সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

সুবিধাভোগীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন

স্বপন দাশগুপ্ত

যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়েছে। তবে এবারের শোক দিবসের অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমার্থক শব্দ। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস রচনার চিন্তা করা যায় না। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু আজ আর কোনো দলের নয়, কোনো সরকারের নয়, তিনি দেশের ১৬ কোটি মানুষের নেতা। আমরা যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, তারা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই যুদ্ধে গিয়েছিলাম। তিনিই ছিলেন দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অনুপ্রেরণা। এটাকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করা হবে।  এবারই প্রথম ১৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান করেননি। জন্মদিনের অনুষ্ঠানকে শুধু মিলাদ ও দোয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন তিনি। যুক্তির খাতিরে ১৫ আগস্ট যদি তার জন্মদিনও ধরে নিই, তাহলে ওইদিন কোনো আনুষ্ঠানিকতা করা উচিত নয় তার। কেননা দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতার অবদান এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য জাতির পিতার পদক্ষেপের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধের কারণে বেগম খালেদা জিয়ার অনেক আগেই উচিত ছিল ১৫ আগস্ট জন্মদিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা না রাখা। এ জন্য কয়েক বছর যাবৎ আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা তাকে ১৫ আগস্ট কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা না করার অনুরোধ জানিয়ে এসেছেন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এমনিতেই বেগম খালেদা জিয়ার আরও দুটি জন্মদিন রয়েছে। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তখন জনৈক সাংবাদিক তার জীবন ইতিহাস বই আকারে প্রকাশ করেন। ওই বইয়ে তার জন্মদিন বলা হয় ১৫ আগস্ট।

অতিসম্প্রতি জনতা লীগের প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রস্তাবিত জাতীয় ঐক্য নিয়ে আলোচনার সময় ১৫ আগস্ট জন্মদিনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা না করার অনুরোধ করেন তাকে। শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ১৫ আগস্ট তার জন্মদিনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা করবেন না বলে জানিয়েছেন। অনেকের ধারণা তার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুদিনকে কেন্দ্র করে জন্মদিনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন করেননি। বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা মনে রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামীতেও ১৫ আগস্ট তার জন্মদিনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন করবেন না। বঙ্গবন্ধু শুধু সরকার বা আওয়ামী লীগের একার নয়, তিনি জাতির সম্পদ এই বিষয়টি বিএনপি চেয়ারপারসনকে উপলব্ধি করতে হবে। তবে এবারের জন্মদিনে যে কারণেই হোক কোনো আনুষ্ঠানিকতা না করায় তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে কিছু বিপদগামী সেনা সদস্য। তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহকে ওই কালরাতে ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তিনি মৃত্যুর ভয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। শুধু সেনাপ্রধানই নন, রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য ছুটে আসেনি। ইতিহাস অবশ্যই তাদের মূল্যায়ন করবে। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্রি. জেনারেল শাফায়াত জামিল বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়েই ছুটে এসেছিলেন কিন্তু সোহবানবাগের কাছে বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে তিনি প্রাণ হারান। এই ইতিহাস সবারই জানা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে জাসদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করে বক্তৃতা, বিবৃতি, সমাবেশ ও জনসভা করেছে। এরা সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনের কর্মসূচিও দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর এসব রাজনৈতিক দলের কথা বাদ দিলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সেদিন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে আসেননি। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ খন্দকার মোশতাকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ জেলে গেছেন অথবা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তাদের সাহস হয়নি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার। কিন্তু তারা যদি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মতো ঝুঁকি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন, তাহলে দেশের ইতিহাস আজ ভিন্ন হতো। তবে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তারা অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছেন। জানা যায়, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর আহ্বানে এই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ১৭ হাজার মুজিবভক্ত। সাতটি ফ্রন্টে বিভক্ত হয়ে এরা তৎকালীন মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধে অন্তত ১০৪ জন মুজিবভক্ত তাদের বুকের রক্ত ঢেলেছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক প্রতিরোধ যোদ্ধা। আর গ্রেফতার হয়ে নির্যাতন ভোগ করেছেন তিন শতাধিক যোদ্ধা। অসংগঠিত এই যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তবুও বিচ্ছিন্নভাবে তারা ২২ মাস যুদ্ধ করেছেন। গ্রেফতারকৃত একজন প্রতিরোধ যোদ্ধা বিশ্বজিৎ নন্দীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের এক সেলে। বেশ কিছুদিন আমরা সেখানে ছিলাম। তার অমানসিক নির্যাতনের কাহিনী শুনেছি। পরবর্তীতে মামলার কারণে আমরা দুজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব যদি সাহস নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি অসংগঠিত মুজিবভক্তদের এই প্রতিরোধ যুদ্ধকে এগিয়ে নিতেন তাহলে হয়তো দেশের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য এত দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতো না।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক, অন্যবারের চেয়ে এবারের শোক দিবসে লোক সমাগম বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের বাইরেও অনেক ‘লীগ’কে শোক দিবসে ফুল দিতে দেখা গেছে। প্রজন্ম লীগ, তরুণ লীগ, জয়লীগ, পর্যটন লীগ ও ওলামা লীগসহ এমন শতাধিক সংগঠনকে ফুল দিতে দেখা গেছে। ইতিমধ্যে জয়লীগের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের কোনো সম্পর্ক নেই বলে তিনি তার সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জয়লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা কতটা সুবিধাভোগী তা সহজেই অনুমেয়। তারা ধারণা করেছেন, ভবিষ্যতে জয় নেতৃত্বে আসবেন। এই কারণেই তারা ‘ইট’ বিছিয়ে রাখছেন, যাতে জয় ভবিষ্যতে নেতৃত্বে এলে বলতে পারবেন, আমরা কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী। পর্যটন লীগের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিক নেতাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করতে এসেছিলেন পর্যটন লীগের নেতারা। তিনি এ ধরনের ভুয়া সংগঠনের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত হবেন না বলে উদ্যোক্তাদের কৌশলে জানিয়ে দিয়েছেন। আর ওলামা লীগ নিয়ে তো আওয়ামী লীগের নেতারা বিব্রত। ওলামা লীগের একাংশের নেতারা তাদের বক্তব্যে এমন সব বিষয় তুলে এনেছেন, যা আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শের পরিপন্থী। বিবৃতি দিয়েও আওয়ামী লীগ নেতারা এই সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই বলে উল্লেখ করেছেন। তার পরও ওলামা লীগের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়নি, এখনো ওলামা লীগ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই কারণেই এসব সংগঠন নিয়ে আপত্তি উঠেছে। এসব সংগঠন গড়ে উঠেছে ক্ষমতার আশপাশে থেকে।

সুবিধাভোগীরা ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত করে সংগঠন গড়ে তোলে এবং কিছুটা সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু নেতানেত্রীদের দুঃসময় এবং দলের বিপর্যয়ে এদের দেখা যায় না। রাতারাতি ভোল পালটিয়ে এরা নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের দলে যোগ দিয়ে পাল্লা ভারি করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর মৃত্যুর আগেও এমন সুবিধাভোগীদের আনাগোনা দেখা গেছে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এদের আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবার এদের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। এরা যে ক্ষমতার কিছু পাওয়ার জন্য সুবিধার পেছনে ছুটে এদের ঠেকাতে হবে। আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান কর্মীদেরই এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, এরা দলের জন্য বোঝা। এদেরকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। দলের নেতানেত্রীরা কোনো সংকটে বা বিপদে পড়লে এদের আর দেখা যাবে না। এরা শুধু মধুর জন্য ক্ষমতাসীনদের আশপাশে ঘোরাফেরা করে। এদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।

     লেখক : সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর