সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মমতা ব্যানার্জি নিজেকে কী ভাবেন?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মমতা ব্যানার্জি নিজেকে কী ভাবেন?

সম্ভবত এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো নেতা বা নেত্রী নিজেকে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সমতুল্য বলে ঘোষণা করেননি। যা করার সাহস পেলেন ৭৪ বছর পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ‘কার্যত’ তিনি নিজেকে গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করেছেন অতি সম্প্রতি। এ ঘটনাটি তিনি ঘটিয়েছেন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। ঠিক ৭৪ বছর আগে বোম্বেতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে প্রথম প্রস্তাবটি ছিল দুই লাইনের। সে প্রস্তাবটি সাংবাদিকদের সামনে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ওই প্রস্তাবটি ছিল— ব্রিটিশ ভারত ছোড়ো। এ হামারা নির্জয় হ্যায়। জলদি না ছোড়লে সে হ্যায় এক কদম উঠায়েঙ্গে। তামাম হিন্দুস্তান উথালপাথাল হো জায়গা। ইসকা জিম্মিদারি মোরা নেহি। আংরেজ কা হ্যায়। ঔর যো যো রেজোলিউশন লিয়া গ্যয়া উও আপকে জওরে, প্যাটেল অউর মউলানা আপকো বার্তা দেগা। অ্যায় ভুস হরতাল কে লিয়ে যা রহা হুঁ।

গান্ধীর এই বার্তা ভারতবর্ষকে নতুন করে নাড়িয়ে দিয়েছিল। গোটা দেশে স্লোগান উঠেছিল, আংরেজ ভারত ছোড়ো। তারই চাপে পড়ে ব্রিটিশদের ভারত ভাগ করে ১৯৪৭ সালে বিদায় নিতে হয়। আর ৭৪ বছর পর আগরতলায় এক জনসভায় পশ্চিমবঙ্গের মা-মাটি-মানুষের মা গান্ধীর কথার সুরেই বললেন— সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এবং বামফ্রন্ট সরকারকে ত্রিপুরা ছেড়ে চলে যেতে হবে। মমতার ঘনিষ্ঠ সারদা কাণ্ডের নায়ক একধাপ এগিয়ে বললেন, দিদি গান্ধীর সুরেই বলেছেন বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নিক। তৃণমূল চায় বামফ্রন্ট সরকার চলে যাক। আমরা ত্রিপুরা দখল করব। কীভাবে তিনি করবেন, তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন।

গান্ধীজির ছিল অহিংসার মন্ত্র। আর তৃণমূলের অস্ত্র হিংসার যন্ত্র। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রনায়ক গান্ধীজির সঙ্গে নিজেদের তুলনা করেননি। আগরতলায় বসে তাই করে গেলেন তৃণমূলের নেতানেত্রীরা। আমরা কোথায় চলেছি, তা দেশের মানুষ বুঝতে পারছে না। মুকুল রায় কয়েক দিন আগেই ১০-১২ জন আইপিএস (পুলিশ) অফিসারকে নিয়ে আগরতলায় গিয়েছিলেন।

নির্বাচনে হারজিত ছিল এবং থাকবে। কিন্তু এদের শারীরিক ভাষা দেখে গোটা দেশ তাজ্জব বনে গেছে। একী সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাষা? নাকি অন্য কিছু? ত্রিপুরা বাংলাদেশের লাগোয়া একটি ছোট রাজ্য। মানিক সরকার গত ১৩ বছর ধরে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বছর দেড়েক আগে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ত্রিপুরা। উত্তর-পূর্ব ভারতে বর্তমানে ত্রিপুরা একটি নির্ঝঞ্ঝাট রাজ্য। এর আগে ত্রিপুরা ছিল জঙ্গি তত্পরতায় ভরা একটি এলাকা। মানিক সরকার তার শাসনে জঙ্গি তত্পরতা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন তার সুশাসনের মাধ্যমে। মানুষ এখন নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করে শান্তিতে বসবাস করছেন। পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন— নিজেকে গান্ধীজির সঙ্গে তুলনা ও অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরাকে ধ্বংস এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে বামপন্থিদের তুলনা একমাত্র মূর্খরাই করতে পারেন। বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান বলেছেন— ওর কথায় আমরা কোনো গুরুত্ব দিই না। ও সেয়ানা পাগল।

৬০-সদস্যবিশিষ্ট ত্রিপুরা বিধান সভায় কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০। মুকুল রায় মাস দেড়েক আগে ত্রিপুরা গিয়ে ছয়জন কংগ্রেস বিধায়ককে ২৫ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন। তারা এখন ত্রিপুরার তৃণমূল নেতা। মমতা দল গঠন করার পর থেকেই অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর এবং ত্রিপুরা দখল করার জন্য যাবতীয় ষড়যন্ত্র করে গেছেন। প্রাথমিকভাবে দু-একটি আসন পেলেও শেষ পর্যন্ত ওই রাজ্যগুলোতে খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি তারা।

এবারে মমতা চাইছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুকুল রায়কে ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করতে। তাই যারা দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরায় কংগ্রেস করছে তারা রোজভ্যালি-সারদা চিটকাণ্ডে জড়িত কোনো নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে কিনা সে প্রশ্নেই এখন তোলপাড় পাহাড়ি রাজ্যটা। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে করা স্বাভাবিক যে জঙ্গিবাদ ধুয়ে-মুছে গেছে, মমতা-মুকুল জুটি তা আবার ফিরিয়ে আনতে পারে।

তাতে ক্ষতি হতে পারে বাংলাদেশেরও। নিজেকে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করাকে পাগলের প্রলাপ বলেই মনে করছেন ত্রিপুরার সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর