রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
স্মরণ

সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি : বাবাকে খুব মনে পড়ে...

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি : বাবাকে খুব মনে পড়ে...

বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রথিতযশা সাংবাদিক ও লেখক সুনীল ব্যানার্জির দশম মৃত্যুবার্ষিকী ২৮ আগস্ট। ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট তিনি জগতের সব মায়ার বন্ধন ত্যাগ করেন। ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে ১০টি বছর।

পাঠকদের জন্য সহজভাবে কিছু লেখা বেশ কঠিন। এটা আরও কঠিন গভীর চিন্তাপ্রসূত বক্তব্য উপস্থাপনের সময়। কিন্তু এ কঠিন কাজটিই অতি সহজে দিনের পর দিন করে গেছেন সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি। অত্যন্ত নিপুণভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে। তার কলাম ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে নিজস্ব নিয়ম ও চিন্তাচেতনায় বহু প্রসঙ্গের যুগপৎ অবতারণা করেছেন, যা সাম্প্রতিক ও সুদূর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসমৃদ্ধ ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সমস্যাগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।

সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের মধ্যগগনে তিনি যখন বিচরণ করছিলেন তখনই সবাই একদিকে তার সতীর্থ অন্যদিকে সাংবাদিক ও সহযোদ্ধারা তাকে আমলে নিয়েছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন। সম্মানও করেছেন। অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, মৃত্যুর পর তাকে ভুলে যেতে সময় নেননি অনেকেই।

মানুষ জন্মগ্রহণ করে, পৃথিবীতে জীবনযাপন করে কিছুদিন, তারপর মৃত্যুতে ঘটে তার পরিসমাপ্তি। এভাবে যত মানুষ আসে, সবাই চলে যায়। দু’চার দিন পর তাকে ভুলে যায় সবাই। এটাই সাধারণের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। কিন্তু যিনি কীর্তিমান, মানুষের মনে অপার ভালোবাসা যিনি রেখে যান, তিনি বিস্মৃত হয় না। তিনি থাকেন এবং নানা প্রসঙ্গে ঘুরে-ফিরে আসেন আমাদের মধ্যে।

এক সময়ের সাংবাদিকতা জগতের সবার অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সুনীল ব্যানার্জি। অনেকের কাছেই তিনি আনন্দ-বেদনায় অনিবার্য আশ্রয়। এ মহান ব্যক্তি আমার পিতা। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। যার অনুপস্থিতি আমার প্রতিটি অসহায় মুহূর্তের নীরব সাক্ষী। ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট আমাকে এতিম করে দিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন পরলোকের দূর অজানা সীমানায়।

প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে পৃথিবীতে কিছু মানুষ নিজের জন্য জন্মায়। কিছু মানুষ জন্মায় শুধুই তার পরিবারের জন্য। কিছু মানুষ জন্মায় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকার জন্য এবং কিছু মানুষ-তার পরিবার, তার এলাকার সীমানা ছাড়িয়ে গোটা একটা দেশের জন্য জন্মগ্রহণ করেন। আমার বাবা বিশিষ্ট সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি এই শেষোক্ত গোত্রের। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন তিনি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি বিসিএস পাস করে ক্যাডার সার্ভিসে যোগ না দিয়ে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিক আর সাপ্তাহিকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত লিখেছেন কলামের পর কলাম-অবিরাম।

১৯৭২ সাল থেকে আমার বাবা প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জি আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। দীর্ঘ কয়েক দশকের সাংবাদিকতা পেশায় তিনি দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক জনকণ্ঠে কাজ করেছেন। দেশের অবহেলিত জনপদ ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্টের আলোকে সুনীল ব্যানার্জি নামটি পাঠক মহলে হয়ে ওঠে প্রশংসিত ও আলোচিত। বিসিএস পাস করে পুলিশের চাকরিতে যোগ না দিয়ে সাংবাদিকতাকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তা ছাড়াও তার ছিল এলএলবি ডিগ্রি। সুতরাং ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে তার দক্ষতা এবং পারিপার্শ্বিকতা ছিল অতুলনীয়। নিজের প্রাণবাজি রেখে তার কলম চলেছে তীরের মতো তীক্ষ।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরেও বাবার পরিচিতি ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। অত্যন্ত সুদর্শন এবং সদালাপি বাবার ব্যক্তিত্ববোধ সবাইকে খুব আকৃষ্ট করত। হয়তো সে কারণেই যখনই যেখানে তার সঙ্গে গিয়েছি, পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। আজ নিজেকে বড় বেশি অসহায় লাগে। একা লাগে।

সুনীল ব্যানার্জি জাতীয় প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকতা জগতে আজ যারা খ্যাতির শীর্ষে, তাদের অনেকের এ পেশায় আগমন তার হাত ধরে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এসব সংগঠন কিংবা খ্যাতিমান মানুষগুলো তাকে মনে রাখেন না। এমনকি তার মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণেও কোনো কিছুর আয়োজন করা হয় না।

মানুষের কাছে আজ আমার আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। বাবাকে অকালে হারিয়েছি বলেই মাকে আঁকড়ে ধরে থাকার বাসনা আমার তীব্র। যেটি অনেকের কাছেই হাস্যকর কিংবা বিদ্রূপাত্মক। সাংবাদিক এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবাকে একটি সরকারি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সেই বাড়ি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা চলছে কয়েক যুগ ধরে। আজও সেই বাসাটির সুষ্ঠু কোনো সুরাহা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো মহলের কোনো প্রকার সহযোগিতা আমি পাইনি। যেমনটি পাইনি মায়ের সুচিকিৎসার জন্য। অনেক চেষ্টা করেছি। আশায় আর আশ্বাসে আকাশ-পাতাল দৌড়ঝাঁপ করেছি। প্রাপ্তির খাতায় উপেক্ষা ছাড়া কিছু জোটেনি।

পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য হচ্ছে, পরিচিত মানুষগুলোর অপরিচিত চেহারা! এ ভয়ঙ্কর দৃশ্যের ভয়াবহতায় আমি এখন অভ্যস্থ। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন হয়তো এভাবেই অচেনা বিবর্ণ পথগুলোকে পাড়ি দিতে হবে। দেখতে হবে মানুষের বহুরূপিতা। সহ্য করতে হবে তীব্র কষ্ট আর হতাশার যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণায় ভর করে পার করেছি দশ-দশটি বছর। গাণিতিক হিসেবে তিন হাজার ৬৬৭ দিন। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি দিনের হিসাব আছে আমার কাছে। সব সময় এটা কামনা করি যে, আমার মতো ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার যেন আর কাউকে হতে না হয়।

নীল বেদনার রং, নীল ভালোবাসার প্রতীক। আমার বাবার ‘সুনীল’ নামটি আমার হৃদয়ে অম্লান ভালোবাসায় ভরে থাকবে চিরদিন, চিরকাল...

লেখক : [প্রয়াত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির পুত্র।]

jsb.shuvo¦gmail.com

সর্বশেষ খবর