শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিএনপি পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেবে না বিলুপ্ত হবে?

মইনুল হোসেন

বিএনপি পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেবে না বিলুপ্ত হবে?

বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালনের যোগ্যতা বিএনপি যখন হারিয়ে ফেলেছে তখন বিরোধীদলীয় তকমা এঁটে অস্তিত্ব বহাল রাখার কোনো অর্থ হয় না। জনসাধারণের সাহায্যে আসে না এমন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে অবমাননা সহ্য করা আর পুলিশের পিটুনি হজম করার কোনো মানে হয় না। এর কারণ হচ্ছে বর্তমান আঙ্গিকের বিএনপি দলটিকে আওয়ামী লীগ সরকার মোটেই গুরুত্ব সহকারে তাদের বিকল্প হিসেবে নিচ্ছে না। এজন্য দরকার ছিল গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির আস্থা অর্জন করা। বিএনপির অসহায় রাজনীতি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার জন্য সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। অতীতে এ দলটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলার কাজ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারও একই কাজ করছে অধিকতর সংকল্প নিয়ে।

দেশে দায়িত্বশীল বিরোধী দল না থাকলে জনগণ সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ ভেঙে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত হওয়ার পরই জনগণ মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস পায়। আশা জাগানোর মতো বিরোধী দল না থাকার অর্থ লাগামহীন কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিস্তার ঘটা। বিএনপিকে দেখলে মনে হয় জনস্বার্থের ব্যাপারে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। অনেকে তাই ধারণা করেন বিএনপি নেতারা রাজনীতিকে নিয়েছেন শখের বিষয় হিসেবে, তাই জনগণের কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে তাদের কোনো দৃঢ় অঙ্গীকার নেই। এ জন্যই নতুন বাস্তবতার তাগিদে নেতৃত্ব কিংবা পথ ও পদ্ধতি বদলানোর কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না।

বিএনপির মধ্যে অনেকে আছেন যারা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন যে, পরিবর্তন আনার শক্তি রাখেন তারেক রহমান এবং তিনিই পারেন তরুণ শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে ও তাদের মধ্যে গতি সঞ্চার করতে। তারা তার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আছে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর চেয়ে অদ্ভুত স্বপ্ন আর কিছু হয় না। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যদি বর্তমান বিএনপির নেতৃত্বে কোনো কাজে না আসে তাহলে তিনি কীভাবে বাংলাদেশে আসবেন সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। বিএনপিকে তাই গণতান্ত্রিক দলের নতুন রূপ দিতে হবে এবং বিশ্বাসযোগ্য ভাবমূর্তি অর্জন করতে হবে। সবাই যাতে দলটিকে দায়িত্বশীল এবং দুর্নীতি ও হিংসার রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে জনগণকে সুশাসনের আশীর্বাদ দিতে সক্ষম মনে করে।

একবার ক্ষমতায় আসতে পারলে ক্ষমতায় থাকাটা সহজ কিন্তু ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষমতা ফিরে পাওয়া খুবই কঠিন। যে সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার তোয়াক্কা করে না সেই সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে জনগণ কি ভাবল তাতে কি আসে যায়।

বিএনপি দলটিকে যতভাবে সম্ভব সাজা দেওয়া হচ্ছে, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ খুব খোশমেজাজে রয়েছে, পরিণাম নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতে হচ্ছে না। বিএনপি যাই বলুক বা দাবি করুক তাকে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার হচ্ছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতার কথা বলা হলো। কিন্তু বিএনপির এ সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হলো না। এরপর একযোগে নির্বাচন কমিশন নতুন করে গঠন করার কথা বলা হলো কিন্তু সে প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হলো।

বিএনপি কথা বলার একটি মঞ্চ মাত্র। রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার কোনো বালাই নেই। রাজনৈতিক বিষয়বস্তুগুলোকে রাজনৈতিক যুক্তিতে তুলে ধরার কোনো চেষ্টাও তাদের নেই। দলটির নেতারা একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারেই উদ্বিগ্ন। তাদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছে। তাই তাদের বিজয় নিশ্চিত। সহজ আশার সহজ পথ।

নির্বাচন কমিশনই যে খোদ সরকার এটা বোঝার চিন্তা-ভাবনা পর্যন্ত তারা হারিয়ে ফেলেছেন। আলাদা চরিত্রের ইলেকশন কমিশন গঠনের জন্য লড়াই করার সার্থকতা নেই। সরকারের নিরপেক্ষতা না থাকলে কোনো নির্বাচন কমিশনই স্বাধীনভাবে কাজ করার শক্তি পাবে না।

যদি অলৌকিকভাবে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তবে আওয়ামী লীগ বিরোধী নেতিবাচক জনপ্রিয়তার কারণে বিএনপি বিজয়ী হতে পারবে বলে আশাবাদী। কিন্তু সেটা বিএনপির জন্য মোটেও ইতিবাচক ভাবমূর্তি নয়। বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে যে ভিন্ন আচরণ করবে, তাদের রাজনীতি যে গণতান্ত্রিক আদর্শভিত্তিক একথা তো জনগণকে বলা হচ্ছে না। বর্তমান অবস্থায় পরিবর্তন বলতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বোঝাতে হবে। এক্ষেত্রে বিএনপি তার প্রয়াত রাজনীতির বাইরে কিছু বলতে পারছে না।

আওয়ামী লীগ সরকার যদি পরিত্যক্ত হয় এবং অন্যদের চাপে যদি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে জনগণ অন্য কোনো বিকল্পের সন্ধান না পেয়ে বিএনপিকে ভোট দেবে এমন আশায় বুঁদ হয়ে আছে বিএনপি নেতৃত্ব। কিন্তু বিএনপি এটা বোঝার চেষ্টা করছে না যে, নির্বাচনী রাজনীতি আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন লাভ করে থাকে তখন যে সময়ে দায়িত্বশীল বিকল্প সামনে থাকে। তাছাড়া পরিবর্তনের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও আগ্রহ থাকে না।

রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা বিএনপি অনুধাবন করতে পারছে না।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি অতীতে একই ভুল করেছে। তারা উভয়ে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলোকে ধ্বংস করে তাদের ক্ষমতার গণতান্ত্রিক ভিত্তি ভেঙে দিয়েছে। শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে পালা করে ক্ষমতায় এসেছে। এখন আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে জনগণের ওপর নির্ভর করছে না।

আওয়ামী লীগ সরকার নিছক একটি দলীয় সরকার নয়। সে জানে জনপ্রিয়তা বা জনসমর্থন তার ক্ষমতার উৎস নয়। তারপরও তার ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যবস্থা আছে। আওয়ামী লীগের উন্নয়নের রাজনীতি আর কিছু নয় অনেকের সঙ্গে মিলে দুর্নীতির অংশ ভাগাভাগির এক অভিনব ব্যবস্থা।

সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সেজন্য আমরা বলে আসছি জনগণের ভোটের নির্বাচনের রাজনীতি দেশে নেই। সংসদীয় ব্যবস্থার রীতি-নীতি ভেঙে শাসনতন্ত্রের সংশোধন করা হয়েছে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। দেশে ব্যবসায়িক রাজনীতি থাকার ফলেই ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার যৌথ সরকার চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন সাংবাদিকরা গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি। কিন্তু আমাদের সাংবাদিকরা সংঘবদ্ধভাবেই দলীয় রাজনীতির দলীয় কর্মী হয়ে বেশ উত্ফুল্লেই আছেন। 

তাই গণতন্ত্রমুখী পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক চিন্তায় ও দর্শনে পরিবর্তন আসা জরুরি হয়ে উঠেছে। জনমত সৃষ্টি করতে হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়বস্তুর ওপর পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়ে। শুধু ক্ষমতায় আসার সুযোগ হিসেবে নির্বাচন দাবি করা জনগণের সুশাসন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি নয়।

যথাযথ পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে বিএনপিতে অনেক সৎ ও যোগ্য লোক রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা এই পরিবর্তন আনার ব্যাপারে কতটা রাজনৈতিক ইচ্ছা পোষণ করেন। ক্ষমতার আরাম কেদারায় বসে জীবন উপভোগ করা কিংবা রাজনীতির মাধ্যমে অর্থের পাহাড় গড়া, আর গণতান্ত্রিক আদর্শে প্রত্যয়ী হয়ে সৎ সাহসের রাজনীতি করা এক কথা নয়— সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে ভাষা ধার করে নিয়ে বলতে হয়, সত্যিকার পরিবর্তন আনার জন্য চাই একটি দল এবং নেতৃত্ব যে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করবে, ‘হ্যাঁ আমরা পারি’। আমরা পরিবর্তনের এজেন্ট।

দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো প্রস্তুতি বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তারা অতীতের ব্যবসায়ী রাজনীতির বাইরে কিছু ভাবতে পারছেন না। জনস্বার্থ রক্ষার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এটাই বড় বিপর্যয়।

 

     লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর