বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মহাসড়কে মৃত্যুর মহামারী ও মন্ত্রীর কারণ খোঁজা

রোবায়েত ফেরদৌস

মহাসড়কে মৃত্যুর মহামারী ও মন্ত্রীর কারণ খোঁজা

গেল ৭ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ পর্যন্ত নয় দিনে সারা দেশে ৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৩৪৬ জন। (প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)। ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে ১৭ জনের বেশি মানুষ সড়কে লাশ হচ্ছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘মহাসড়কে দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ মাননীয় মন্ত্রী এ জন্য নিশ্চয়ই একটি তদন্ত কমিটি করবেন, কমিটি অনেক কষ্ট করে ছয় মাসের মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট দেবে এবং ওই রিপোর্টের তথ্য যথারীতি কোনো দিন কারও কাছে প্রকাশ পাবে না, এই ছয় মাসে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হবে আরও কয়েকশ মানুষ! মন্ত্রী বাহাদুরকে তাই বলি, কারণ খুঁজে সময় নষ্ট না করে প্রতিকার করুন। প্রতিদিন সড়কে মানুষ খুন করা হচ্ছে, নিহত হচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু; হাসপাতালে অঝোরে কাঁদছে দেড় বছরের শিশু আলিফ— মন্ত্রী মহোদয় কান নয়, হৃদয় পেতে তার কান্না শুনুন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণ পেয়ে যাবেন। তদন্ত কমিটিকে আর ‘নতুন করে চাকা আবিষ্কার’ করতে হবে না। ‘ক্যামেল ইজ এ হর্স, ডিজাইন্ড বাই এ কমিটি’— এ প্রবাদের মানে বাংলাদেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে জানে। মূল কারণ জানতে চান? তা তো দিবালোকের মতো— দুর্ঘটনার মূল কারণ অতিরিক্ত গতি। এ তো সবার জানা যে, চালক-মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার লোভ বেপরোয়াভাবে যান চলাচলের আদি উৎস। আমাদের দেশে সড়কের যে সক্ষমতা তাতে ৬০-৭০ কিলোমিটারের বেশি গতি তোলার সুযোগ নেই; কিন্তু চালকরা ১০০-১২০ পর্যন্ত গতিতে যাত্রীবাহী বাস চালাচ্ছেন। এটা ধরার যন্ত্র নেই, দোষী ব্যক্তির শাস্তি নেই। (পূর্বোক্ত)।  কারণ সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোনো শাসন নেই, সুশাসন তো দূর অস্ত। কারণ খুঁজতে যাবেন না প্লিজ। কারণ সবাই জানে, দরকার করণীয়। কয়েকটি সড়কের বাঁক সোজা করা আর কিছু সড়কের সম্প্রসারণ ছাড়া গতিনিয়ন্ত্রণ ও চালকদের বেপরোয়া মনোভাব রুখতে সরকার তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। কী হবে কারণ খুঁজে? সমাধান করুন। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত বেশি— প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫ দশমিক ৫। পশ্চিমা দেশে এ হার মাত্র ৩। তার মানে সড়ক দুর্ঘটনা কোনো অদৃষ্ট নয়, ভাগ্যের লিখন নয়— চাইলে, উদ্যোগ নিলে, সড়কে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যায়। সিঙ্গাপুরে সড়ক দুর্ঘটনার হার খুবই কম। তাদের লক্ষ্য এ হার শূন্যে নামিয়ে আনা, অর্থাৎ বছরে একটিও দুর্ঘটনা না ঘটানো এবং তারা মনে করে এটি করা সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনা কোনো কপালের লিখন নয়, কার্যকর সড়ক নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণ করলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু আমরা কি তা করছি? পাঠক ভাবুন, সিঙ্গাপুরের টার্গেট সড়কে মৃত্যুর হার শূন্যে নামিয়ে আনা আর আমাদের টার্গেট সড়ক দুর্ঘটনার কারণ খোঁজা। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ— সবাই ধরে নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা মানুষের নিত্যদিনের নিয়তি, প্রাণহানি আর অঙ্গহানি যেন অপ্রতিকার্য এক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ২০-২১ হাজার মানুষ মারা যায়। আগের দিনে কলেরা, টাইফয়েড আর ম্যালেরিয়ায় প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ মারা যেত, ওইসব মৃত্যুকে তখন চিহ্নিত করা হতো ‘মহামারী’ হিসেবে; তবে কি আমরা একে নয়া মহামারী বলব? বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতি জিডিপির ১.৬%। সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব দেশ সাফল্য দেখিয়েছে তার মূলে রয়েছে এ-সংক্রান্ত আইন জোরদার ও বাস্তবায়ন করা, সড়ক ও যানবাহন আরও নিরাপদ করা। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় আফ্রিকায় আর সবচেয়ে কম ইউরোপে। বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ৯০% ঘটে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে। সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহামারী রূপ নিয়েছে, এটি যেমন সত্য, বিপরীতে চেষ্টা থাকলে সড়ক দুর্ঘটনাকে যে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাও সমান সত্য। গবেষণা বলছে (হোসেন জিল্লুর, ২০১৫), বিশ্বের ৮৮টি দেশ দুর্ঘটনার হার কমাতে সক্ষম হয়েছে এবং ৮৭টি দেশে তা বেড়েছে। সড়ক পরিবহন বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও দ্রুত বিকাশমান খাত; কিন্তু সড়ক পরিবহন খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে সময়োপযোগী ও কার্যকর বিধি-বিধান ও উদ্যোগ গ্রহণ করার দরকার ছিল বাংলাদেশে সেই সক্ষমতায় বিরাট ঘাটতি রয়েছে এবং এই সামর্থ্যের অভাবই এ খাতের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয়, সড়ক পরিবহন নিয়ে নতুন পলিসি, আইন, বিধি-বিধান প্রণীত হয় ঠিকই কিন্তু প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবহন যাত্রীদের মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না, যাত্রীদের সেবার মানোন্নয়নের বিষয়টি এবং তাদের কণ্ঠস্বর সব সময়ই উপেক্ষিত রয়ে যায়।

কেন দুর্ঘটনা ঘটে?

দুর্ঘটনার কারণকে তিন ভাগে দেখানো যেতে পারে। এক. বিধি-বিধান ও পরিচালনার দুর্বলতা : এর মধ্যে আছে ট্রাফিক আইনের যথার্থ প্রয়োগ না হওয়া, দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতির কারণে অযোগ্য গাড়ি ও অদক্ষ চালকের লাইসেন্সপ্রাপ্তি, সড়কে বিভিন্ন গতির গাড়ি/বাহন যুগপৎ চলাচল, দুর্ঘটনা বা অনিয়মের ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, যুগোপযোগী আইন না থাকা, বিদ্যমান আইনে প্রতিকার-প্রতিবিধান-ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না থাকা, স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে নিরাপদ সড়কের চাহিদাকে সমন্বয় করতে না পারা ইত্যাদি। দুই. কারিগরি ত্রুটি : এর ভিতরে রয়েছে সড়ক পরিকল্পনা ও নির্মাণে সমস্যা, সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ ব্ল্যাকস্পট বা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক থাকা, রোড সিগন্যাল-ডিভাইডার-স্পিডব্রেকার-অ্যাকসেস রোডের সমস্যা। তিন. মানবীয় দুর্বলতা : বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকের ওপর শারীরিক-মানসিক-আর্থিক চাপ, নিরাপদ সড়ক সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, পথচারীদের ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল ও আচরণ, সড়কের পাশে দোকান-বাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড চালানো ইত্যাদি।

দুর্ঘটনা রোধে করণীয় কী

সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব অমূল্য জীবনের হানি হয়, তা কোনো দিন ফিরে পাওয়ার নয়। তাই এটি কমিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ দ্রুত নেওয়া দরকার তা হলো : সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইন ও শাস্তির বিধান রাখা; কারণ দোষী চালকদের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ থাকলে চালকরা সাবধানে গাড়ি চালাতে বাধ্য। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মামলা দায়েরের বিধান রাখতে হবে; তা না হলে চালকরা সচেতন হবেন না এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বিআরটিএ’র একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার বিনিময়ে অবৈধ লাইসেন্স দেন, এটি বন্ধ করতে হবে। ১৯৮৩ সালের পুরনো মোটরযান আইনকে আধুনিক, কার্যকর ও জনবান্ধব করতে হবে। দোষী চালকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও শ্রমিকনেতাদের প্রত্যক্ষ মদদে তাদের ছাড়িয়ে আনতে পরিবহন সেক্টর একরকমের জিম্মি করে রাখা হয়। এ জিম্মিদশা থেকে পরিবহন খাতকে মুক্ত করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনেক সময় উদাসীন হতে দেখা যায়; তাদের আরও ‘অ্যাকটিভ’ করতে হবে। রোড অ্যাক্সিডেন্ট কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং বিআরটিএ’র প্রতিরোধ সেলগুলোকে কার্যকর করতে হবে। সারা দেশের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বা কেন্দ্রের কাজ দ্রুত শুরু করে তা শেষ করতে হবে। কারণ, যত দেরিতে এই বাঁকের কাজ শেষ হবে মৃত্যুর মিছিল ততই লম্বা হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রয়োজনে বাঁকগুলো তুলে দিতে হবে। সড়ক-মহাসড়কে নকশাসংক্রান্ত ত্রুটি দ্রুত সারাতে হবে। সারা দেশে গাড়ির ড্রাইভারদের ব্যবহারিক, তাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং কেউ এটি চালালে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তত্ক্ষণাৎ জরিমানা ও শাস্তি প্রদান করতে হবে। সড়কের পাশে কিংবা সড়কের মধ্যে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাজার, দোকানপাট, প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের সাইনবোর্ডসর্বস্ব অফিস তুলে দিতে হবে। ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার রোধে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করতে হবে। নিষিদ্ধের পরও মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও নসিমন-করিমনের মতো বিপজ্জনক যানবাহন এখনো চলছে; সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এ ধরনের যানবাহন বন্ধ করা খুব জরুরি। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে ভ্রাম্যমাণ পুলিশের টহল বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের প্রো-অ্যাকটিভ করতে হবে। বিআরটিএ’র জনবল বাড়াতে হবে, প্রতিষ্ঠানটিকে আধুনিক, যুগোপযোগী ও কার্যকর করতে হবে। পুরনো, লক্কড়-ঝক্কড় ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে নিতে হবে। ফিটনেস ছাড়া কোনো গাড়ি পাওয়া গেলে জরিমানাসহ কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ কমাতে সড়কে প্রয়োজনমতো ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্ট’ বা ‘গণপরিবহন’ নামাতে হবে, প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রাইভেট কারে গ্যাস-সুবিধা বাতিল করতে হবে। সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কগুলোয় অত্যন্ত ধীরগতিতে ‘চার লেনে’র কাজ চলছে, এতে বাড়ছে যানজট, ঘটছে দুর্ঘটনা; তাই দ্রুতগতিতে চার লেনের কাজ শেষ করতে হবে। মাননীয় মন্ত্রী! বেলা বয়ে যায়, আর সময় নষ্ট করবেন না। কারণ এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। প্রতিদিনই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে হচ্ছে দীর্ঘতর। বহু মানুষ দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে চিরদিনের জন্য ঘরে বসে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশে বোধ করি এমন কোনো ঘর বা ফ্যামিলি পাওয়া যাবে না, যেখানে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাননি অথবা আহত হননি। এখনই এর রাশ টেনে ধরতে হবে, থামাতে হবে শবযাত্রার মিছিল; নিতে হবে দ্রুত রাজনৈতিক ও কঠোর আইনি পদক্ষেপ। তবেই হয়তো ঈদ, কোরবানি, পহেলা বৈশাখ, বিজু, সাংগ্রাই, পূজা-পার্বণের মতো এ দেশের চিরন্তন ও শাশ্বত উৎসবে নাড়ির টানে যাত্রা আর ফিরতিকালে কেউ ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়বে না, বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার সময় লাশ হয়ে ফিরবে না! দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসুক, প্রতিটি উৎসব হোক উৎকণ্ঠাহীন, নিরাপদ, বর্ণিল, আনন্দময় ও হৃদয় নিংড়ানো।

[তথ্যসূত্র : ক. হোসেন জিল্লুর রহমান, ‘সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আইনগত উদ্যোগ’, পিপিআরসি, ঢাকা]

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

সর্বশেষ খবর