মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভারতের স্বাধীনতায় নেহেরু গান্ধীর অবদান নেই!

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের স্বাধীনতায় নেহেরু গান্ধীর অবদান নেই!

স্বাধীনতার ৭০ বছর পর ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কোনো অবদান ছিল না। ছিল না মহাত্মা গান্ধী, বল্লভ ভাই প্যাটেল ও আবুল কালাম আজাদদেরও। তিনি নেহেরু-গান্ধী পরিবারকে ইতিহাসের পাতা থেকে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়ার জন্য গেরুয়াধারী সংঘ পরিবারকে বলেছেন, আপনারা প্রচার করুন। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের গোলওয়ালকর। কে এই গোলওয়ালকর? কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের কাছাকাছিই ছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘অনুশীলন পার্টি’ নামে একটি পার্টি তৈরি করেন। ইতিহাস থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা হলো তিনি হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি নেওয়ার জন্য কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থেকেই কাজ শুরু করেন। ১৯২৫ সালে তিনি যখন ধরা পড়ে যান, তখন তার কোনো কথার মূল্য দেননি তৎকালীন কংগ্রেস নেতারা।

নেহেরু, গান্ধী, আজাদ ও প্যাটেলের মতো নেতারা গোলওয়ালকরকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন কংগ্রেস একটি প্লাটফরম। এ প্লাটফরমে যে কোনো নেতা-কর্মী আসতে পারেন। আপনার যদি তা পছন্দ না হয় তাহলে আপনি কংগ্রেস ছেড়ে চলে যান। তিনি বেরিয়ে গিয়ে অনুশীলন পার্টি করেন। ওই সময় তারই উদ্যোগে গঠন করা হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। মোদিজি তখন কোথায় ছিলেন, তার দলই বা তখন কোথায় ছিল, তাই নিয়ে গোটা দেশে আলোচনা চলছিল। মোদি স্বাধীনতার ঠিক এক বছর পরে জন্মেছেন।

ভারতের সংবিধান রচনার সময় নেহেরু মন্ত্রিসভায় শিল্পমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। শ্যামাপ্রসাদ তখন কংগ্রেস ছেড়ে ভারতীয় জনসংঘ নামে একটি দল গঠন করেন। ইতিহাসের তথ্য বলছে, শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভাকে সঙ্গে পেয়েছিলেন। সেই সময় তার ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরই জনসংঘ পার্টির জন্ম হয়। এ জনসংঘ পার্টি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আরএসএসকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দি বলয়ে দাপিয়ে বেড়ায়।

’৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে হটানোর জন্য জনসংঘ বামপন্থিদের হাত ধরে নির্বাচনী আসরে নামে। ইন্দিরা পরাজিত হন। কেন্দ্রে বাম-দক্ষিণ ও মধ্যপন্থিরা মিলে একটি সরকার গঠন করে। সেই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন লালকৃষ্ণ আদভানি। বিরোধ দেখা দিল অচিরেই। প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বললেন, পুরনো জনসংঘীরা দুটো পার্টির সদস্য থাকতে পারবেন না। একটা আরএসএস এবং অন্যটা জনতা পার্টি। ভারতের রাজনীতির এসব ইতিহাসের ধারা নরেন্দ্র মোদি জানেনই না বা বোঝার চেষ্টা করেন না। তার উপদেষ্টারাও তার সামনে বিকৃত ইতিহাসই পেশ করেন। তার একমাত্র আদর্শ হলো ভারত থেকে কংগ্রেস হটাও আর বামপন্থিদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে।

একাধিক ইতিহাসবিদ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খোলাখুলিই বলেছেন, মোদি কি গোটা ইতিহাসটাই পাল্টে দিতে চাইছেন। তা কিন্তু ভারতের ১২৫ কোটি লোক মেনে নেবে না। মেনে নেবে না আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র। মিডিয়ার মাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, ইতিহাস কি বদলানো যায়? মোদি কি তা পারবেন?

আড়াই বছর আগে মোদি দেশবাসীকে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এখন তা থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানকে বিরিয়ানি খাওয়ানো হবে না, উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। ১০০ দিনের মধ্যে বিদেশ থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে আনা হবে। বছরে দুই কোটি লোককে চাকরি দেওয়া হবে। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে কমে যাবে। এর একটাও বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছে।

ভারতবর্ষের মানুষ তার ওপরে তিতিবিরক্ত। শুধু রাজনীতিকরাই নন, গোমাংস ভক্ষণ, গোনিধন বন্ধ করা নিয়ে তিনি যা বাড়াবাড়ি করেছেন তাতে গোটা দেশ তার ওপর ক্ষুব্ধ। শুধু জাতীয়তাবাদের কথা বলে তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে তার দোসর, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করলেই তাকে কঠোর সাজা পেতে হবে। তারা যে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হলো, তাদের সমালোচনা করা যাবে না। তারা যা করছেন তা ভারতবর্ষের পক্ষে এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ। এমনকি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং লিখেছিলেন, মানবতার ওপর দেশপ্রেমকে ঠাঁই দিতে চাই না। আর মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ঘৃণা কখনই জাতীয়তাবাদের আবশ্যক উপাদান নয়।

সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। কর্ণাটকের সাবেক কংগ্রেস সংসদ সদস্য রামাইয়া সম্প্রতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বলেছিলেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। ওরা খুব অতিথিপরায়ণ।

এই মন্তব্যের জন্য তাকে আদালতে টেনে নিয়ে গেছেন বিজেপি নেতারা। তিনি সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। তাই অতিথি হয়ে পাকিস্তানে গিয়ে যে আতিথেয়তা পেয়েছেন তাই তিনি অকপটে বলেছেন। তার পরই বিজেপির  নানা স্তরের নেতা হইচই করে ওঠেন। অর্থাৎ রামাইয়া একজন দেশদ্রোহী। এ দেশের ১২৫ কোটি মানুষই যদি দেশদ্রোহী হয়, তাহলে দেশভক্ত কারা! নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ আর মোহন ভাগবত? এদের কাছে মানুষকে দেশভক্তির প্রমাণ দিতে হবে?

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তীকালে গেরুয়া বাহিনীর কর্মকাণ্ড কী ছিল? দেশের অর্থনীতি নিয়ে অকারণ, না বুঝে, মূর্খের মতো কংগ্রেসকে দোষারোপ করে বলা হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য দায়ী কংগ্রেস। কিন্তু পেশাদার সাংবাদিক এবং ইতিহাসবিদরা বলছেন, বর্তমান দিল্লির শাসক দল নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে কখনো দেশভক্তি, কখনো হিন্দুত্ববাদ, কখনো পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ইত্যাদি করে নজর ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। বাস্তবে ভারতের অর্থনীতি সাম্প্রতিক অতীতে কেমন ছিল এবং কীভাবে তা এগিয়েছে তা দেখা দরকার।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, পণ্ডিত নেহেরুর হাত ধরে যদি ভারতের স্বাধীনতা এসে থাকে, তাহলে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে ড. মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে। রাজীব গান্ধীর মৃত্যু, রাশিয়ার পতন। টালমাটাল আঞ্চলিক রাজনীতির মতো একটা কঠিন পরিস্থিতিতে ১৯৯১ সালে অর্থনীতির হাল ধরেছিলেন তিনি। অর্থনৈতিক কর্ণধার হিসেবে আর্থিক বৃদ্ধির হার পরপর তিন বছর ৭ শতাংশ ধরে রাখতে পেরেছিলেন। পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে এ হারকে ৯ শতাংশে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ রেকর্ডকে ঐতিহাসিক বললেও ভুল হবে না। যদি বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা না দিত তাহলে ড. সিং হয়তো বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিকেও ছাপিয়ে যেতে পারতেন। এ সময়কালে ভারতের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হারও সমান প্রশংসনীয়। পরিকাঠামো, কৃষি, গ্রামোন্নয়ন, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ সবটাকেই সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি একটি অদ্ভুত উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো মূল্যেই তিনি তার দলের আদর্শপথ থেকে বিচ্যুত হবেন না। তাতে তাদের বিরোধী আসনে বসতে হলেও কুছ পরোয়া নেহি। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে তার দল বিজেপিকে যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা কংগ্রেসকে করতে হয়নি। বিজেপির মাহাত্ম্য প্রচার করতে গিয়ে দলীয় কর্মীদের তিনি বলেছেন, যেখানে যেখানে যা কাজ বিজেপি সরকার করছে, তার রেকর্ড রাখা শুরু করুন। কারণ স্বাধীন ভারতে বিজেপি যা অবদান রেখেছে তা ভবিষ্যতে প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। তার এ উন্মাদের মতো প্রলাপের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে কংগ্রেস। তারা বলেছে, হিন্দু-বাহিনীর মহিমা প্রচার করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকেই অস্বীকার করতে শুরু করেছেন। ইতিহাসবিদরা বার বার বলছেন, ‘আমাদের মহামান্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব নেহেরুর কয়েকটি লেখা পড়তে। অন্ততপক্ষে তার লেখা “ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া”টা পড়ুন। রাজনীতির প্রথম সারিতে বসতে হলে একটু লেখাপড়া করা দরকার।’ মোদি সেসবের ধারই ধারছেন না। আগেই উল্লেখ করেছি, তার প্রতিশ্রুতি ছিল ১০০ দিনের মধ্যে বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক ভারতীয়কে ৩৫ হাজার করে দেবেন। কিন্তু ৪৮৫ দিন হয়ে যাওয়ার পরও ৪৮৫ টাকাও কেউ পায়নি। এখন বিরোধী রাজনীতিকরা প্রশ্ন তুলেছেন, মোদিকে যারা ক্ষমতায় এনেছেন সেই মাড়োয়ারি গুজরাটি ব্যবসায়ীদের কালো টাকায় হাত দিতে সাহস হবে? নেহেরুর আমলে ’৫০ সালে সংবিধান চালু হওয়ার পর আরেক বাঙালি অর্থনীতিবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করেছিলেন। মোদি ক্ষমতায় এসেই সেই যোজনা কমিশনকে তুলে দিয়ে নতুন নাম দিলেন ‘নীতি আয়োগ’। সেটা খায় না মাথায় দেয়, তা এখনো ভারতবাসী বুঝতে পারেনি। তার মুখে ও বিজ্ঞাপনে একটাই কথা— আমিই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আর সমালোচকরা বলছেন, তিনি দেশকে ক্রমে পিছিয়ে দিচ্ছেন।

তাহলে ভারতবর্ষ এখন কোন পথে চলছে? এর ভবিষ্যৎ কী? দেশের মানুষ তিতিবিরক্ত।

লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর