রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেগম জিয়ার প্রধান বাধা জামায়াত?

স্বপন দাশগুপ্ত

জামায়াত নিয়ে বিএনপি ‘রাজনৈতিক’ সংকটে রয়েছে। জামায়াতকে ২০ দলীয় জোট থেকে বের করে দিতে পারছে না বিএনপি। আবার জামায়াতকে বাদ না দিলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠছে না।  ইতিমধ্যে জাতীয় ঐক্যের সূচনা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু বৈঠকটি ফলপ্রসূ হয়নি। বৈঠকের ফলাফল নিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া আমাদের ডেকে ছিলেন। দেশে যাতে জঙ্গি দমন হয় সে কারণে একটি ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোনো ঐক্য করতে যাইনি, আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছি, জামায়াতের সঙ্গে কোনো রাজনীতি আমি করব না। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে খালেদা জিয়ার যদি প্রকৃত জন্মদিনও হয় সেটা পালন করা চলবে না।’ জামায়াত প্রশ্নে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত ঐক্য প্রথমেই হোঁচট খেল। ডক্টর কামাল হোসেনের গণফোরাম, অধ্যাপক বি. চৌধুরীর বিকল্প ধারা ও আ স ম আবদুর রবের জেএসডির সঙ্গে বেগম জিয়ার বৈঠক করার সম্ভাবনা রয়েছে। জামায়াতকে বাদ না দিলে তাদের সঙ্গেও বৈঠক ফলপ্রসূ হবে না। গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বেগম জিয়া জামায়াতকে বাদ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ তিনি এও বলেছেন, ‘জামায়াত এখন বিএনপির জন্য সম্পদ নয়, বোঝা।’ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের এ বক্তব্যকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান তার (অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ) ব্যক্তিগত মত বলে অভিহিত করেছেন। তখনই বোঝা গেছে বিএনপি জামায়াতকে কোনোভাবেই ছাড়বে না। প্রস্তাবিত ঐক্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান হয়েছিলাম। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বৈঠকের পর তা আরও স্পষ্ট হলো। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও হান্নান শাহ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বৈঠকের পর বলেছেন, ‘শর্ত দিয়ে ঐক্য হয় না।’ তারা এও বলেছেন, জামায়াতকে বিএনপি ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগ কোলে টেনে নেবে। বিএনপি নেতাদের এ বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে জামায়াতকে তারা তাদের জোট থেকে আলাদা করবে না। এ অবস্থায় বেগম জিয়ার প্রস্তাবিত ঐক্য যে ভেস্তে যাবে, এটা নিশ্চিত। এই প্রেক্ষাপটে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি আলাদা ঐক্য করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগে শামিল হবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম ও বিকল্পধারা।

এ তো গেল ঐক্যের বিষয়। এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি প্রতিদিনই তীব্রতর হচ্ছে। অনেকে প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। এদিকে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে হাইকোর্ট রায় প্রদান করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে। এই আপিলটি এখনো সুপ্রিমকোর্টের কার্যতালিকায় আসেনি। কবে আসবে তা কেউ বলতে পারে না। ধারণা করা হচ্ছে, এই বছরের শেষ দিকে আপিল মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য আসতে পারে। যদিও এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশোধনকে চিহ্নিত করেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে আইন সংশোধন করেছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটি উত্থাপিত হলে তা চূড়ান্ত করা হবে।’ তিনি এও বলেছেন, সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে এই আইনটি পাস হতে পারে।

ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম, জামায়াত আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার বিচার শেষ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই পর্যন্ত মোট ২৪টি মামলায় ৩৪ জন আসামির বিচার শেষ করেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধ্যাপক গোলাম আযমসহ জামায়াত নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের রায়ে জামায়াতকে সন্ত্রাসী ও ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি মামলার রায়েই ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে অভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগও ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণকে বহাল রেখেছে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকে জঙ্গি ও ক্রিমিনাল সংগঠন ঘোষণা করার পরও কোন কারণে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না তা আজও অজ্ঞাত। ১৯৭১ সালে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে তখনই দেশে এই শক্তির বিরুদ্ধে জনমত সোচ্চার হয়েছিল। এ কারণেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী সংগঠনগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। সংবিধানেও এসব রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিধান সংযুক্ত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার আগ পর্যন্ত জামায়াত ও মুসলিম লীগসহ অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। মরহুম জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্যের কথা বলে এসব দলের রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করেন। এমনকি সামরিক অধ্যাদেশ বলে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার সাংবিধানিকভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় থেকে দেশ উল্টোদিকে চলতে শুরু করে। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতায় এসে একই ধারা বহাল রাখেন। শুধু তাই নয়, সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই ধারা পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নেয়। তবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় আওয়ামী লীগ ওই সময় সংবিধান সংশোধন করতে পারেনি। এরপর ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। শুরুতেই তারা হিন্দু প্রাধান্য এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী করা হয়েছে। যেমনিভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী করেছিলেন জিয়া ও এরশাদ। দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নষ্ট করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ক্ষমতায় আসে জেনারেল মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ক্ষমতায় এসেই তারা বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এই সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হলে ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট আবার ক্ষমতায় আসে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করে। তবে ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম ও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার সংবিধানে রেখে দেওয়া হয়। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের সমঅধিকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও এর সুফল জনগণ পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পায়নি। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও শেখ হাসিনার সরকার আবার ক্ষমতায় আসে। গঠন করা হয় ১৪ দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার।

২০১০ সালে জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াত নেতাদের বিচারের সম্মুখীন করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ৫ শীর্ষ জামায়াত নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও ট্রাইব্যুনালের রায়ের এসব পর্যবেক্ষণের ফলে জামায়াতের বিচার এবং জামায়াতের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক-বীমা, হাসপাতালসহ অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের অনুকূলে আনার দাবি উত্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল এই দাবিতে সোচ্চার রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের লক্ষ্যে তদন্ত করে তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়। এই রিপোর্টের আলোকেই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা (আইনজীবী) জামায়াতের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানায়। এ আবেদনের পরেই সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করা যায় কিনা এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা পরস্পরবিরোধী মতামত দিতে থাকেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ অভিমত রাখেন, প্রচলিত আইনেই জামায়াতের বিচার করা সম্ভব। ট্রাইব্যুনালের একাধিক প্রসিকিউটরও এই অভিমতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। কিন্তু বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে জামায়াতের বিচার করা সম্ভব বলে তার মতামত দেন।   শেষ পর্যন্ত সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। এরই আলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশোধন করা হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর