সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নৈতিক শিক্ষা বনাম ব্যবহারিক পরীক্ষা

অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান

নৈতিক শিক্ষা বনাম ব্যবহারিক পরীক্ষা

জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সমস্যা ছিল, আছে ও থাকবে। প্রায় সব সমস্যারই সমাধানও আছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রীয়, যে পর্যায়েই সমস্যা থাকুক না কেন, সমস্যা সমাধানের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকলে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রায় সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যা বহুবিধ, অনেক সমস্যার সমাধান করা হয়েছে, অনেক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চলছে। এখনো এমন কিছু সমস্যা আছে যার আশু সমাধান প্রয়োজন। কোনো কোনো সমস্যার সমাধান না করা হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিপর্যয় অনিবার্য। শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য নৈতিক বিকাশ, পক্ষান্তরে অনৈতিক শিক্ষা জাতির অধঃপতন ঘটায়। বর্তমানে ‘পাবলিক পরীক্ষা’ নামে পরিচালিত এসএসসি ও এইচএসসি, অনেক ক্ষেত্রে কলেজ পরিচালিত স্নাতক পর্যায়ে ব্যবহারিক (Practical) পরীক্ষার নামে যা হচ্ছে তাকে কোনো অবস্থাতেই পরীক্ষা বলা যায় না। এর অনেক দুর্বলতার মধ্যে প্রধান দুটি দুর্বলতার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যাক : প্রথমটি হচ্ছে ভালো, মধ্যম ও দুর্বল সব পরীক্ষার্থীকে সব বিষয়ে ২৫ নম্বরের মধ্যে ২৪ বা পূর্ণ নম্বর ২৫ নম্বর প্রদান। বোর্ড পরীক্ষার একটি বিষয়ের দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। একটি বিষয়ের তাত্ত্বিক অংশে পূর্ণ নম্বর ৭৫-এর মধ্যে একটি বোর্ডের গড় নম্বর ৪২.১৪ যা ৫৬.১৯%। ওই বিষয়ে ব্যবহারিক অংশে পূর্ণ নম্বর ২৫-এর মধ্যে গড় নম্বর ২৪ অর্থাৎ ৯৬%। নম্বরের পার্থক্য শতকরা ৪০-এর কাছাকাছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী পরিচালিত নমুনাভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫% মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার নেই, ৪% বিদ্যালয়ে টেস্ট পরীক্ষার পর দু-চারটি ব্যবহারিক ক্লাস হয়, মাত্র এক শতাংশের সামান্য বেশি সংখ্যক বিদ্যালয়ে নিয়মিত ব্যবহারিক ক্লাস হয়। প্রায় ৯৫% বিদ্যালয়ে ব্যবহারিক ক্লাস মোটেই হয় না। অথচ পরীক্ষার্থীদের সবাই যেসব বিষয়ে ব্যবহারিক আছে সবকটি বিষয়ে ২৫-এর মধ্যে ২৪ বা ২৫ পায়। এটা কি পরীক্ষা না প্রহসন, এর কি কোনো অর্থ আছে? ব্যবহারিক পরীক্ষার এ সমস্যা গত তিন দশকের অধিক সময় ধরে চলে আসছে এবং ক্রমান্বয়ে এর অবনতি ঘটছে। উল্লিখিত প্রহসনের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বড়ই ভয়াবহ। দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয় ব্যবহারিক পরীক্ষায় ২৪ বা ২৫ দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বিষয়ের জন্য ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা করে আদায় করে। বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের ২৪ বা ২৫ করে দেওয়া হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে টাকা দিয়ে পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কেনা যায়। শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রচলিত এ অনৈতিক শিক্ষার বিরূপ প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক। কর্মজীবনে শিক্ষার্থী এ নীতি প্রয়োগ করলে তাকে দায়ী করা যাবে কি? একদিকে ‘নৈতিক বিকাশ’কে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে, অন্যদিকে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাতেই নৈতিকতা ধ্বংসের ‘সুব্যবস্থা’ বিদ্যমান। আমি আমার সব লেখায় এবং গণমাধ্যমে আলোচনায় সমস্যা ও সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-এ ব্যবহারিক পরীক্ষাকে ধারাবাহিক মূল্যায়নের অন্তর্ভুক্ত করে এর সমাধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে চালু করার আগে বর্তমান ব্যবস্থা চালু রেখেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।  নিম্নের ছকে উদাহরণের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের একটি উপায় উপস্থাপন করা হলো :

ব্যবহারিক পরীক্ষায় অন্যায্য নম্বর প্রদান নিয়ন্ত্রণের উপায়

নিয়ন্ত্রণের নীতি : পাবলিক পরীক্ষায় তাত্ত্বিক অংশে প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে ব্যবহারিক পরীক্ষায় প্রদত্ত নম্বরের পার্থক্য শতকরা ২০-এর (বা নির্ধারিত হারের) বেশি হলে ব্যবহারিক পরীক্ষায় প্রদত্ত নম্বর বাতিল বলে গণ্য হবে। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীকে তাত্ত্বিক অংশে প্রাপ্ত নম্বরের হারে ব্যবহারিকের নম্বর দেওয়া হবে।

ছকের বিশ্লেষণ : তাসলিম ও মিনহাজের ব্যবহারিক অংশে প্রাপ্ত নম্বর তাত্ত্বিক অংশের চেয়ে যথাক্রমে শতকরা ৪৮ এবং ৬৮ বেশি। তাই তাদের ব্যবহারিকের নম্বর পরিবর্তিত হয়ে পূর্ণমান ২৫-এর যথাক্রমে ১২ এবং ০৮ হলো। শীপা ও জালালের গড় নম্বরের পার্থক্য শতকরা ২০% এর কম, তাই ব্যবহারিক অংশের নম্বর অপরিবর্তিত থাকল। ধরা যাক হানিফ ভালো ছাত্র, ত্বাত্তিক অংশে ৭৫ এ ৬৬ অর্থাৎ ৮৮% নম্বর পেয়েছে। প্রাইভেট পড়েনি বিধায় তাকে ব্যবহারিকে পঁচিশে ১০ দেওয়া হয়েছে, ফলে শতকরা গড় পার্থক্য ৪৮-তে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহারিক পরীক্ষায় তাকে দেওয়া ১০ নম্বর পরিবর্তিত হয়ে ২২ হলো। উল্লিখিত নিয়ম চালু করা হলে ব্যবহারিক পরীক্ষক কর্তৃক মনগড়া অধিক নম্বর বা কম নম্বর দেওয়া অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। কোনো পরীক্ষক কর্তৃক ব্যবহারিক অংশে প্রদত্ত নম্বর যদি শতকরা ৪০ বা এর বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়, সে ক্ষেত্রে ওই পরীক্ষককে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে এবং তাকে পরবর্তীতে পরীক্ষক নিয়োগ করা যাবে না— এমন নীতিও গ্রহণ করা যেতে পারে। এসব নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায্য নম্বর প্রদান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এর ফলে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় বন্ধ হবে। শিক্ষা প্রক্রিয়া থেকে অনৈতিক শিক্ষা লাভের পথটিও বন্ধ হবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, যদিও বিজ্ঞান শাখায় অপেক্ষাকৃত ভালো ছাত্ররা ভর্তি হয়ে থেকে, তারা ব্যবহারিক পরীক্ষায় অন্যায্য অধিক নম্বর পেয়ে ব্যবসায় শিক্ষা এবং মানবিক শাখা থেকে পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফলে অধিক সুবিধা ভোগ করে থাকে। ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মোট ‘এ প্লাস’ প্রাপ্তদের ৮৫% বিজ্ঞান শাখার। প্রতি বিষয়ে দুই পেপার করে চারটি বিষয়ে আট পেপারে বিজ্ঞান শাখার সব শিক্ষার্থী ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৯০ থেকে ২০০ নম্বর পেয়েছে। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ নম্বর পাওয়ার যোগ্য নয়, এর অন্যতম কারণ তাদের অনেকেই ভালো ছাত্র কিন্তু ব্যবহারিক কোনো ক্লাস না হওয়ায় তারা এত বেশি নম্বর পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পায়নি। শিক্ষাক্রমের একজন প্রবীণ ছাত্র হিসেবে সবশেষে বলতে চাই ব্যবহারিক পরীক্ষাটির ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাক্রমে সব বিষয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য ২০% নম্বর ধার্য করা আছে, ধারাবাহিক অংশে প্রাপ্ত নম্বর বার্ষিক ও পাবলিক পরীক্ষায় যোগ করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে। সব বিষয়ে ধারাবাহিক পরীক্ষায় অন্যায্য নম্বর প্রদান নিয়ন্ত্রণের জন্য উল্লিখিত নীতি প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া যাবে।  ব্যবহারিক পরীক্ষা ধারাবাহিক মূল্যায়নভুক্ত করার আগে যতদিন আলাদা ব্যবহারিক পাবলিক পরীক্ষা চালু থাকবে, উল্লিখিত নীতি অবলম্বন করে একদিকে অন্যায্য নম্বর প্রদান নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অন্যদিকে টাকা দিয়ে নম্বর কেনার সুযোগ বন্ধ করে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করা যাবে।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক ও প্রাক্তন পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর