শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

মানুষ এবং শয়তানের মৌলিক পার্থক্য!

গোলাম মাওলা রনি

মানুষ এবং শয়তানের মৌলিক পার্থক্য!

শয়তান বলতে আমরা সাধারণত ইবলিশকেই বুঝি। কিন্তু ব্যাকরণগতভাবে শয়তানের রয়েছে বহুরূপী অর্থ এবং ঐতিহাসিক তাত্পর্য। শয়তান শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল হিব্রু ভাষায় যার অর্থ শত্রু অথবা কুমন্ত্রণাদাতা। আরবি ভাষায় শয়তান অর্থ ছাই ফেলার পাত্র বা ছাইদানি, দূরবর্তী অস্পষ্ট কিছু, অশুভ আত্মা, নিষ্ঠুর ও ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তি। পাপাত্মাদের অধিপতি ইত্যাদি।  হিব্রু ভাষায় নাজিলকৃত বাইবেল বা ইঞ্জিল শরিফে শয়তান শব্দটি ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ বাধা প্রদানের মাধ্যমে কোনো কিছুর উৎপাদন। উন্নতি এবং বিকাশকে রুদ্ধ করে দেওয়া। অন্যায়ভাবে বিরোধিতা করা। বিরোধী হওয়া অথবা বৈসাদৃশ্য বা বৈপরীত্য সাধনের জন্য উত্থাপন করা বা তুলে ধরাকেও শয়তান হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর সব ধর্মেই শয়তানের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। সাধারণত তিনটি শ্রেণিকে শয়তান বলে অভিশাপ প্রদান করা হয়। ইবলিশ ছাড়া মানুষ ও জিন জাতির অনেককে শয়তান বলে গালি দেওয়া হয়।

মানুষ শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ ইনসান। বিখ্যাত সাহাবা হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন— মানুষের সহজাত ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটির কারণেই তাকে ইনসান বলে ডাকা হয়। ইনসানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে হিউম্যান শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজি ব্যাকরণে ইনসান শব্দের উৎসমূল হিসেবে নাসিয়া শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ ভুলে যাওয়া। সুতরাং মানুষ অর্থাৎ ইনসানের মৌলিক চরিত্র হলো ভুলে যাওয়া এবং ভুল করা। এই প্রসঙ্গে ইমাম সাদিক (রহ.)-এর বক্তব্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ভুলে যাওয়া এবং ভুল করার মধ্যেই মানুষের মহত্তম বৈশিষ্ট্যসমূহ ফুটে উঠেছে। মানুষের রোগ, শোক, হিংসা, ক্রোধ, প্রেম, ভালোবাসা, মিলন, বিচ্ছেদ ইত্যাদিকে যদি ভুলে যাওয়ার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা না থাকত তাহলে পৃথিবীতে যে কি মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো তা কল্পনাও করা যায় না! অন্যদিকে, ভুল করা, সংশোধন হওয়া, ভুল থেকে ফিরে আসা এবং ক্ষমা করার কারণেই মানব সভ্যতা দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে।

পৃথিবীর সব ধর্ম, সব মতাদর্শ, সব বিজ্ঞান এবং মহামানবগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, ভুলে যাওয়া কোনো অপরাধ বা পাপ নয়। আবার ভুল করা এবং পাপ করাও এক জিনিস নয়। ভুল করাকে মানুষের বৈশিষ্ট্য বলে সবাই স্বীকার করলেও পাপ করাকে মানুষের বৈশিষ্ট্য বলে মানতে রাজি নয় কেউই। পাপ হলো এমন একটি জটিল রোগ যা কখনো দেহমনের জটিল জৈব বিক্রিয়ার কারণে সৃষ্টি হয়— আবার কখনোবা পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং আবহাওয়ার কারণে পাপের উত্পত্তি হয়। তবে বেশির ভাগ পাপের কার্যকারণ মানুষের মন মস্তিষ্ক— আজ অবধি আবিষ্কার করতে পারেনি। মানুষের অজানা সেই পাপরাশির উৎসমূল হিসেবে সবাই একবাক্যে শয়তানের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে।

যদি প্রশ্ন করা হয়, কোনটি শয়তান এবং কোনটি মানুষ তা বুঝবেন কী করে? অথবা শয়তান এবং মানুষের মৌলিক পার্থক্য কী? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমরা পবিত্র আল কোরআনে বর্ণিত দুটি কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পারি। প্রথম কাহিনীটি ইবলিশকে নিয়ে এবং দ্বিতীয় কাহিনীটি হজরত আদম (আ.) নিয়ে।

হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর আল্লাহ সব ফেরেশতাকে হুকুম করলেন আদমকে সিজদা করার জন্য। সবাই সিজদা করল কেবল ইবলিশ ছাড়া। সে কতগুলো যুক্তি আল্লাহর সামনে পেশ করল। বলল— আমি আগুনের তৈরি। আগুন সব সময় ঊর্ধ্বমুখী। অন্যদিকে আদম মাটির তৈরি। মাটির তৈরি যে কোনো বস্তু সব সময় নিম্নগামী হয়। ইয়া আল্লাহ! কোনো ঊর্ধ্বগামী বস্তু কি কোনো নিম্নগামী বস্তুকে সিজদা করতে পারে? আধুনিক যুক্তি বিজ্ঞান এবং বিতর্ককারীদের দৃষ্টিতে ইবলিশের বক্তব্যে যুক্তি আছে বলে অনেকে হৈচৈ করেন বটে কিন্তু সত্যিকার চিন্তাবিদরা ওসব কথা একদম পাত্তা দেন না। তারা বরং ইবলিশের প্রদত্ত যুক্তির মধ্যে-ই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান। এবার হজরত আদম প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক। তাকে সৃষ্টির পর বেহেশতের সর্বত্র অবাধে বিচরণ এবং সব নেয়ামত উপভোগের অনুমতি দেওয়া হলো কেবল একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। গন্ধম নামক বৃক্ষের কাছে যাওয়া এবং বৃক্ষটির ফল ভক্ষণ করার ক্ষেত্রে বলা হলো ওদিকে যাবে না। এটি ছিল একটি সতর্ককারী বার্তা। পরবর্তীতে যখন গন্ধম খাওয়ার কারণে আদম জিজ্ঞাসিত হলেন তখন তিনি ইবলিশের মতো যুক্তি খুঁজলেন না এবং বললেন না— ‘ইয়া আল্লাহ! ঘটনাটি আমি সরাসরি করিনি। হাওয়া আমাকে গন্ধম খাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল। হাওয়া তো তোমারই সৃষ্টি। তুমি তাকে আমার পরে সৃষ্টি করে আমার সঙ্গিনী বানিয়ে দিয়েছ। আমি ধারণা করেছিলাম হাওয়া যেহেতু খেতে বলেছে সেহেতু গন্ধম সম্পর্কে তুমি হয়তো তাকে সতর্ক করনি— নতুবা গন্ধম সম্পর্কে পূর্ব সতর্কতা উঠিয়ে নিয়েছ। কারণ তুমি যদি আমার মতো হাওয়াকেও সতর্ক করতে তাহলে নিশ্চয়ই সে আমাকে গন্ধম খেতে পরামর্শ দিত না!

হজরত আদম (আ.) শয়তানের মতো হয়তো আরও বলতে পারতেন— ইয়া আল্লাহ! তামাম বেহেশতের সব নেয়ামত আমার জন্য অবারিত করেছ। গন্ধম সম্পর্কে বলেছ— ওদিকে যেও না— কিন্তু তুমি তো ওই ফল খেতে নিষেধ করনি। আমরা যদি ওদিকে না গিয়ে ওই ফল সংগ্রহ করে এনে অন্যত্র বসে খেতাম তাহলে কি পরিণাম হতো। ইয়া আল্লাহ! কেন তুমি আমাদের বিপদে ফেলার জন্য কৌশলে ইঙ্গিতপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছিলে। অথবা গন্ধম সম্পর্কে কোনো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করনি। যে ফল খাওয়া যাবে না— যে বৃক্ষের কাছেও যাওয়া যাবে না কেন তুমি সেই বৃক্ষ সৃজন করে তোমার বান্দাকে বিপদের মধ্যে ফেললে?

‘ইতিহাস’ সাক্ষ্য দেয়— হজরত আদম (আ.) কোনো শয়তানি চাল চালেননি— মহান আল্লাহর কাছে নিজের বুদ্ধিজাত কূটকৌশলের কথামালা রচনা করে তা উপস্থাপন করেননি। অথচ ইচ্ছে করলে তিনি অনেক কৌশলী কথাবার্তা বলতে পারতেন কারণ আল্লাহ তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হেকমতওয়ালা অর্থাৎ জ্ঞানী হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন। আল্লাহর সৃষ্টির জগতের সমুদয় রহস্য, সব মাখলুকাতের নামধাম ইত্যাদি স্বয়ং আল্লাহ তাকে শিখিয়েছিলেন। তিনি এত্তোসব জ্ঞান-গরিমা, পাণ্ডিত্য, যুক্তিতর্ক অথবা কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি বললেন— ‘হে আমার রব। নিশ্চয়ই আমি নিজের ওপর সম্ভবত জুলুম করেছি। এখন তুমি যদি আমায় ক্ষমা না কর তবে অবশ্যই আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’

পবিত্র আল কোরআনের উল্লিখিত কাহিনী এবং পূর্বাপর নানান ঘটনা পর্যালোচনা করলে মানুষ ও শয়তানের মধ্যে নিম্নলিখিত মৌখিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে— এক. মানুষের মানবিকতার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তার সরলতা। সে সরলভাবে সব কিছু বিশ্বাস করে। তার সরল মন দুনিয়ার বিস্ময়কর সব সৃষ্টি অবলোকন করে এবং বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে সৃষ্টির রহস্য নিয়ে চিন্তাভাবনার পাশাপাশি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও গবেষণা করে। অন্যদিকে, শয়তান কেনো দিন সরল চিন্তা করে না। কুটিলতা, অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং অকৃজ্ঞতা হলো শয়তানের প্রধানতম অলংকার এবং পরিচ্ছদ। প্রত্যেক বিষয়ের মধ্যে মন্দ জিনিসের খোঁজ করা, প্রতিটি সৃষ্টির দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো এবং সেসব দোষত্রুটি দশমুখে প্রচার করার জন্য শয়তানি মন-শয়তানি বাকপুটতা এবং শয়তানি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বড্ড বেশি নড়াচড়া করে।

দুই. মানুষ সব সময় বিনম্রতা, ভদ্রতা, সদালাপ এবং আনুগত্য প্রদর্শনকে নিজেদের জন্য অবশ্য কর্তব্য বানিয়ে নেয় এবং এসব মহৎ গুণাবলি চর্চার মধ্যে মানব হিসেবে জন্মলাভের সার্থকতা খুঁজে ফেরে। মানুষ সব সময় হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা পোষণ করে এবং তার উপকারীর প্রতিদান দেওয়ার জন্য আমৃত্যু উন্মুখ হয়ে সুযোগ খুঁজতে থাকে। মানুষ কোনো দিন স্রষ্টার অবাধ্য তো দূরের কথা—  পৃথিবীর কোনো প্রাণীরও অবাধ্য হয় না। কোনো নিয়মকানুন, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখায় না। সবাইকে সম্মান প্রদর্শন, মমত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা এবং স্নেহের পরশে আগলে রাখার জন্য নিজের পাঁচটি ইন্দ্রেয়কে সব সময় সজাগ, সচেতন এবং কর্মক্ষম রাখার জন্য মানুষ অনাদিকাল থেকে নিরন্তর চেষ্টা-তদ্বির করে আসছে। শয়তানেরা সব সময় রুক্ষ, রূঢ়, বদমেজাজি এবং অত্যাচারী মনোভাবের হয়ে থাকে। নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে শতভাগ স্বার্থপর এবং অন্যের অধিকার হরণে তারচেয়েও বেশি তত্পরতা দেখানোর মাধ্যমে শয়তানেরা নিজেদের শয়তানি জীবনের সার্থকতা খুঁজে ফেরে।

তিন. সৃষ্টিশীলতা মানবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানুষ অজানাকে জানতে চায় এবং অদেখাকে দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে। আবিষ্কারের নেশায় মানুষ সারাটি জীবন অব্যাহতভাবে চেষ্টা করতে থাকে। সত্যিকার মানুষ নিজের জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধি-শুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো দিন আত্মতৃপ্তিতে ভোগে না— বরং নিজের অসম্পূর্ণতার জন্য এক ধরনের বিনয়াবনত ভাব হৃদয়ে ধারণ করে সে আমৃত্যু জ্ঞান অর্জনের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে। শয়তানেরা কোনো দিন মানুষের মতো জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধি-শুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে মাতা ঘামায় না। তারা অর্থ উপার্জন, ভোগবিলাস, আনন্দফুর্তি, দম্ভ করা, অলসতা, বাচালতা এবং অপব্যয়কে জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে। তারা কোনো কিছু নীরবে করতে পছন্দ করে না। তাদের প্রতিটি কর্মে বিপত্তি সৃষ্টি এবং তা থেকে দুর্গন্ধ বের না হওয়া পর্যন্ত তারা পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করতে পারে না।

চার. কৃতজ্ঞতা, উপকারীর জন্য প্রতিদান অথবা দোয়া প্রার্থনা মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলিগুলোর মধ্যে অন্যতম। মানুষ সবার আগে তার স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তারপর তার পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, দেশ-কাল, নিয়োগকর্তা, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, পরিবেশ, প্রতিবেশ, গাছপালা, বৃক্ষরাজি, হর্মমালা, নদ-নদীসহ তাবৎ মাখলুকাতের প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা ক্ষণে ক্ষণে, বিনয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করতে থাকে। তার চাহনী, কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি, হাঁটাচলা ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে কৃতজ্ঞতার ভাব ফুটে ওঠে। সে নিজের জন্মের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ প্রদান করে এবং তার সাহায্যকারী রিজিকের উৎস এবং বেঁচে থাকার নানান অবলম্বন দিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর ভারসাম্যময় পৃথিবী সৃজনের জন্য তার রবের প্রতি শ্রদ্ধায় নত সিজদা প্রদানের জন্য উন্মুখ হয়ে আজানের ধ্বনির অপেক্ষা করতে থাকে। শয়তানেরা সব সময় নিজের কর্মের জন্য দম্ভ করতে থাকে। আল্লাহর ভুলত্রুটি সৃষ্টির দোষত্রুটি এবং সব কিছুতে বক্রতা খোঁজার জন্য তারা দিন-রাতের নির্দিষ্ট সময় ব্যস্ততার মধ্যে কাটায়। অকৃতজ্ঞতা, খোটা দেওয়া, অন্যকে ছোট করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মাধ্যমে অধীনস্থদের অপমান করা, অর্থবিত্ত, পদপদবি এবং নিয়োগকর্তাকে স্রষ্টার আসনে বসিয়ে পুজো করার মাধ্যমে শয়তানেরা জমিনে সেই অনাদিকাল থেকেই অনাসৃষ্টির পাঁয়তারা করে আসছে।

পাঁচ. মানুষেরা মিথ্যাচার, ব্যভিচার, অনৈতিক বিষয়-আশয়, চুরি চামারি, ঘুষ-দুর্নীতি, লোক ঠকানো এবং অন্ধকারের নিষিদ্ধ কর্মসমূহকে প্রবলভাবে ঘৃণা করে। অপর পক্ষে, শয়তানেরা ওসব কর্মের মধ্যেই নিজেদের সফলতা, সার্থকতা এবং আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। মানুষ বেশির ভাগ সময় স্থির থাকে। অতীতকে মূল্যায়ন করে এবং বর্তমানকে কাজে লাগায়। শয়তানেরা অতীত নিয়ে আফসোস অথবা অহংকারের মাধ্যমে বর্তমানকে মাটি করে দেয় এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অলীক কল্পনায় শূন্যের ওপর তাসের ঘর নির্মাণে ব্যস্ত থাকে। মানুষ নীরবতা পছন্দ করে। তাল লয় ছাড়া কোনো সুর এবং ছন্দ তার ভালো লাগে না। পরিবার-পরিজন, আপনজন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজন, অনুকরণীয় ভালো মানুষের সান্নিধ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। অন্যদিকে, শয়তানের প্রথম কাজ হলো— নিজের আপনজনকে অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং অত্যাচার করার মাধ্যমে ছোট করে রাখা। তার দ্বিতীয় কাজ হলো— দূর-দূরান্ত থেকে তার মতো মন্দ ও বদ স্বভাবের শয়তানদের খোঁজ করে অথবা ধরে এনে মজমা বসানো এবং সেই মজমার সেবক বানিয়ে আপনজনদের অপমানিত করা।

ছয়. মানুষ সব সময়ই ধার্মিকতাকে জীবনের অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করে। শয়তানেরা ধর্মকে শুধু অস্বীকার করে না— ধর্ম অবমাননা করে তারা এক ধরনের পৈশাচিক পুলক অনুভব করে। মানুষ ভালো কাজের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয় এবং একত্রে বসবাস করে। শয়তানেরা মন্দ কাজের জন্য একত্র এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে। মানুষের কর্মে পৃথিবীর উন্নয়ন ঘটে এবং শয়তান তা বিনাশ করে। মানুষের আহার-নিদ্রা, বিশ্রাম-বিনোদন ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে পরিমিত বোধ, নান্দনিকতা, সৌন্দর্য এবং সৌজন্যতা ফুটে ওঠে। শয়তানেরা ওসবের ধারের কাছ দিয়েও হাঁটে না। হৈ-হুল্লোড়, এলোমেলো পথচলা, বিশ্রী শব্দ সৃষ্টি করা এবং অপরকে কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগবিলাসকে নিশ্চিত করার জন্য তারা উদগ্রীব থাকে।

সাত. মৃত্যু চিন্তা মানুষের প্রধানতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। নিজের দোষত্রুটি খোঁজা, সংশোধন হওয়া, ক্ষমা প্রার্থনা, অনুশোচনা করা, পরোপকার, অহংকার না করা, সবকিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা, জ্ঞান অর্জন, গবেষণামূলক চিন্তাভাবনা, রুচিশীল পোশাক-পরিচ্ছদ, সুগন্ধি ব্যবহার, দরদভরা মন, আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার ইত্যাদিকে মানবমণ্ডলী নিজেদের ঐতিহ্য এবং আভিজাত্য হিসেবে বিবেচনা করে।

অন্যদিকে, মৃত্যুকে ভুলে থাকা, কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনায় অজ্ঞানতা, দাম্ভিকতা এবং উগ্রতা প্রকাশ করাকে শয়তানেরা নিজেদের পরম ধর্ম বলে ধ্যান জ্ঞান করে।  হৃদয়ে শত্রুতা পোষণ, মন-মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে দেহজ সুখ, শান্তি আনন্দ উল্লাস এবং পাকস্থলি পূর্ণ করার জন্য শয়তানি তাণ্ডবে পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তোলার মধ্যেই ইবলিশের বংশধররা নিজেদের সফলতা খুঁজে বেড়ায়।

লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর