বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কষ্ট ভেঙে পথচলা

নঈম নিজাম

কষ্ট ভেঙে পথচলা

নঈম নিজাম

মানুষের একটা মাত্র জীবন। এই জীবনে কিছু মানুষ শুধু কষ্ট করে যায়। আর কিছু মানুষ ভোগ করে। কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন জয় করে, আবার কিছু মানুষ স্বপ্ন নষ্ট করে। এক জীবনে কত কাহিনী। পথচলায় স্বাভাবিকতার দেখা মেলে না সহজে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে বেঁচে থাকার মতো যন্ত্রণা আর কিছু নেই। প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর। মাঝে মাঝে আলোকিত আকাশ অন্ধকারকে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু অন্ধকারের দাপুটে রূপ অনেক বেশি। আলো ঝলমলে আকাশ মুহূর্তে হয়ে যায় অন্ধকার। এই অন্ধকারে আপন থাকে না। পর থাকে না। থাকে সব জটিলতা। জটিলতার রহস্য ভেদও আমরা করতে পারি না। বেঁচে থাকি ঘাত আর প্রতিঘাত নিয়ে। তাই হয়তো মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাই। হারিয়ে যাই সুরের ঝঙ্কারে, খোলা আকাশে বৃষ্টির ছোঁয়ায়, পাহাড়ে হেলান দিয়ে সমুদ্রের জলরাশিতে।

মানুষ যা ভাবে তা হয় না। আর হয় না বলেই কাঠিন্যকে মোকাবিলা করতে হয় প্রতিনিয়ত। অনেক সফল মানুষকে দেখেছি রাষ্ট্রক্ষমতার অসঙ্গতিগুলো নিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরাতে। এলোমেলো ভাবনাগুলো আসে নিঃসঙ্গতা থেকে। চারপাশে ব্যাপক পরিসর থাকলেও আমরা অনেক সময় বড় বেশি নিঃসঙ্গ। ব্রিটিশ শাসনকালে মহাত্মা গান্ধী মাঝে মাঝে মৌনতা পালন করতেন। টানা কয়েক দিন কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। মিথ আছে— নেহেরু, মাওলানা আজাদ, প্যাটেলসহ কংগ্রেস নেতাদের নানামুখী জটিল অবস্থা তৈরি হলে সবাই গিয়ে তার কাছে হাজির হতেন। তর্ক-বিতর্কে জড়াতেন। এই বাকবিতণ্ডা গান্ধী পছন্দ করতেন না। তাই পরিস্থিতি জটিল রূপ নিলে তিনি চলে যেতেন মৌনতা পালনে। দরজার বাইরে সাইনবোর্ড থাকত— আগামী সাত দিন মৌনতা চলবে। এ মৌন দিবস আমাদের দেশেও দরকার। তাহলে অনেক সমস্যা থাকত না। মাঝে মাঝে আমারও মনে হয়, দেশজুড়ে মাসে এক দিন মৌন দিবস থাকলে কেমন হয়! আমরা সবাই কাজ করব। কথা বলব না। খাবার নেব, শব্দ করব না। বাসে চড়ব আরেকজনের সঙ্গে বিবাদ করব না। লাইনে দাঁড়াব। জানি আমার এ বক্তব্য কারোরই ভালো লাগবে না। কারণ দেশজুড়ে এখন সবাই আমরা এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায়।

ঈদের সময় যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলাম। এত বড় একটা নির্বাচন হচ্ছে কোনো হৈচৈ নেই। ঝগড়া-বিবাদ নেই। ঝামেলা নেই। সবকিছু টেলিভিশনে। দুই প্রার্থী একজন আরেকজনকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। বিবৃতি দিচ্ছেন। জনগণ এতে জড়াচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত তাদের জীবনধারা নিয়ে। সপ্তাহ শেষের উৎসব ও হিসাব-নিকাশ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে বাঙালিপাড়া ছিল জমজমাট। পক্ষে-বিপক্ষে সমাবেশ নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের বিরোধ ছিল। বিদেশে রাজনৈতিক দলের সংগঠনের কী দরকার? একজন ভারতীয়কে প্রশ্ন করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রে বিজেপি, কংগ্রেসের কোনো কমিটি আছে কিনা? আমার এই ভারতীয় নাগরিকটি বিস্মিত হন। বললেন, বিদেশে বিজেপি, কংগ্রেসের কমিটির কাজ কী? তারা রাজনীতি করছে ভারতে। পৃথিবীর অন্য দেশে কোনো দলের শাখা নেই ভারতীয় দলগুলোর। পাকিস্তানের পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগের কোনো শাখা নেই ব্রিটেন, আমেরিকা অথবা সৌদি আরবে। তাদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই। তার মানে তারা কি তাদের দেশের নেতা-নেত্রীদের বিদেশে সম্মান জানায় না? অবশ্যই জানায়। দলমতনির্বিশেষে প্রবাসীদের নিয়ে একটি অ্যাসোসিয়েশন থাকে। সেই অ্যাসোসিয়েশন দূতাবাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নেতা-নেত্রীদের সম্মান করে।

এবার নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে অবস্থানকালে জঙ্গিবাদের একটি ঘটনা ঘটে। জড়িত ব্যক্তি আফগান-আমেরিকান মুসলমান। দুনিয়াজুড়ে ধর্মের নামে এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ হওয়াটা জরুরি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। অশান্তি সৃষ্টিকারীরা ইসলামের অনুসারী নয়। তারা সন্ত্রাসের অনুসারী। এখন বিশ্বজুড়ে আরেকটি নতুন ধর্মের জন্ম হয়েছে। এই ধর্মের নাম সন্ত্রাস ধর্ম। সত্যিকারের ইসলামে বিশ্বাসীরা নিরীহ মানুষকে বোমা মেরে হত্যা করতে পারে না। নিষ্ঠুরতায় জড়াতে পারে না। ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করা জঙ্গিরা ইসলামের শত্রু। তারা বিশ্ববিবেকে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগুলোকে আসুন বর্জন করি। তারা শুধু ইসলাম নয়, বাংলাদেশেরও বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িকতার ইমেজ নষ্ট করছে। আমাদের স্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ছোটবেলায় ঘুম ভাঙত মায়ের কোরআন তেলওয়াতের শব্দে। বাবার তাগাদা মসজিদে যাও ফজরের নামাজ পড়তে। এই সময় অনেক পাড়া-পড়শিকে পেতাম যাত্রাগান শুনেছে আশপাশের গ্রামে। ঘরে ফেরার পথে নামাজ পড়তে ঢুকেছে মসজিদে। আমরা হিন্দুদের পূজা দেখতে যেতাম। সন্ধ্যায় আজানের শব্দের সময় মন্দিরের ঘণ্টা শুনে কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়নি। যার ধর্ম তার কাছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কোনো দরকার নেই। আগে দরকার হৃদয়কে পরিষ্কার করা। আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ানো। দুস্থ-অসহায় মানুষকে সহায়তা করা। তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। ঝামেলা কমে যাবে সমাজ থেকে। যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দেয় তারাই ইসলামের শত্রু। ইসলাম মানবতার পক্ষে। আর সন্ত্রাসবাদ কখনই সমস্যার সমাধান করে না। সমস্যাকে আরও তীব্র করে। জঙ্গি দমনে পশ্চিমা নীতি নিয়েও আমার ভিন্নমত আছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন জীবিত থাকাকালে জঙ্গিবাদ বলে কিছু ছিল না। গাদ্দাফির লিবিয়াও তাই ছিল। সাদ্দামকে সরানো ছিল পশ্চিমাদের বড় ভুল। ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করতে সাদ্দামকে সরানো হয়। সাদ্দামহীন ইরাকে আজ জঙ্গি চাষ হচ্ছে। লিবিয়ায়ও তাই। সাদ্দাম জীবিত থাকাকালে জঙ্গি শব্দ ইরাকিরাও কোনো দিন শোনেনি।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে এক বাঙালি প্রশ্ন রেখেছিলেন আগামী কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ কেমন কমিটি দেবে? সৈয়দ আশরাফ না ওবায়দুল কাদের— কে হবেন দলের সাধারণ সম্পাদক। জবাবে বললাম, শেখ হাসিনা জানেন কী হবে এরপর। আর কারও পক্ষে কোনো কিছু বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগ প্রাচীন একটি দল। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝে আজকের অবস্থান। তবে আগামী কমিটি নির্বাচনমুখী হবে। এ কারণে অনেক হিসাব-নিকাশ বোঝা যাবে না। মিলবেও না। হয়তো আস্থায় রাখবেন কঠিন দুঃসময়ে ভূমিকা পালনকারী নেতাদের। যে নেতারা দায়িত্ব পেয়ে গত দুই কমিটিতে ভালো করতে পারেননি, এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন দলকে তাদের রাখতে হবে কেন? সময় ও সুযোগ বার বার আসে না। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কারা ব্যস্ত ছিলেন তারও হিসাব-নিকাশ দরকার। হাইব্রিড লিডারশিপ দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নেতা-কর্মীদের বিচ্ছিন্ন করেছে সংগঠন থেকে। অনেকে জামায়াতকে ঠাঁই দিয়েছেন  দলে। জামায়াতকে আওয়ামী লীগে ঠাঁই দেওয়ার কোনো দরকার নেই। এত আওয়ামী লীগ দিয়ে কী হবে? আজকাল আরেকটি বিষয় বিরক্ত করছে, তা হলো সবাই আওয়ামী লীগ হতে চায়। এরশাদ শাসনকালে এক কবি লিখেছিলেন, সব শালা কবি হতে চান। বাংলাদেশে সব ব্যাটা এখন আওয়ামী লীগ হতে চায়। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে যান দলীয় নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থেকে শুরু করে শিক্ষকরা এখন প্রতিযোগিতা করেন আওয়ামী লীগের মাঠের কর্মীদের সঙ্গে। আত্মমর্যাদার বাইরে চলে যাচ্ছেন পেশাজীবীরা। দলবাজির রোগে আক্রান্ত সব পেশার মানুষ। রাজনৈতিক কর্মীরা এখন পেশাজীবীদের দলবাজিতে বিরক্ত, হতাশ। কিছুদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আমার সামনে বললেন, চট্টগ্রামের একটি খালের উন্নয়ন না হওয়ার জন্য ড. ইউনূস দায়ী। আমি হতাশা নিয়ে তার দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, ইউনূস এত কথা না বলে খালটি কাটলেই পারতেন। ইউনূস সাহেব খাল না কাটার কারণে একটি জেলার সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলার চেষ্টা করলাম, খাল কাটার দায়িত্ব ড. ইউনূস নয়, সরকারের। ভিসি মহোদয় আমার কথা শুনে বিস্মিত হলেন। সমস্যা শুধু একজন শিক্ষকের নয়, আমরা সাংবাদিকরাও পিছিয়ে নেই। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সবাইকে আরও বেশি ছাড়িয়েছেন। সমাজে পদে পদে এক কঠিন অবস্থা। এ অবস্থা কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। রাষ্ট্রের জন্যও স্বস্তিকর নয়। আওয়ামী লীগ হওয়ার প্রতিযোগিতায় বিএনপিও পিছিয়ে নেই। বিএনপি নেতারা একজন আরেকজনকে বলেন সরকারের এজেন্ট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। শুনি বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে সরকারের সখ্য সবচেয়ে বেশি। সবকিছু অদ্ভুত।

দেশের সব মানুষের আওয়ামী লীগ হওয়ার দরকার নেই। আমাদের প্রয়োজন একটি স্বাভাবিক পরিবেশের। অর্থনীতি ভালো। ভাতের সমস্যা নেই। এখন দরকার আইনের শাসন। আইনের শাসন থাকলে অনেক কিছুর উত্তরণ ঘটবে। উন্নয়নের ধারা আরও বেগবান হবে। বিশ্বের বুকে মর্যাদায় আসীন হবে বাংলাদেশ।

 

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর