বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাঙালির কলঙ্ক মুক্তির আরেক স্বর্ণপালক

শফী আহমেদ

বাঙালির কলঙ্ক মুক্তির আরেক স্বর্ণপালক

আমাদের জাতির ইতিহাসে আজ কলঙ্ক মুক্তির অধ্যায়ে আরেক স্বর্ণপালক সংযোজিত হলো চট্টগ্রামের শীর্ষ রাজাকার ডালিম হোটেলের কসাই বলে খ্যাত ধনকুবের মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ পিটিশন খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে। অনেক  আশঙ্কা ছিল, দুর্ভাবনা ছিল এমনকি রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার রাতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মীর কাসেমের রিভিউয়ের রায় নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন আছেন। এই সাক্ষাৎকারের পর গোটা জাতি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।  ট্রাইব্যুনাল যে যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, হাইকোর্ট আপিল বিভাগ যে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে, রিভিউ পিটিশনের পর সেই রায় নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কারণ কী? কারণ একটাই যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে একজন ধনকুবেরে পরিণত হয়েছে, তার টাকার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু এই রায় প্রমাণ করল টাকা দিয়ে রায় কেনা যায় না। পাপ কখনো চাপা থাকে না, এটা ইতিহাসের স্বতঃসিদ্ধ  ব্যাপার।

আজ আমরা অনেকটাই আনন্দিত, ভারমুক্ত এই ভেবে যে একের পর এক মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরের ঘাতকদের  সম্পূর্ণ স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার হচ্ছে, রায় হচ্ছে এবং রায় কার্যকর হচ্ছে। এই আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে জনতার কাঠগড়ায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। গোলাম আযমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে এক প্রতীকী ট্রায়েলের মাধ্যমে, সেই ট্রায়েলের রায় ঘোষণা হয় ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যেখানে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ রেসকোর্স ১৯৯২ সালে আর রেসকোর্স ছিল না স্বাধীনতার পর এর নামকরণ হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

আমরা গণ-আদালতের সংক্ষিপ্ত পটভূমিতে ফিরে যাই, জিয়াউর রহমান রাজাকার পুনর্বাসনের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সেই প্রক্রিয়ায় ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযম দেশে ফিরে আসে এবং প্রশ্নবিদ্ধ আইনি প্রক্রিয়ায় এদেশের নাগরিকত্ব লাভ করে। ঠিক সেই সময়ে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে গোলাম আযমসহ অন্যান্য ঘাতককে বাংলাদেশে বসবাস করার অধিকার আছে কি না সেই প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছিল। যখন জিয়ার পত্নী খালেদা জিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানি এজেন্ট আবদুল মতিন চৌধুরীর মতো লোক বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন এই ঘাতককুলের বিরুদ্ধে কীভাবে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধাসহ সব মানুষের মধ্যেই এই চিন্তাচেতনা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। অবশেষে পাশাপাশি দুটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রথমে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, এর অব্যবহিত পরেই গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবীর, নাট্যব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বিচিত্রা সম্পাদক মরহুম শাহাদাত চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার মরহুম আবদুর রাজ্জাক, মরহুম কাজী আরেফ আহমেদ, সেক্টর কমান্ডার আবু উসমান চৌধুরী, কর্নেল তাহেরের অনুজ মুক্তিযোদ্ধা আবুু সাঈদ আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, বিমল বিশ্বাস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী, প্রফেসর আবদুল মান্নান চৌধুরী, খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া,  আ ফ ম মাহবুবুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার প্রয়াত আবদুল মতিন চৌধুরী, অভিনেতা হাসান ইমাম, মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম প্রমুখ নেতার আহ্বানে। স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী পরিচালিত ও বিজয়ী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃবৃন্দ ছাত্রদল ও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন ব্যতিরেকে সবাই এই উভয় উদ্যোগের সঙ্গে শুরু থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন।

তৎকালীন সময়ে যারা সাংবাদিক হিসেবে মাঠকর্মী ছিলেন এখন যারা কোনো কোনো পত্রিকার সম্পাদক যেমন- বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, একাত্তর টেলিভিশনের পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, আমিনুর রশীদ, মরহুম মিনার মাহমুদ, প্রবাসী সাংবাদিক আমানদৌলা, ফজলুল বারী, ইরাজ আহমেদ, খায়রুল আনোয়ার, জুলফিকার আলী মানিক, শহীদ সন্তান নাদিম কাদির, তিমির দত্ত প্রমুখ উভয় উদ্যোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু দুটি কেন্দ্র থেকে আন্দোলন পরিচালনা করা এবং এর বিজয় অর্জন দুরূহ এই ভাবনা সবার মধ্যে ছিল। সামাজিক ও জনমতের চাপে একই লক্ষ্যে পরিচালিত দুটি কেন্দ্র একীভূত করে এই আন্দোলনকে কীভাবে সমন্বিত করা যায় সেই লক্ষ্যে ছাত্রনেতারা ও মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকরা একটা প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে থাকেন। অবশেষে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ও মুজিব বাহিনীর সাবসেক্টর কমান্ডার প্রফেসর আবদুল মান্নান চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। এই কমিটি ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযমসহ শীর্ষ যু্দ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সেই গণআদালত থেকে সবার উপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। বিচারক ও জুড়িদের মধ্যে ছিলেন ড. আহমদ শরীফ, ফয়েজ আহমেদ, ভাষা সৈনিক গাজিউল হক, অ্যাডভোকেট শফিক আহমেদ, কামাল লোহানী, ড. আনিসুজ্জামান, প্রয়াত কলিম শরাফীসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। সেই বিচারে গোলাম আযমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই আন্দোলনকে সফল করার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে এক ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপ-সহকারী প্রেস সচিব মাহাবুবুল হক শাকিল এবং দেশ টিভির কর্মকর্তা তৎকালীন ছাত্রনেতা সাদেকুর রহমান পরাগ। এখানে আওয়ামী ঘরানার ছাত্রনেতাদের এবং  উপরে উল্লিখিত সাংবাদিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মরহুম জননেতা আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ এই সফল আলোচনার  ব্যাপারে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। খালেদা জিয়ার ১৪৪ ধারা, কারফিউ, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাসহ সমস্ত বাধা-বিপত্তি প্রতিহত করে সফল করা হয় ১৯৯২-এর গণআদালত। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম খালেদা জিয়ার দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়ে ইন্তেকাল করেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার কার্যক্রম চলছিল তা জিয়াউর রহমান বন্ধ করে দেয়। স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের মধ্য দিয়ে সেই আকাঙ্ক্ষা ছাত্রজনতার মধ্যে পুনরায় জাগ্রত হয়, কিন্তু নরঘাতক গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়ে সেই অগ্নির মধ্যে ঘি ঢেলে দেয় খালেদা জিয়া সরকার। ১৯৯২ সালে গণআদালতে বিচার হলেও তা পূর্ণাঙ্গ আইনি প্রক্রিয়ায় রূপলাভ করতে সময়ের প্রয়োজন হয় ১৬ বছর। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে কিন্তু এ ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। ২০০৮ সালে যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় হয় সেই নির্বাচনে মূল ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিকে এজেন্ডাভুক্ত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বিচারের কার্যক্রম শুরু করে ১৯৭৩ সালে প্রণীত ওয়ার্কক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের অধীনে। এই আইনটিকে কয়েকবার সংশোধন করে আরও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা হয়, যা কি না বিশ্বের অন্যান্য দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে যে আইন ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য। চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিমধ্যে কু-খ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লা, নিজামী, কামারুজ্জামান, গোলাম আযমের বিচার কার্যক্রম শেষ হয় ও রায় কার্যকর হয়। অপর যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষে রিভিউ আবেদন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। কিন্তু আজ ধনকুবের ডালিম হোটেল খ্যাত কসাই রাজাকার মীর কাসেম আলীর আইনি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ সম্পন্ন হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছিল তা বাস্তবে বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। দেশবাসী অবগত আছেন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এমনকি সদ্য সফর করে যাওয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ওই যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন।

এখানেই প্রমাণিত হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ‘ভাঙেন তবে মচকান না’। যে সমস্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার শেখ হাসিনা সরকার ঘোষণা করেছে তা ক্রমশই বাস্তবায়িত হচ্ছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় যেমন কার্যকর হচ্ছে ঠিক তেমনি জঙ্গি সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নের মাইলফলকে জাতিকে পৌঁছে দেবে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব।

লেখক : সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা

সর্বশেষ খবর