধতির মাধ্যমে কঠিন রোগাক্রান্তদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা চালু করা হবে, সুলভে বিকল কিডনি, ক্যান্সার ও হৃদরোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে। জিপির রেফারেল স্লিপ ছাড়া কোনো রোগী সরাসরি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ভিড় করতে পারবে না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ৪৫০টি ওষুধের মূল্য অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে। দেশে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়া হবে।

প্রত্যেক শহরে জেনারেল প্রাকটিশনার পদ্ধতি চালু হবে যেখানে সব নাগরিক পরামর্শ ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিনা খরচে পাবেন। সরকারি বেতনভুক্ত চিকিৎসক ও শিক্ষকরা কোনোরূপ প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা টিউশনি করতে পারবে না। বিচারপতিদের সান্ধ্যকালীন পরামর্শ করতে দেওয়া যেমন অন্যায়, ঠিক তেমনি বিঘ্ন সৃষ্টি করে সরকারি চিকিৎসক ও শিক্ষকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে। হজরত আয়েশা, আবুবকর, ওমর, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সূর্য সেন, ইলামিত্র, প্রীতিলতা ওয়ার্দার, বেগম রোকেয়া, মুজিবপত্নী ফজিলাতুন নেছা, সব জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের বীর ও বীরাঙ্গনাদের কাহিনী পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

নিশ্চিত করা হবে মফস্বলের স্কুল-কলেজ থেকে পাস করা ৫০% ছাত্রের স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্বদ্যািলয়ের ভর্তির কেন্দ্রিকতার নিয়ম বাতিল করে সরাসরি বিভাগে মৌখিক বা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারবে। মাদ্রাসা শিক্ষাতে বিজ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধ, অঙ্ক, ইংরেজি ও কম্পিউটার শিক্ষা সংযুক্ত করা হবে।

সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।

সব সরকারি কর্মকর্তা ও বিচারপতিরা নিয়োগের সময় এবং প্রতিবছর তাদের পুরো সম্পদের বিবরণ জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। এতে দুর্নীতি কমবে।

গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে সারা দেশকে ১০টি প্রদেশ বা ১৭টি স্টেটে ভাগ করে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে পররাষ্ট্র, বৈদেশিক বাণিজ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক, আন্তঃপ্রদেশ স্টেট যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিমান ও নৌবন্দরসমূহ, বিজিবি, সামরিক ব্যবস্থাপনা, Tertiary Care হাসপাতালসমূহ ও কর ব্যবস্থাপনা। মেডিকেলসহ সব শিক্ষা, পুলিশ, চিকিৎসা, আন্তঃজেলা যোগাযোগ প্রভৃতি হবে প্রদেশ বা স্টেট শাসনের অন্তর্ভুক্ত। হাইকোর্ট প্রদেশে অবস্থিত হলেও নিয়ন্ত্রিত হবে সুপ্রিমকোর্ট দ্বারা। একটি অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিকতার স্তরের নাম বিভাগ। বিভাগে জনগণের কোনো লাভ হয় না। বিভাগ বিলুপ্তির সুপারিশ ছিল ১৯৩৪ সালে ফ্লাউড কমিশনের। প্রাদেশিক বা স্টেট গভর্নর কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক মনোনীত হতে পারে বা সরাসরি স্থানীয় জনগণের ভোটেও নির্বাচিত হতে পারে। 

কোনো রাজনৈতিক কর্মী সরাসরি খুনে জড়িত না হলে, অভিযুক্ত রাজনৈতিক কর্মী এক মাসের মধ্যে জামিন পাবে। ১০০ দিনের মধ্যে বিচার চূড়ান্ত করতে হবে। বিচারকালীন অভিযুক্ত রাজনৈতিক কর্মী দ্বিতীয় বা প্রথম শ্রেণির ডিভিশন পাবেন।

পুলিশকে দলীয় পাণ্ডা হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা হবে তাদের কাজ। কেবল ঘুষবাণিজ্যে জড়িত ও দলীয় পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ পুলিশের বিচার হবে, অন্যদের নয়।

ভারতীয় সংস্কৃতি ও বাণিজ্যিক আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি পানির ন্যায্য হিসাব আদায় করা হবে প্রতিবেশী ভারত থেকে, নতুবা কোনো ট্রানজিট নয়।

আপনার হাতে বেশি সময় নেই

২০ দলের বাইরের বিরোধী দলসমূহকে একত্রিত করে বাংলাদেশে জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সুসংহত করার জন্য আপনার হাতে সময় আছে বড়জোড় নয় মাস। সম্ভবত এ সময়ের মধ্যে আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় রাজনীতির আলোকে বিচারের রায় বেরুবে। এ কয়েক মাস পরিশ্রম করলে জনগণের রায় আপনার পক্ষে আসার সম্ভাবনা সমধিক।

ইতিমধ্যে তারেক রহমানের মামলার রায় বেরিয়েছে। অনৈতিক কমিশন নেওয়ার মামলায় আদালত তারেক জিয়ার সাত বছরের জেল দিয়েছে। এটা কি সুষ্ঠু বিচারের রায় না রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এর ফয়সালা ছাত্রদলের ২০-৩০ জনের মিছিলে হবে না, এতে কেবল আপনাদের শক্তির অপচয় এবং ভুল কাজ। ফয়সালা হবে মূলত সুষ্ঠু গণতন্ত্রের আন্দোলনে এবং উচ্চ আদালতে। স্মরণযোগ্য যে, বিচারপতিদের মধ্যে প্রাক্তন ছাত্রলীগের কর্মীদের বাহুল্য রয়েছে। তা হলেও কতক জজ সাহেবের বিবেক নিশ্চয় এখনো কার্যক্ষম এবং স্বল্প সংখ্যক বিচারপতির ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী সচেষ্ট রয়েছেন।

মান্না, মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমানের জামিন না দেওয়া এবং আমার দেশ ও অন্যান্য কয়েকটি মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য ভবিষ্যতে বিচারকদের জনতার আদালতে বিচার হতে পারে।

ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্বার্থে নিয়মিতভাবে সকাল ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত আপনার বাড়িতে তৃণমূল কর্মীদের সাক্ষাৎ দিন। কর্মীদের দেখভাল করার জন্য একজন ৫০ অনূর্ধ্ব উচ্চশিক্ষিত, রাজনীতির ভাষা ও শিষ্টাচারের সঙ্গে পরিচিত কিন্তু খয়ের খা নয়, এরূপ একজন মহিলা বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তার বিশেষ দায়িত্ব হবে বিভিন্ন কমিটির কার্যকলাপের সারসংক্ষেপ এবং অন্ততপক্ষে ১০টি দৈনিক পত্রিকার মুখ্য সংবাদগুলো নিয়ে আপনার সঙ্গে প্রতিদিন আলোচনা করা। আপনার রাতের গুলশান অফিসের সময় সন্ধ্যায় করলে ভালো হবে।

প্রতি মাসে আপনাকে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে ন্যূনতম দুটি করে জনসভা করতে হবে। আপনার ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য হবে দেশের মেগা দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, খায়রুল হকের মতো বিচারপতিদের আর্থিক স্বার্থের বিনিময়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে রায়, সরকার মনোনীত পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ৪০ হাজার কোটি টাকা সরকারি ব্যাংক থেকে লুটপাট, কুইক রেন্টাল মারফত কুইক প্রফিট যা পরে সরকারের কিছু ব্যক্তির পকেটে ফেরত আসা, কি করে ৭ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুর ব্যয় ত্রিশ হাজার কোটি টাকাতে পৌঁছাল, দুর্বিষহ জীবনযাত্রার ওপর নতুন করে বর্ধিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ভবিষ্যতে দেশের ক্ষতির কথা, প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বিশেষজ্ঞ সন্তানের বেতনভাতা কত এবং কোন মুদ্রায় পরিশোধিত হয়, সেলফোন ব্যবসায়ীদের Market Development Surcharge এর কে কত অংশ পায়, প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিয় গভর্নরের ভারতীয় আইটি এক্সপার্ট রাকেশ আস্তানার কারণে বা সম্পৃক্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভয়ানক ক্ষতি, ভারতীয় পরামর্শ সময়মতো না আসায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৪ জন সামরিক কর্মকর্তা এবং গুলশানে জঙ্গি হামলায় ২২ জনের প্রাণহানি, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ভারতীয়দের ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের পরও আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা প্রদানে ভারতের একগুঁয়েমি ও অনীহা, সীমান্তে প্রতি সপ্তাহে গুলি করে হত্যা, নোয়াখালীর মহুরীর চরে স্থলসীমান্ত নিয়ে ভারত সরকারের নতুন আবদার, পানির দামে ট্রানজিট ফি প্রভৃতি জনগণকে নাড়া দেবে। একই তথ্য বিশেষত ভারতের অনৈতিক কার্যকলাপের কথা বারে বারে বলতে হবে। মাত্র দুবার এ সম্পর্কে মৃদুভাবে উল্লেখ করায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছেন। জনসভায় শক্তভাবে এসব তথ্য উপস্থাপন করুন, ভারত সরকারের চিন্তায় পরিবর্তন আসতে বাধ্য। 

১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানী যে ঐতিহাসিক দায়িত্বভার নিয়েছিলেন আপনাকে সেই দায়িত্বভার নিতে হবে ‘ইসলামাবাদের জিঞ্জির ছিঁড়েছি, দিল্লির অনুগত হওয়ার জন্য নয়’। বিভাগ বিলুপ্ত করে জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন কেন্দ্রিকতার বিপরীতে কীভাবে ‘স্থানীয় এলাকার সরকার’ প্রদেশ বা স্টেট সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে অধিকতর দেশ পরিচালনায় সম্পৃক্ত করবেন তা জনসাধারণকে অবহিত করুন।

দুর্নীতির কারণে সরকারের তহবিল ফুরিয়ে গেছে বলে কি, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা পুরো পেনসনের টাকা একবারে পাবেন না? আপনার দৃঢ়চেতা পদক্ষেপ আমাদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত নিরাপদ হবে এবং তারেক জিয়ার দেশে ফেরার পথ সুগম হবে। জাতীয় ঐক্যে বন্ধ হবে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ।

জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। বুঝেশুনে সবার সঙ্গে আলাপ করে জামায়াত সম্পর্কে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিন। দেশবাসীর কাছে তাদের পুনরায় ক্ষমা চাইতে হবে।  অধ্যাপক গোলাম আযম প্রদর্শিত ১৯৯১ সালের একক তৃতীয় ধারার রাজনীতি হতে পারে জামায়াতের জন্য মঙ্গলকর কূটকৌশল।

অচিরে জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে সম্মিলিত বিরোধী দল হিসেবে অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বাসদের খালেকুজ্জামান, জাসদের আ স ম আবদুর রব প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে এক মাসের মধ্যে প্রথম জনসভায় অংশগ্রহণের ঘোষণা দিন। বিএনপির বর্তমান জোটের নেতারা তো থাকছেনই, আপনি জেলে থাকলেও সম্মিলিত বিরোধী দলের বিজয় সুনিশ্চিত। জয় হোক সুষ্ঠু জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্রের।  পতন হবে প্রতারণার উন্নয়ন ও সরকারের মেগা দুর্নীতির। কেন্দ্রিকতা নয়, নির্বাচিত স্থানীয় সরকারই লক্ষ্য।

লেখক : ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

ই-মেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর