রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিএনপির পায়ে এখন মুসলিম লীগের জুতা

কাজী সিরাজ

বিএনপির পায়ে এখন মুসলিম লীগের জুতা

সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে বার বার মার খাচ্ছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপি। তারা না আছে আন্দোলনে, না আছে সংগঠনে। কিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিএনপি সম্পর্কে একটি যথার্থ উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘আমি জীবনে অনেক ব্যর্থ সরকার দেখেছি, কিন্তু বিএনপির মতো এমন ব্যর্থ বিরোধী দল দেখিনি।’  এরশাদের স্বৈরশাসনামলেও দলটি বিরোধী দলে ছিল, সংসদেও ছিল না। কিন্তু তখন বিএনপি যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে এবং বেগম খালেদা জিয়া যে দৃঢ়তা দেখিয়ে আপসহীন নেত্রীর খেতাব (খেতাবটি তাকে চট্টগ্রামে দিয়েছিলেন এখন বিএনপিতে সম্মান কেড়ে নেওয়া, অনেকটা নেতা-এ খামাখা আবদুল্লাহ-আল নোমান। দৈনিক দেশ পত্রিকায় তা প্রথম ছাপা হয়) পেয়েছিলেন এখন তা দূর অতীতের বিষয়। বিএনপি তখন শহীদ জিয়ার ঘোষিত নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল ছিল। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা পেতে জামায়াতে ইসলামীর শরণাপন্ন হতে হয়নি। সরকার গঠনে জামায়াত বিএনপিকে সংরক্ষিত দুটি মহিলা আসনের বিনিময়ে সমর্থন দিয়েছিল বটে, কিন্তু তাদের কারও বাড়িতে-গাড়িতে আমাদের জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয়নি। দলও তখন পরিচালিত হতো যৌথ নেতৃত্বে, প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে। এটা স্পষ্টই বোঝা যেত। জিয়া পরিবারের ধুয়া তুলে পরিবারের অন্য কারও অযাচিত হস্তক্ষেপ ছিল না দলে। সেসব এখন কল্পনার বিষয়।

একটি রাজনৈতিক দলে দুটি বড় ভ্রান্তির সংমিশ্রণ ঘটলে সে দল পথ হারায়, ভুল পথে চলে একসময় হারিয়েও যায় নিকষ কালো অন্ধকারে। আমাদের ভূখণ্ডেও এর প্রমাণ আছে। বিএনপির জন্য কাল হয়েছে এই ভ্রান্তিবিলাস। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশ ও কালের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল— বিএনপি নামক দলটি। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদের অবশেষ, বিশেষ করে আধিপত্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীদের ভরসাস্থল, মিলনকেন্দ্র ছিল এই দল। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কালোত্তীর্ণ দর্শনের আলোয় উদ্ভাসিত বিএনপি অতি অল্প সময়েই দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চিত্ত জয় করেছিল। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি। জিয়া বলেছিলেন একমাত্র ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ একটি দুর্বল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তা গঠনে ভাষা একটি শক্তিশালী উপাদান বটে, তবে একমাত্র উপাদান হতে পারে না। জাতীয়তা গঠনে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতার বিকাশধারা, সংগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা, জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্যের ধর্মবিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভাষা বা শুধু ধর্ম-বিশ্বাসের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতিতে বিজ্ঞানসম্মত হলে আরবি ভাষাভাষী বা ইংরেজি ভাষাভাষী সব দেশ মিলে একটি দেশ হতো, কিংবা ইসলাম ধর্মাবলম্বী বা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী বা ইহুদিরা একটিমাত্র রাষ্ট্রই গঠন করত। জিয়াউর রহমানের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট ও দৃঢ়। তার বক্তব্য, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সব নাগরিক ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নৃ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই বাংলাদেশি। আমাদের ভূখণ্ডের বাইরেও বিপুল সংখ্যক (প্রায় আমাদের সমসংখ্যক) বাঙালি আছে যারা অন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। আমাদের জাতীয়তাবাদ ‘বাঙালি’ হলে ‘ওই বাঙালিদের’ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? আমরা কি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেতে চাই? সম্প্রতি ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সে রাজ্যের বিধানসভায়। এতদিন তারা জাতীয়তার পরিচয় দিত ভারতীয়। এখন রাজ্যের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারা ‘ভারতীয় বাঙালি’ জাতীয়তার দাবি তুলতে পারে। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এ বিশ্বাসীদের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সিদ্ধান্ত অবশ্যই একটি সংকট সৃষ্টি করবে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জিয়া ৩৮ বছর আগেই এর মীমাংসা করে দিয়ে গেছেন। তিনি এ-ও ঘোষণা করেছিলেন, দলটি হবে জনগণের দল। এই বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত অবস্থান থেকে বিএনপি এখন বিচ্যুত, স্খলিত। দলটি এখন আর জনগণের দল নেই, ঘোষিত আদর্শে বিশ্বাসীদের ‘যৌথ মালিকানাধীন’ জনগণের সম্পত্তি নয়, এটি এখন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে বলেই প্রতিভাত হয়। দলে প্রকৃত ও ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদদের কোনো মূল্য নেই। অলঙ্কার হিসেবে কিছু নাম আছে বিভিন্ন কমিটিতে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই বলেই বোঝা যায়। সিদ্ধান্ত নেন দুজন— বেগম খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমান। তারা নবীন-প্রবীণ যে রাজনীতিবিদরা আছেন তাদের ওপর নির্ভর করেন না, হয়তো বিশ্বাসও করেন না; দল চালান কর্মচারী দিয়ে। বিএনপিতে প্রবীণ ও পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ যেমন এখনো অনেকে আছেন— যাদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সংগঠক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী; একইভাবে শহীদ জিয়ার আমল থেকে ছাত্রদলের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে অনেক নবীন, দক্ষ ও মেধাবী রাজনীতিক। কারও কারও বয়স পঞ্চাশোত্তীর্ণ। কই, কোথায় তাদের উজ্জ্বল অবস্থান আছে দলে? ‘নব্বই’র গণঅভ্যুত্থান এবং বেগম খালেদা জিয়ার বিস্ময়কর উত্থানে বড় অবদান ছাত্রদলের। কেন্দ্রে, জেলায়, থানায় সেই সময়কার ছাত্রদল নেতা-নেত্রীরা এখন কে কোথায় আছেন, খুঁজেই পাওয়া যায় না। তারা প্রায় হারিয়েই গেছেন। অনেকের রাজনীতি করার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বোধহয় ভয় পান। তারা আতঙ্কিত এই ভেবে যে, এই শিক্ষিত, মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিরা দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেললে ‘ফ্যামিলি ডাইনেস্টি’ অটুট রাখা যাবে না। তাই জিয়ার স্বপ্নের জনগণের দল এখন হয়ে পড়েছে পরিবারের মালিকানাধীন দল। পরিবারের লোকেরা দল করতে পারবেন না সে কথা কেউ বলেন না। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের অবশ্যই দলের রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করতে হবে, পারিবারিক বা রক্তের উত্তরাধিকারের দাবিতে দলের মূল নেতৃত্ব দখল করা যাবে না। কখনো কখনো বিপর্যয়ের মুখে দলের ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখার স্বার্থে কোনো রাজনৈতিক পরিবারের প্রতিনিধিকে দলই সামনে নিয়ে আসে (আগে থেকে নির্ধারিত সাকসেসর হিসেবে নয়)। এই উপমহাদেশে তেমন নজির তো আছেই এবং তারা একটা পর্যায়ে সফলও হয়েছেন। আমাদের দেশের কথাই যদি ধরি তো বলতে হবে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দল দুটির পূর্ব-নির্ধারিত ‘নেতা’ ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান তাদের নিজ নিজ ‘সাকসেসর’ নিয়োগ দিয়ে যাননি। দল ও সময়ের বাস্তব চাহিদাই তাদের বর্তমান অবস্থানে এনে দিয়েছে। আবার উল্টা চিত্রও আছে।

সর্বভারতীয় কংগ্রেসকে বলা হতো ভারতীয় ঐক্যের প্রতীক। ভারতের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে দলের প্রবীণ, পোড়খাওয়া ঝানু ঝানু রাজনীতিবিদকে ডিঙিয়ে রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সুপারইম্পোজ করে সোনিয়া গান্ধী তার ‘সাকসেসর’ বানিয়ে বড় ভুল করেছেন, দলের সর্বনাশ করেছেন। এখনো কংগ্রেসই ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক দল যার সর্বভারতীয় ভিত্তি আছে, সব রাজ্যে সংগঠন আছে— যা আর কোনো দলের নেই। অথচ সে দলটি ভারতের লোকসভায় এবার সাংবিধানিক বিরোধী দলের মর্যাদাও পায়নি। সে দেশের অনেক সমালোচক বলেন, প্রবীণ রাজনীতিবিদদের রাহুল গান্ধীর পায়ের নিচে ফেলে দেওয়ার কুফল ভোগ করছে ভারতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেসের ভরাডুবিতে সে দেশের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন তারা। বাংলাদেশে বিএনপিও তেমন ভুল করেছে বলে কঠোর সমালোচনা আছে। বলা হয়ে থাকে অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে তারেক রহমানকে দলীয় নেতৃত্বে সুপারইম্পোজ করা হয়েছে, বেগম জিয়ার জীবদ্দশায় তাকে ‘সাকসেসর’ (খালেদা জিয়ার) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে যা হলো, দলের যারা তারেক রহমানকে জিয়া-খালেদা জিয়ার সন্তান হিসেবে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন, তাদের সেই ভালোবাসা আর নিখাদ থাকল না। অনেকে অপমান বোধ করেছেন, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সময়ে তারেকই হতে পারতেন দলের ‘ন্যাচারাল লিডার’— ঠিক তার মায়ের মতো। তার সময়ে প্রবীণরাই তাকে কোলে করে এনে বসাত নেতৃত্বের আসনে। বাড়াবাড়ি করায় এখন না লাভবান হয়েছে বিএনপি, না লাভবান হয়েছেন তারেক রহমান।

রাজনৈতিক আদর্শিক জায়গা থেকেও সরে এসেছে বিএনপি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে কালোত্তীর্ণ দর্শনের সৌন্দর্য-সৌরভ ছিল বিএনপিতে, সে অবস্থান আর অটুট নেই। যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে শক্তি জোগায়, তার মধ্যে একটিকে আঁকড়ে ধরেছে বর্তমান বিএনপি— সেটি ধর্মীয় মূল্যবোধ, ধর্মাচার, তাও আবার ইসলামী মূল্যবোধ ও মুসলিম ধর্মাচার। এটি বিপজ্জনক ডানপন্থি মৌলবাদী চিন্তা— যার সঙ্গে সাযুজ্য আছে জামায়াতে ইসলামীর চিন্তা ও দর্শনের। মুসলিম লীগও ব্রডলি একই লাইনের অনুসারী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, একাত্তরকে ‘বেসলাইন’ ধরে সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন বিএনপিতে অনেকটাই অবহেলিত। এত কঠোর সমালোচনার পরও বিএনপি যে তার এই রাজনৈতিক ও আদর্শগত অবস্থান পরিবর্তন করবে না তার প্রমাণ সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে টার্গেট কিলিং ও জঙ্গি হামলা, বিশেষ করে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি তাণ্ডব ও শোলাকিয়া ঈদগাহ গেটে জঙ্গি হামলার পর দেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদবিরোধী ঐক্য গড়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বিএনপি। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও এ আহ্বান জানিয়েছিলেন। সরকারপ্রধান এ ব্যাপারে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তা অভিপ্রেত ছিল না। দাবিটা জাতীয় দাবি এবং একই পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান। বলা হয়েছিল, সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ার ব্যাপারে সম্মত না হলে সরকার ও সরকারের জোটের বাইরের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব বিরোধী দলকে নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে একটি জঙ্গিবাদ-মৌলবাদবিরোধী ঐক্যমোর্চা গড়া হবে। বিস্তারিত আলোচনার খুব একটা প্রয়োজন নেই। বিসমিল্লাহতেই তা বিনাশ করে দিয়েছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না। তার একটা বক্তব্য প্রায় সবারই জানা যে, ‘জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমি বেহেশতে যেতেও রাজি নই।’ বেগম জিয়া কি তা জানেন না? আলবৎ জানেন। ‘চা-চক্র’ প্রক্রিয়া শুরু করার আগে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, জামায়াতকে বাইরে রেখেই গড়া হবে জঙ্গিবিরোধী ঐক্যমোর্চা। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বেগম জিয়ার সঙ্গে আলোচনার সূত্র ধরেই এই ‘ধারণাটা’ কনফার্ম করেছিলেন। বিএনপিপন্থি অপর এক বুদ্ধিজীবী ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীও এক খোলা চিঠিতে বেগম জিয়ার প্রতি জামায়াতকে বাদ দিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানান। কিন্তু মনে হলো এসব বক্তব্যে ‘ভিমরুলের চাকে ঢিল’ পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া এলো বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষ থেকে (কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন)। তিনি বলে দিলেন, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত। স্পষ্ট হয়ে গেল বিএনপির অবস্থান। বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়বে না। ফল দাঁড়াল এই যে, সিপিবি, বাসদ মুখের ওপর না করে দিল এই বলে যে, বিএনপির সঙ্গে কোনো ঐক্যমোর্চায় তারা যাবে না। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রবও উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নতুন জোট— যাতে যোগ দিয়েছে বি. চৌধুরীর বিকল্প ধারা ও মাহমুদুর রহমান মান্নার ঐক্য প্রক্রিয়া। আ স ম রবও একটি মোর্চা করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। বিএনপির জন্য এ এক বড় লজ্জার বিষয়। অবশ্য তারা লজ্জা পাচ্ছেন কিনা কে জানে? সরকার তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব বিরোধী দলও প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের। বিএনপি এখন ‘পথহারা পাখি’। জামায়াত ছাড়া কেউ নেই তাদের সঙ্গে। নতুন নেতৃত্বের জামায়াত তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যদি ‘রণকৌশল’ পরিবর্তন করে, তখন বিএনপির সঙ্গে তাদের বর্তমান মৈত্রীর বন্ধন কতটা অটুট থাকে তা-ও দেখার বিষয়। বিএনপির কাছ থেকে যা নেওয়ার তা তারা নিয়ে ফেলেছে। তাদের পক্ষে যারা কথা বলেন, তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এখন জামায়াতকে দেওয়ার আর কিছু অবশিষ্ট নেই বিএনপির— নিরাপদ আশ্রয় বা ক্ষমতার শেয়ার, কোনোটাই না। তারা অন্য কোনো স্থানে অন্য কারও কাছে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আশ্রয়ের সন্ধান করতে পারে। এমনও হতে পারে অন্য কারও সঙ্গে একটা গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে তারা আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতেও হয়তো তাদের আপত্তি থাকবে না। বিএনপি তখন ভালোই একটা আছাড় খাবে। তারাও হয় বর্তমান সরকারের ঘোষিত সময়ে তাদের অধীনেই নির্বাচনে যাবে, নতুবা এককভাবে নির্বাচন বর্জন করবে। আগামী নির্বাচনও বর্জন করলে বিএনপির দশা তখন কী হবে সে হিসাব মেলানোর জন্য ‘ক্যালকুলেটরের’ দরকার নেই।

জনগণের প্রত্যাশা ও সময়ের চাহিদা পূরণ করতে চাইলে বিএনপি ‘মুসলিম লীগের যে জুতা’ পরে হাঁটছে সে জুতা খুলে ফেলতে হবে। ‘রাজাকারের পোনা’, ‘শান্তি কমিটির নেতা-কর্তার পোনা’ খুঁজে খুঁজে দলের নেতা বানানোর ভ্রান্ত চিন্তা পরিহার করতে হবে। উঁচু রুচির পরিচয় দিতে হবে। অতি সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিদল দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। এই ধরনের আলোচনার জন্য রাজনৈতিক বিবেচনায় দলের মধ্যে শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, তরিকুল ইসলাম, ড. মইন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর রায়, নজরুল ইসলাম খান, আবদুল্লাহ-আল নোমান এবং কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার বিবেচনায় ঝানু কূটনীতিক এনাম আহমদ চৌধুরী, রিয়াজ রহমানের মতো ব্যক্তি থাকতে দলের স্থায়ী কমিটিতে সদ্য ঢোকানো সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাবেক সচিব, তথ্য ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা সাবিহ উদ্দিন আহমদ কী করে ঢুকে গেলেন অনেক বিশ্লেষকের মতে তা বিস্ময়করই বটে! বিএনপির চিন্তা ও রুচিরই প্রতিফলন ঘটেছে এতে। বিএনপি এখন এই ‘স্ট্যান্ডার্ডই’ সর্বক্ষেত্রে বোধহয় ধরে রাখতে চায়। বিভিন্ন দল তাদের নেতৃত্বের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ সর্বদা বাড়াতে চায়, বিএনপি কেন তা কমাতে চায় বোঝা মুশকিল।  যে দুই ভ্রান্তির সংমিশ্রণে বিএনপির মতো একটি বৃহৎ ও জনপ্রিয় দল অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার মতো ‘খাবি খাচ্ছে’, সেখান থেকে স্যালভেজের একমাত্র পথ দলকে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দেওয়া, দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং শহীদ জিয়ার নির্দিষ্ট করে দেওয়া রাজনৈতিক লাইন আঁকড়ে ধরে একাত্তরের বেসলাইনে সৎ ও দৃঢ় অবস্থান নেওয়া।

     লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর