মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

একজন মোহাম্মদ আলী

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

একজন মোহাম্মদ আলী

ঈদ মোবারক। ঈদ। এবারের ঈদ নির্বিঘ্নে কাটলেও রাস্তাঘাটে মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। ঈদের আগে-পরে একই রকম। বিমান, নৌ, রেল যোগাযোগ তো আগেই বেহাল হয়েছিল। সড়ক যোগাযোগ যাও-বা ছিল তাও এবার বলতে গেলে একেবারেই ভেঙে গেছে। লিখতে চেয়েছিলাম ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের মিলনমেলার চোখ জুড়ানো চমৎকার সমাবেশের কথা। চরমোনাই পীরের কিছু মুরিদ আমাকে নিয়ে লিখেছিলেন আমি নাকি তাদের পীরকে মানি না। কদিন পর আবার পত্রিকায় দেখলাম চরমোনাইকে পাকিস্তানি-ঘেঁষা বলেছি তাতে তারা বেশ ক্ষুব্ধ। কী বলব, ঘেঁষাকে ঘেঁষা বললে তাতে কী?

মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহতা এখন যারা আন্দাজ করতে পারেন না তারা অনেক কথাই বলতে পারেন। তাতে তাদের দোষ নেই। ঠিক আছে যখন জানতেই চেয়েছেন তখন কোন জেনারেল কবে কতবার হেলিকপ্টারে, কতবার জাহাজে চরমোনাই গেছেন; চরমোনাইরা ডিসি-এসপির কাছে কতবার কখন কখন যাতায়াত করেছেন তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তার একটা বিবরণ অবশ্যই তুলে দেব। কাগজপত্র সবই আছে। তাই সেগুলো দিতে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে চরমোনাই বা ইসলামী আন্দোলন শুধু যে পীরালি করতে চায় না দেশের আপামর জনসাধারণের কল্যাণে রাজনীতি করতে চায় এবং তা রাজনৈতিকভাবেই করতে চায় এটা জেনে খুশি হলাম। এজন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। সেই কবে ক্ষুদিরামের মা পড়েছিলাম, আজ তেমন মনেও নেই। সে রকম ডা. মিলনের মাকে বলেছিলাম, জনাব জি এম কাদের মুক্তিযোদ্ধা নন। মুক্তিযুদ্ধের আশপাশেও ছিলেন না। বাড়ির পাশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গেলে তাদের দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখে আর যাই হোক মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। পল্লীবন্ধু জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন এটা সর্বজনবিদিত। আর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি যে পাকিস্তানে বসে বসে আঙ্গুল চোষেননি তা সবার জানা। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বা অনুগতদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব ছিল তার। আর সে দায়িত্ব যে তিনি বেশ সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন তা পাকিস্তান সরকারের কাগজপত্র দেখলেই বোঝা যায়। জাতীয় পার্টির শ্রী সুনীল শুভরায় কেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন বুঝতে পারলাম না, সত্যিই কি তিনি এসব জানেন না? হতাশ হবেন না। আমি আপনাকে অবশ্য অবশ্যই সব সরকারি কাগজপত্র দিয়ে সাহায্য করব। কী হবে আপনাকে ছোট করায় বা মনে কষ্ট দেওয়ায়। আপনি লিখেছেন মাত্র এক মাসের জন্য জনাব এরশাদ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। এটা তার জীবনের বড় বেশি কষ্ট। তার মানে মার্চের শেষে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি ছুটি কাটিয়ে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে গিয়ে আটকা পড়েন। তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সত্যিই যদি এমন হতো তাহলে আমি তার জন্য আপনার চেয়ে বেশি ব্যথিত হতাম। কিন্তু ঘটনাটা তো সত্যিই তেমন নয়। তিনি তো মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকেও জ্বলন্ত বাংলাদেশে এসে অনেক দিন, প্রায় মাসের ওপরে রংপুর, ঢাকাসহ অন্যান্য জায়গায় কাটিয়েছেন। এসব বিশদ লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মোহাম্মদ আলীর আকস্মিক মৃত্যু আমায় এলোমেলো করে দিয়েছে। পরে কোনো দিন সরকারি কাগজপত্রসহ লিখব যাতে কারও কোনো সন্দেহ না থাকে। ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। মনটা ছিল বড় বেশি ভারাক্রান্ত। ৮ তারিখই টাঙ্গাইল যেতে চেয়েছিলাম। সেদিন রাস্তাও ছিল অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু আমার বুকের ধন কলিজার টুকরা কুশিমণির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারিনি। অন্যদিকে বড় মেয়েটা লন্ডনে। তাই সবকিছু থাকতেও মনটা কেন যেন বড় বেশি হাহাকার করে। কুশিমণি বলছিল, ‘আব্বু, আজ না গেলে হয় না? স্কুল থেকে এসে যেতে আমার ভালো লাগবে না।’ বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে অসুবিধা কী? পরদিনই যাব।’ যেহেতু ওই দিন যাওয়া হচ্ছে না তাই ঈদের আগে চুল কাটাতে চেয়েছিলাম। সাড়ে ১০টা-১১টা হবে। ফরিদকে বলেছিলাম, ‘মোহাম্মদ আলীকে খবর দে চুল কাটতে হবে।’ ফরিদ তখনই মোহাম্মদ আলীকে ফোন করেছিল। বছরের পর বছর যেভাবে ফরিদের সঙ্গে কথা বলে, সেভাবেই বলেছিল— ‘এখনই আসছি।’

বজ্রকথন আর স্বাধীনতা ’৭১ বই দুটি কয়েক মাস যাবৎ পরিপাটি করছি। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর সপ্তাহ দুই ভালোভাবে চোখ বোলালেই শেষ হয়ে যাবে। তাতে বই দুটি পড়ে পাঠকদের বেশ ভালো লাগবে। উঁচু-নিচুতে কেউ হোঁচট খাবে না। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। ফরিদকে আবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কই, মোহাম্মদ আলী এলো না?’ সে নিচে গিয়ে ফোন করে। ফোন আরেকজন ধরে। সে বলে, ‘মোহাম্মদ আলী নেই। হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।’ আমি তখনো বারান্দায় বসে কাজ করছিলাম। ফরিদ এসে বলল, ‘দাদা, আজ আপনার চুল কাটা হবে না।’ কেন হবে না বলতে যাব এমন সময় চোখে পানি নিয়ে বলল, ‘মোহাম্মদ আলী ভাই নেই।’ আমি চমকে উঠেছিলাম। কী বলিস? এই না বললি মোহাম্মদ আলী আসছে। কেমন যেন হয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু আমাকে যেভাবে নাড়া দিয়েছিল, মা-বাবা চলে গেলে যেমন ব্যথা পেয়েছি, হঠাৎই মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুর সংবাদ আমাকে যেন কেমন আকুল করে ফেলে। বুঝতেই পারিনি। ’৯০-এ নির্বাসন থেকে দেশে ফিরলে সব সময় মোহাম্মদ আলীই চুল কাটত। একজন অতি সাধারণ মানুষ। সে যে কখন কীভাবে হৃদয়ের এতটা জায়গা দখল করেছিল কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি। ফরিদ আগের মতো নেই। কেমন যেন খেইছাড়া হয়ে গেছে। যখন যা বলার অনেক সময় ভেবেচিন্তে বলে না বা বলতে পারে না। কিন্তু মনে হয় অনেক দিন পর এই প্রথম খুবই দক্ষতার সঙ্গে একটা মৃত্যু সংবাদ আমাকে দিয়েছে, ‘দাদা, মনে হয় আজ আপনার চুল কাটা হবে না।’ মোহাম্মদ আলী মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে বাস করত। অতি সাধারণ খেটে খাওয়া একজন মানুষ। আমি অমন নির্লোভ সদালাপী সৎ মানুষ খুব একটা দেখিনি। আমার বাসার কাছেই একটা ঘরে কাজ করত। বাড়িওয়ালা যখন নতুন দালান করে তখন সে বেকার হয়ে পড়ে। বছর-দুই বছর বাড়ি বাড়ি চুল কেটে কোনোভাবে সংসার চালাত। হঠাৎ একদিন চুল কাটার সময় বলেছিল, ‘কয়েকটা টাকা সংগ্রহ করেছি আর কটা হলে কোনার দিকে ইঞ্জিনিয়ার সালাম সাহেবের বাড়ির পাশে একটু জায়গা আছে সেখানে একটা দোকান করা যায়।’ ইঞ্জিনিয়ার সালাম একসময় গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। আমার টাঙ্গাইলের বাসা পর্যন্ত গেছেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার ভাতিজাদের দু-তিনশ স্কয়ার ফুটের ছোট্ট একটু জায়গা। বলার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল। আমিও সামান্য কিছু টাকাপয়সা দিয়েছিলাম। বাবর রোডের যে বাড়িতে থাকি সেটা কবুতরের খোপ বা হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়ও বলা যায়। তাই একটু ভাঙচুর করে দু-তিনটি ঘর ঠিকঠাক করেছিলাম। পাশে একটি ডেভেলপার, মেজর মোহাম্মদ শফিউল আলম কাজ করছিল। তার লেবার সরদার আইনুলকে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আইনুল আর আমার সোনার বাংলার ইঞ্জিনিয়ার বিমল মিলে দুই-আড়াই লাখ টাকার বরাদ্দ চেয়েছিল। সেভাবেই কাজ শুরু হয় যা ১২-১৩ লাখে শেষ হয়। সে সময় বাড়ির ভাঙাচোরা টাইলসগুলো মোহাম্মদ আলীর দোকানে দিয়েছিলাম। তাতে সে খুব খুশি, পাগল হয়ে গিয়েছিল। জীবনে কতজনকে কত কিছু দিয়েছি, প্রয়োজনে না খেয়ে খাইয়েছি— সেসব অনেকেই মনে রাখেনি। কিন্তু এই গরিব মানুষটি মনে রেখেছিল।

চুল কাটতে যখনই আসত নানা কথা বলত। ’৯০ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমার বাড়িতে কে কখন এসেছে সব ছিল তার নখদর্পণে। কবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসে ছেলেমেয়েদের দেখে গেছেন, কবে কোন মন্ত্রী, নেতা এসেছেন সে নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। সুযোগ পেলেই বলত বাবর রোডে যারাই আসে তাদের ভাগ্য খুলে যায়। এটা বলার অর্থ, একসময় সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক আর বর্তমান সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ নিয়ে। আমরা তাদের গামছা দিয়েছিলাম। এখন আমার গামছা ছাড়া আর কী আছে? রক্ত-ঘামে অর্জিত গামছাই আজকাল যাকে পাই তাকে হৃদয়ের ভালোবাসা হিসেবে উপহার দিই। তাই তাদেরও দিয়েছিলাম। কিছুদিন পরই তিনি মন্ত্রী হন। জনাব ওবায়দুল কাদেরের মন্ত্রী হওয়া মোহাম্মদ আলীর কাছে মনে হয়েছিল ওটা আমার বাড়ি আসার আশীর্বাদ।

মানুষ মরণশীল। আমরা সবাই মরব। কিন্তু একমুহূর্ত আগে আসছি বলে যে এলো না বা আসতে পারল না, পরপারে চলে গেল। ব্যাপারটা আমায় ভীষণ নাড়া দিয়েছে। কিসের আশায় কিসের জন্য এত ভেদাভেদ, এত অহংকার? একজন সুস্থ মানুষ আসছি বলে কেন মাত্র কয়েকশ গজ আসতে পারল না? তাহলে কেন এত দ্বন্দ্ব-সংঘাত? মন বড় ভারাক্রান্ত হয়েছিল। দুপুর-রাত, পরদিনও ভালোভাবে খেতে পারিনি। কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। এক গভীর শূন্যতা গ্রাস করে চলেছিল।

৯ তারিখ শুক্রবার যাতে টাঙ্গাইলে বা তার আশপাশে জুমার নামাজ আদায় করতে পারি এমন একটা চিন্তা নিয়ে ১০টা-সোয়া ১০টায় রওনা হয়েছিলাম। মোহাম্মদপুর থেকে বেরিয়ে দারুসসালামে প্রতিদিন একটা যানজটে পড়তে হয়। তারপর টেকনিক্যাল, মাজার রোড, গাবতলী, আমিনবাজার যানজট এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। হেমায়েতপুরে তো জ্যামে পড়তেই হবে। তারপর গেণ্ডা, সাভার বাজার— এসব জায়গায় কোনো মুক্তি নেই। কখনো এক-দেড়-দুই ঘণ্টা। আমরা যারা যাতায়াত করি এটা প্রায় গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার সেদিন ওসব জায়গায় এক মিনিটও দাঁড়াতে হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিরাট জটলা দেখে উল্টা পথ ফাঁকা পেয়ে সে পথ ধরেছিলাম। সাভার ক্যান্টনমেন্টের গেটে মাননীয় সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা। মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে আগাগোড়াই আমি খুব ভালোবাসি, স্নেহ করি। তিনিও আমায় যথার্থই সম্মান করেন। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে জর্জরিত হয়ে যখন দিল্লির এ্যাপোলোতে ছিলেন তখন একদিন হাত ধরে বলেছিলেন, ‘কাদের ভাই, আমরা কি এভাবে মরে যাব? কিছু একটা করেন।’ তার সেই আকুতি আমায় আকুল করে দিয়েছিল। সেদিন উল্টো পথে গাড়িতে আমাকে দেখে এগিয়ে এসে যথার্থ মন্ত্রীর মতোই বলেছিলেন, ‘আপনিও এভাবে এলে আমি কী করব?’ আমি তার অসহায়ত্ব বুঝেছিলাম, তিনি আমারটা বুঝেছিলেন কিনা জানি না। তবে তার তত্পরতা, ভদ্রতা, শালীনতা খুবই ভালো লেগেছে। তার সাহায্যে বা সম্মানে উল্টো পথ থেকে সোজা পথে বড়জোর ৫০০ গজ নবীনগরের মোড়ে আসতে ঘণ্টা দেড়েক লেগেছিল। নবীনগর মোড় থেকে আবার একেবারে ফাঁকা। প্রায় দিনই পল্লী বিদ্যুৎ, বাইপাইল, ইপিজেড, ফজিলাতুন নেছা হাসপাতাল, জিরানীতে জ্যাম লেগেই থাকে। কিন্তু ওসব জায়গায় সেদিন কোনো যানজট ছিল না। আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে মনের আনন্দে এগোচ্ছিলাম। ওমা! বারুইপাড়া এসে দেখি প্রচণ্ড যানজট। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম দেড় ঘণ্টা। নন্দনের কাছে ১০০ গজ এগোতে পারলে গ্রামের পথ ধরে এগোতে পারতাম। সেই ১০০ গজ এগোতে লেগেছিল দেড় ঘণ্টা। বারুইপাড়ায় নামাজ আদায় করে কালিয়াকৈরের কাছে মূল সড়কে মোটামুটি ভালোই চলছিলাম। পাকুল্লার কাছে আবার মারাত্মক জ্যাম। আল্লাহর কৃপায় এবং কয়েকজন পুলিশের সহায়তায় দেলদুয়ারের রাস্তা ধরায় সাড়ে ৬ ঘণ্টায় সেদিন টাঙ্গাইল পৌঁছেছিলাম। দেলদুয়ারের রাস্তা না ধরলে বা ধরতে না পারলে আরও ৪ ঘণ্টা লাগত।

প্রিয় ওবায়দুল কাদের, আপনাকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসি, স্নেহ ও মঙ্গল কামনা করি। যদিও জানি আজকাল ভালোবাসা-স্নেহের মূল্য নেই। অনেকে স্নেহ খোঁজে না, ক্ষমতা খোঁজে। তবু বলি আমায় উল্টো পথে দেখে নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছেন। আপনি সবাইকে আইন মানাতে চান। আমিও তো মানতে চাই। আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু সত্যিই যদি সবাই সমান হতো তাহলে আমার কোনো আপত্তি থাকত না। কিন্তু তা নয়, মেরেপিটে দেশ চালানো যায় না। আপনি কত কষ্ট করছেন, আমাকে যদি সোজা পথ দিয়ে দুই ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছে দিতে পারতেন তাহলে উল্টা পথের দরকার কী? আল্লাহর কাছে কতই না দোয়া করতে পারতাম। দুই ঘণ্টার জায়গায় তিন ঘণ্টা, ঈদের কারণে না হয় চার ঘণ্টা। কিন্তু অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ছোট্ট বাচ্চা সঙ্গে থাকলে এমনটা চলে? না চলে না। আপনার প্রায় সব রাস্তার ৩০-৪০ ভাগ দোকানপাট, ঘরদোর, গাড়িঘোড়া, ইট-পাটকেলে অকেজো। চালকের যেমন সঠিক প্রশিক্ষণ নেই, যারা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরও নির্দেশনার তেমন জ্ঞান নেই। কত কিছু করেন আমাদের মতো অপদার্থদের দু-একবার পরামর্শ নিতে পারেন না? ভাগ্য আমাদের পেছনে দিয়ে আপনারা না হয় আগে আছেন। কিন্তু দেশের মানুষের কষ্ট লাঘবে তো কিছু করবেন। প্রায় সব রাস্তায় ১৫-২০ ফুট আইল্যান্ড দিয়ে বসে আছেন। এক মেয়রের কথায় মাইলের পর মাইল ক্রসিং বন্ধ। বিপদের সময় যেটা ব্যবহার করা যায়। রাস্তার দিকে দৃষ্টি দিন। মানুষকে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার সুযোগ দিন। সফল হলে আপনাকে অনেকেই মনে রাখবে। আপনাকেই বলি মাননীয় সেতুমন্ত্রী, আমার বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন, ঈদের আগে ও পরে সারা দিন রোদ খাঁখাঁ করল। ঈদের দিন বিপর্যয়।

এমনিতেই দেশে জালিয়াতির শেষ নেই। এবার কোরবানির চামড়া নিয়ে যেভাবে গরিবের হক নষ্ট করা হলো, আল্লাহ সহ্য করবেন না। যারা কোরবানি দেন তারা চামড়া বেচার জন্য কোরবানি দেন না। চামড়া বেশির ভাগই গরিব-দুঃখীকে দেওয়া হয়। বিশেষ করে মাদ্রাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে। এবার তাদের হক যেভাবে লুট করা হয়েছে আমার বিশ্বাস আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এটা সহজভাবে নেবেন না। মাননীয় মন্ত্রী, এত সড়ক দুর্ঘটনা, এত মানুষের মৃত্যু একটুও কি খারাপ লাগে না? একটা কিছু করুন। আল্লাহ খুশি হবেন।

মনে হয় দুই বছর পর আলী আজগর খান দাউদের নামাজে জানাজায় বড় ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। আলী আজগর খান দাউদ ’৬৯ সালে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। যাদের বুকের পাঁজরের ওপর ভর করে স্বাধীনতা এসেছে, ধীরে ধীরে তাদের প্রায় সবাইকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আজ কারও কোনো অস্তিত্ব নেই, কোনো মূল্য নেই। ’৬৯ সালের সেই উত্তাল দিনগুলোয় আমরা যদি ওভাবে আইয়ুব-মোনায়েমকে নাস্তানাবুদ করতে না পারতাম, আরাম-আয়েশে গা ভাসিয়ে দিতাম, তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেতেন না। হয়তো তার ফাঁসি হতো। আলী আজগর খান দাউদ ছিলেন সব ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। অন্যজন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের হামিদুল হক মোহন। আবার স্বাধীনতার ঊষাকালে ’৭১-এ টাঙ্গাইল জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেবার আমরা নিজেরা নিজেরাই। টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের তখন দুই কমিটি। একটির সভাপতি খন্দকার আবদুল বাতেন, অন্যটির আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম। আমি আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমের কমিটির সাধারণ সম্পাদক। আলমগীর খান মেনু খন্দকার আবদুল বাতেনের কমিটির সাধারণ সম্পাদক। দুই সাধারণ সম্পাদককে জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। ’৬৯-এ বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে সেই ছাত্র জনসভায় যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে হুজুর মওলানা ভাসানীর সভার সভাপতিত্ব করছিলেন আলী আজগর খান দাউদ। সভা পরিচালনা করছিলেন হামিদুল হক মোহন। তেমনি ’৭১ সালের ২৩ মার্চ বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পতাকা দিবসে সভাপতিত্ব করেন আলমগীর খান মেনু। পরিচালনা করি আমি। প্রধান অতিথি হিসেবে কালিহাতীর সংসদ সদস্য আমাদের নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবেগময়ী শপথবাক্য পাঠ করান। আলী আজগর খান দাউদ হুজুর মওলানা ভাসানীর সভায় সভাপতিত্ব করার সময় শৃঙ্খলা ফেরাতে হুজুরের ঐতিহাসিক ‘খামোশ’ নিজের কণ্ঠে ধারণ করে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বিস্মিত করে এক ইতিহাস রচনা করেছিলেন। সেই মানুষটি ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কমিশন দিবসে চিরবিদায় নিলেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মন ভারী ছিল। বড় ভাইয়ের পাশে সন্তানের মতোই দাঁড়িয়েছিলাম। ডানে ছিলেন ফজলুর রহমান খান ফারুক, তারপর আমার এক মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবদুর রাজ্জাক। প্রচণ্ড গরম। অনেকেই লম্বা বক্তৃতা করেছেন। যা জানাজায় শোভন নয়। আমি সাহস পাইনি। বুকের শক্তি ছিল না। তাই মাইকে যাইনি। কেমন যেন ভারী বুক আরও ভারী হলো। আল্লাহ আলী আজগর খান দাউদকে তার ভুলত্রুটি সব মাফ করে বেহেশতবাসী করুন। আমিন।

লেখক : রাজনীতিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর