বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ... দুর্বৃত্তায়িত বাংলাদেশ

লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ... দুর্বৃত্তায়িত বাংলাদেশ

বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি রাজনীতি। অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম বছরখানেক আগে। ড. কামাল হোসেনসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষিত সমাজ, সুধীমহলে অনেক কথা হচ্ছিল। যারা দেশ নিয়ে ভাবেন, সমাজ নিয়ে চিন্তা করেন এমন সমাজকর্মী, চিন্তক, দার্শনিকরা আজ চরম উদ্বিগ্ন। বিষয়টি এখন দেশের সভা-সেমিনার, টকশোয় সবচেয়ে আলোচিত।

দীর্ঘদিন ধরেই অবাক বিস্ময়ে অনেককেই বলতে শুনছি বাংলাদেশে এ কী হচ্ছে? রাজনীতিকরা এ কী করছেন? দেশটাকে তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? quo vadis আমরা কোথায় চলেছি? ‘কোথায় চলেছে স্বদেশ উদ্ভট এক উটের পিঠে?’ এ কোন রাজনীতি? বাংলাদেশকে তারা আর কোথায় নিতে চাচ্ছেন? গভীর খাদের প্রান্তসীমায় সে তো পৌঁছেই গেছে।

বাংলাদেশে চলছে এক চরম দুর্বৃত্তায়ন। জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গন দুর্বৃত্ত দ্বারা পরিবেষ্টিত, পরিচালিত। তাদের আধিপত্য চারদিকে বিস্তৃত। তারা প্রচণ্ড শক্তিধর। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী যে যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত সে তত বড় ক্ষমতাবান। সমাজে সে তত উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত। তারা সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে, মানুষকে ভয় দেখায়, আতঙ্কিত করে। তারা অঙ্গচ্ছেদ করে, রগ কাটে, কব্জি বিচ্ছিন্ন করে দেয়, মানুষকে গলা কেটে জবাই করে, হত্যা করে, গুম করে। লাশ কোনোভাবেই যেন শনাক্ত না করা যায় তার জন্য খণ্ডবিখণ্ড করে। যেমন মাংস বিক্রেতা কাঠের পাটাতনে দা হাতে টুকরো টুকরো করে দেয় ক্রেতাকে। সমাজে এই দুর্বৃত্তায়নের সংক্রমণ মহামারীর মতো ছড়িয়ে গেছে। মানুষ শান্তি খুঁজছে, নিভৃত কোনো নিরাপদ স্থান, একটু স্বস্তি হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জায়গা। না, এ বিশ্বচরাচরে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে এমন একটি জায়গা আপনাকে কেউ দিতে পারবে না। শহর, বন্দর, গ্রাম, বন-জঙ্গল, পাহাড়, নদী, চর, জলা কোথাও নেই। সব দুর্বৃত্তায়িত হয়ে গেছে। দুর্বৃত্তরা সব গ্রাস করে চলেছে, আধিপত্য বিস্তার করছে। বাংলাদেশ আজ যেন দানবের দেশ। বাংলাদেশের সবকিছু দখল হয়ে গেছে। দখলবাজ আর দখলবাজে লড়াই হচ্ছে। নতুন দখলবাজ জন্ম নিচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে নতুন দুর্বৃত্ত, নতুন সন্ত্রাসী, নতুন গডফাদার। এর বাইরে আজ বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশের আজ এটাই চিত্র, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এটাই বাস্তব রূপ। বাংলাদেশে জঙ্গির উত্থান ঘটছে। বিস্তৃত হচ্ছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্বৃত্তায়নের এক চূড়ান্ত রূপ। তার উত্পত্তিও দুর্বৃত্তবাদ থেকেই।

দুর্বৃত্তরা আজ বাংলাদেশের নদী, নদীতে পড়া চর, নদীর বালুতট, তার তলদেশ, পাহাড়, বন, শ্মশানঘাট, কবরস্থান সর্বস্ব খেয়ে চলেছে। সর্বভুক, সর্বগ্রাসী এরা। এরাই আদিবাসীদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে ভিটেছাড়া করে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপাসনালয়ে দেব-দেবীর প্রতিমা, যিশু, মেরির মূর্তি তারা ভেঙে চূর্ণ করে। আমি রামু, কক্সবাজার, নীলায় তাদের বীভৎস ত্রাস দেখেছি। বৌদ্ধ মন্দির তছনছ করতে দেখেছি। গেরুয়া পরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে হত্যা হতে দেখেছি। দেখেছি তাদের গ্রাম-লোকালয় আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলতে। আমি সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, যশোর, পাবনা, খুলনায় দুর্বৃত্তদের পৈশাচিক তাণ্ডবনৃত্য দেখেছি। দেখেছি অসহায় গরিব খেটে খাওয়া মানুষের ওপর ধর্মের নামে চড়াও হওয়া, আগুন জ্বালানো, সবকিছু লুটপাট হওয়া। দেখেছি কিশোরী ও যুবতীরা কীভাবে ধর্ষণের শিকার হলো। কীভাবে তারা নদীর বাঁধের ধারে, বনে বাদাড়ে, কোথাও বা মাটি খুঁড়ে, কোথাও বা বালু তুলে দেয়াল বানিয়ে আশ্রয় খোঁজার বৃথা প্রয়াস নিল, দৃষ্টির অগোচরে তারা হারিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু না, শেষ রক্ষা হয়নি। তাদের দুর্বৃত্ত-ভোগ্যা হতে হয়েছে। হায়রে ধর্ষিতা বাংলাদেশ! সীমাহীন লাম্পট্যের বাংলাদেশ! চরম বর্বরের বাংলাদেশ!

বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আমার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনি প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। এক রাজনৈতিক ও অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নান্দনিক নির্বাচন তিনি উপহার দিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করার। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলায় তাকে সাহায্য করার। বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রয়াত। জীবনের শেষ বছরগুলোয় তিনি একজন দার্শনিক, চিন্তক ও অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশকে দিশা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সংকটে জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছিলেন। তিনি জাতির অবক্ষয় ও নীতিহীনতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। জাতের নামে বজ্জাতি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন কী দ্রুতবেগে দেশ রসাতলে তলিয়ে যাচ্ছে। অনৈতিকতার পাঁকে জড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের পঙ্কিলে নিমজ্জিত হচ্ছে। তিনি দেখেছিলেন মানুষের সুবৃত্তিগুলো কীভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। সমাজে মূল্যবানেরা কীভাবে চরম মূল্যহীন হচ্ছে আর মূল্যহীনেরা কীভাবে মহামূল্যবান হচ্ছে। দুর্বৃত্তরা সমাজপতি হচ্ছে, উচ্চাসনে বসছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার জীবনের শেষ দিনগুলোয় জাতিকে নিয়ে বেশি আশাবাদী হতে পারেননি। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখায়-বক্তৃতায়-কথায় ও কবিতায় তা প্রকাশ করেছেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, রাষ্ট্র আজ বাজিকরদের হাতে চলে গেছে। গলাবাজ, চাপাবাজ, দলবাজ, লাঠিবাজ, অস্ত্রবাজ, টেন্ডারবাজ, জুয়াবাজদের হাতে অষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিদ্রোহ করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন মহাবিদ্রোহী। শোষণ-বঞ্চনা, অন্যায়-অবিচার, নিপীড়ন-অত্যাচার তাকে বিদ্রোহী করেছিল। তাই তিনি শপথ নিয়েছিলেন—

‘চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত

যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।’

বিদ্রোহী কবি শব্দশক্তির ঝড় উঠিয়েছিলেন, অগ্নিবীণায় ঝঙ্কার তুলেছিলেন, কলমে আগুন ঝরিয়েছিলেন। কবি তার সময়ের সমাজের নীচুতা-শঠতা, নৈতিক অবক্ষয় ও পারিপার্শ্বিক নিকৃষ্টতায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন—

‘বন্ধুগো আর বলিতে পারি না বড় বিষ জ্বালা এই বুকে

দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি। তাই যাহা আসে কই মুখে।

রক্ত ঝরাতে পারিনাগো একা তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা

অমর কবিতা তোমরা লিখিও বন্ধু যাহারা আছো সুখে।’

মনে পড়ছে বছরখানেক আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম কোনো এক নব্য রাজপুত্র ‘প্রিন্স’ হীরার জুতা, সোনার জামা, কোটি টাকার ঘড়ি পরিহিত হয়ে বিশাল এক মহিলা দেহরক্ষী বাহিনী নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আহৃত হয়ে  আসেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে তার ৭ বিলিয়ন ডলার (৫৬ হাজার কোটি টাকা) গচ্ছিত আছে। কোথায় এ অর্থের উৎস, কোথা থেকে আহরিত তার আলী বাবার এ সম্পদ? বৈদেশিক ব্যাংকে এই হতদরিদ্র বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা দিনে দিনে গচ্ছিত হয়েছে। দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা। বিত্তবানেরা ‘সেকেন্ড হোম’ তৈরি করেছেন, কিনছেন বিত্তবান-ধনাঢ্য সব দেশে— কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মরিশাস, সাইপ্রাসে। শেয়ারবাজারে, ডেসটিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপে, বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতির এক একটি মহাউপাখ্যান, মহাকাব্য রচিত হয়েছে। দেশজুড়ে হয়েছে লুটপাট, হরিলুট; আর লুটের টাকা সব বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংকের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা গোটা জাতীয় আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে অন্তঃসারশূন্য খোকলা করে দিয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে চুরমার করে দিয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, তার ব্যাংকিং ডিভিশন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্বাক, মূক ও বধির, স্থবির। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী লাচার, নিরুপায়। সংসদে তিনি চিৎকার করে আক্ষেপ করছেন, ‘বাংলাদেশে পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি হচ্ছে। কে করছে আমরা সব জানি কিন্তু কিছু করা যাচ্ছে না।’ কী অসহায় তিনি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সোনালি ফসল। এই কি সেই ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশ! এই কি সেই লাখ লাখ মা-বোনের লাঞ্ছনা আর আর্তনাদের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ!

সম্প্রতি টিআইবির রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশ এ বছর দুর্নীতির সূচকে আরও নিম্নগামী হয়েছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গত দশকে বাংলাদেশ পৌনঃপুনিকভাবে পাঁচবার পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এতদিনেও অবস্থার এতটুকু পরিবর্তন হয়েছে বলে মানুষ মনে করে না। সামগ্রিক দুর্নীতি আগের বছরগুলোর চেয়ে আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছে। আমার মনে আছে, এই তো কয়েক বছর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে এভাবে বলেছিলেন, ‘আজ বাংলাদেশের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র, গোটা প্রশাসন, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কর আদায়কারী সংস্থা, মন্ত্রণালয়, সংসদ সবাই দুর্নীতির মহাপঙ্কিলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘দেশের সার্কুলেটেড মানির ৮০%-ই ব্ল্যাক মানি, কালো টাকা। অবৈধ ও অনৈতিকভাবে উপার্জিত। অর্থমন্ত্রী একজন সৎ-নীতিবান ব্যক্তি বলেই আমরা সবাই জানি। সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে এ বক্তব্য গোটা দেশকে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে। দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র সবাইকে আতঙ্কিত করে। বিস্ময়করভাবে সরকার সম্পূর্ণ ড্যামকেয়ার। সরকার নির্লিপ্ত ও উদাসীন। আর হয় তো সেজন্যই দুর্নীতিকারীরা বুক উঁচিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে দুর্নীতি করে যায়। কোনো প্রতিরোধ হয় না, জবাবদিহি করতে হয় না। পবিত্র জাতীয় সংসদেও কালো টাকাকে সাদা করার বৈধতা দেওয়া হয়, দুর্নীতির অবৈধ অর্থ জায়েজ করা হয়। এবারের বাজেটেও চার দশকের সংসদের গৌরবোজ্জ্বল (?) ধারাবাহিকতায় তেমনই করা হয়েছে। এর ব্যত্যয় হয়নি। ব্যতিক্রম হিসেবেও নয়। Even not for an exception। ধন্য জাতি। ধন্য জাতির মহাগর্বিত মহাপবিত্র চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ, National Parliament.

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ধনাঢ্য ব্যক্তি যারা সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা দুর্বৃত্ত, দুর্বৃত্ত পরিবৃত্ত, দুর্বৃত্ত লালনকারী, দুর্বৃত্ত পোষণকারী। তাদের পাহাড়সমান অবৈধ সম্পদ আহরণে এ দুর্বৃত্তরাই জোগানদাতা, রক্ষাকারী। এরাই মৌচাকের নিবেদিত কর্মী, মৌমাছি। বাংলাদেশের মনুষ্যসমাজ আজ মৌমাছির সমাজে পরিণত হতে চলেছে। মক্ষীরানীর জন্যই জীবন উৎসর্গিত হয়েছে এই কর্মী মৌমাছি বাহিনীর। আর এরা সবাই হুলে শান দেয়, হুল ফোটায়। এরা দেশের সব ফুলের মধু শুষে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন আর ফুল ফোটে না, গাছ ফল দেয় না। নিষ্ফলা হতে চলেছে। বন্ধ্যা আজ গোটা বাংলাদেশ।

আমি দুর্বৃত্তায়নের কথা বলছিলাম। দুর্নীতির কথা বলছিলাম। রাজনীতির অবক্ষয়ের, নীতিহীনতার কথা বলছিলাম। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও নষ্ট রাজনীতি সমার্থক শব্দ, অভিন্ন-অবিচ্ছেদ্য। সবাই সবার পরিপূরক। সমকালীন রাজনীতিতে এমন কেউ কি আছেন যিনি ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে শপথ করে বলতে পারবেন তিনি দুর্নীতি করেন না, তিনি দুর্বৃত্ত পোষেন না।

রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্ত অবগাহিত বাংলাদেশ। ৩০ লাখ শহীদের অস্থিস্তূপের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এ জাতি। প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চলেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসেনি। মানুষের শোষণ-বঞ্চনার শেষ হয়নি। গণতন্ত্র আসেনি। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিস্তার থেমে থাকেনি। মানবতার পদে পদে অপমান, মূল্যবোধের নিরবচ্ছিন্ন অবক্ষয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের শঠতা, প্রতারণা, নীতিহীনতা, সহিংসতা ও উদগ্র লালসা মানুষকে হতাশ করে চলেছে, বিভ্রান্ত করছে। মানুষ আস্থা হারাচ্ছে সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি। আস্থা হারাচ্ছে নিজেরও ওপর। আশাহত মানুষ বার বার নতুন করে আশায় বাসা বাঁধে কিন্তু বার বার তার ক্ষুদ্র নীড় ভেঙে যায়। মনে হয় আশা যেন মিছে শুধু ছলনা।

বাংলাদেশে ভোগবাদী, ভোগবিলাসী জীবনযাপনের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা চলছে। এ প্রবণতা আমাদের সমাজে শিকড় গেড়েছে এবং তা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। সমাজের ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে অসৎ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদে শোষণ করে, বঞ্চনা করে, প্রতারণা করে, কর ফাঁকি দিয়ে। আর এখানে দরিদ্রদের অবস্থা নিষ্করুণ, দিনে দিনে তারা আরও দরিদ্র হচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের এ দূরত্ব এক গভীর সামাজিক বৈষম্য আকারে বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে। সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য শুনলাম। তিনি বাংলাদেশের অর্ধেক সম্পদ মাত্র ৬৩ জনের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার কথা বলেছেন। বাকি অর্ধেক, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাতে ক্ষুদ্র হয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, ভগ্ন ভগ্নাংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আরও ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে গিয়ে এ দেশের ধনী লোকেরা ঘুষ, দুর্নীতি, কর ফাঁকি, মাদক চোরাচালান, মানব পাচার, নারী ও শিশুদের পাচারসহ হেন অন্যায়, অবৈধ পন্থা নেই যা তারা অবলম্বন করছে না।

২০১৬ সালের এখন বিদায়বেলা। সাঁঝ আকাশে গোধূলিলগ্ন। এ সালের শেষ রবি অস্তাচলে চলেছে। কামনা করি সেই সঙ্গে নিয়ে যাক অতীতের সব গ্লানি, ধূলি-ধূসরিত সব আবর্জনা, ক্লেদ ও ক্লান্তি। এ দুর্ভাগা দেশ থেকে অপসৃত হোক দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, জঙ্গিবাদসহ জাতির বুকে চেপে থাকা জগদ্দল পাথর। জাতি নতুন উদ্যমে নতুন প্রত্যয়ে বলীয়ান হোক, মুক্তি পাক। চাই সবার সমন্বিত শক্তি, ইস্পাতকঠিন সংকল্প। ‘যে দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয় সে পারে সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে। পারে সে মরা গাছে ফুল ফোটাতে। পারে সে মরা গাঙে জোয়ার আনতে।’ চাই এ বাণীচিরন্তনীর ওপর অগাধ বিশ্বাস। সাহসী বাংলার দুরন্ত কবি সুকান্তের কবিতার দুটি লাইন—

‘বন্ধু তোমার ছাড় উদ্বেগ, সুতীক্ষ কর চিত্ত।

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’

আজ দ্রৌপদীর নয়, দুর্যোধনের শত ভ্রাতা বস্ত্রহরণ করতে চলেছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ বিবস্ত্র হতে চলেছে। তার সম্ভ্রম, মানমর্যাদা সব ধুলায় লুণ্ঠিত হতে চলেছে। মহাভারতের দ্রৌপদী সে তো আজ বাংলাদেশেরই রূপক রূপ। আজ কুরুক্ষেত্রের চূড়ান্ত যুদ্ধে দুর্যোধন ও তার শত ভ্রাতাকে ধ্বংস করার বজ্রকঠিন সংকল্প নিয়ে অর্জুনকে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে পঞ্চপাণ্ডবকে। দুর্বৃত্ত দুর্যোধনের পরাজয় সুনিশ্চিত, অবশ্যম্ভাবী। ২০১৭ সাল সমাগত। নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়কে স্বাগত জানাই। কামনা করি এই নতুন বছরে আবির্ভাব হোক এক জ্যোতির্ময়ী, মহাজ্ঞানী, মহাজন, মহাকল্যাণময়, মহাকল্যাণকর এক মহামানবের। এ দুর্ভাগা দেশ থেকে সব অপমানের গ্লানি অপসৃত হোক। সব মানুষ দলমত-ধর্মবর্ণনির্বিশেষে একত্রে মিলিত হোক। সব আত্মা এক হোক। নতুন উদ্যমে, নতুন প্রত্যয়ে এই দুর্ভাগা দেশ থেকে অপসৃত হোক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তের জগদ্দল পাথর।

     লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

সর্বশেষ খবর