রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

খাদিজার আর্তনাদ ও ধনীর পেটে গরিবের চাল

কাজী সিরাজ

খাদিজার আর্তনাদ ও ধনীর পেটে গরিবের চাল

আজ লিখতে বসে বিষয় নির্বাচন করতে চিন্তায় পড়েছিলাম। লেখার স্পর্শকাতর এত বিষয় যে, কোনটা রেখে কোনটা লিখি। এ সপ্তাহের দুটি জরুরি বিষয়ের কোনোটাই বাদ দেওয়া যায় না। প্রথমটি, সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসের ওপর ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের বর্বর হামলা এবং দ্বিতীয়টি, গরিবের চাল লুটেপুটে খাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতা এবং তাদের স্বজনরা। খাদিজার ওপর ছাত্রলীগ নেতার উন্মত্ত পৈশাচিকতার খবর প্রকাশিত হয়েছে দেশের সব জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় এবং সব টিভি চ্যানেলে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নরপশুটি নির্দয়ভাবে কুপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে খাদিজার মাথাসহ দেহের বিভিন্ন স্থান। এ লেখা যখন লিখছি, মেয়েটি তখনো স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যমের সঙ্গে লড়াই করছে। ডাক্তাররা আশার বাণী শুনিয়েছেন যে, তার অবস্থার খুব একটা উন্নতি না হলেও অবনতি হয়নি, স্থিতিশীল আছে। দেশবাসী কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছেন মেয়েটি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। লেখাটা যেদিন পাঠকের হাতে পৌঁছবে জানি না কী খবর পাব আমরা।

শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ বদরুলকে বহিষ্কারের কথা বলছে। এ-ও বলছে যে, ব্যক্তির অপরাধের দায় সংগঠন নেবে না। আবার কেউ কেউ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন। বলছেন, বদরুল এখন একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করে। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ কর্মজীবনে প্রবেশ করলে তিনি আর ছাত্রলীগের সদস্য থাকতে পারবেন না। এ সব ‘রঙের কথা’ ধোপে টেকে না। দুর্বৃত্ত ব্যক্তি দুষ্কর্ম ঘটানো পর্যন্তই ছাত্রলীগ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক— বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনে বেশ বড় নেতাই। বদরুলের ‘ফুলের মতো পবিত্রতা’ ছাত্রলীগ শাবি শাখা এবং কেন্দ্রীয় শাখার নেতাদের অজানা কোনো বিষয় নয়। এক বছর আগেও এই মেয়েকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে প্রহৃত হয়েছিল এই বদরুল। জঙ্গি কৌশলে কোপাকুপি করে ধরা পড়ার পর এখন তাকে বহিষ্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এক বছর আগে ছাত্রলীগ কী করেছে? তখন যদি ঘটনা তদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিত তাহলে খাদিজা নামের নিরীহ লক্ষ্মী মেয়েটি অবশ্যই চাপাতির কোপ থেকে বেঁচে যেত। যারা বদরুলকে স্কুলশিক্ষক বা টিউশনি করে ইত্যাদি পরিচয়ের আবরণে তার ছাত্রলীগ নেতার পরিচয়কে ঢেকে রাখতে চান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে কিন্তু তাদের মুখে চুনকালি পড়েছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘কে কোন দল করে আমি সেটা দেখি না, দেখব না। যে অপরাধী সে অপরাধীই। সেই অপরাধীর বিচার হবে’। প্রধানমন্ত্রী কাউকে দলীয় বিবেচনায় প্রশ্রয় দিচ্ছেন না, দেবেন না বলেও উল্লেখ করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, প্রধানমন্ত্রী বদরুলের দলীয় পরিচয় গোপন করতে চাননি। তার কথার ওপর আস্থা রেখে আশা করা যায়, এ ঘটনার যথাযথ বিচার ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ছাত্রলীগ দিন দিন খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদের লাগাম টেনে ধরা না গেলে লীগ সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য বিএনপি বা অন্য কোনো বিরোধী দলের প্রয়োজন হবে না। আমাদের সবারই মনে থাকার কথা যে, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পর ছাত্রলীগ দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে এমনভাবে প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়ে যে, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে থামান। ছাত্রলীগ কিন্তু থামেনি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী ছিলেন। সংগঠনের কিছু ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণহীন অনৈতিক আচরণে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদে ইস্তফা ঘোষণা করেন প্রকাশ্যে। ছাত্রলীগের কোনো কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারীঘটিত কেলেঙ্কারির অভিযোগও ওঠে। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এলে সংগঠনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে বলা হয়, অথবা বহিষ্কার করা হয়। কারও বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার খবর আমরা খুব একটা জানি না। ফলে সংগঠনের ভিতরকার ‘নষ্টমনের দুষ্টরা’ আশকারা পেয়ে যায়। একটির পর একটি দুষ্কর্ম বাড়তেই থাকে। ছাত্রলীগ সংগঠনগতভাবে নারীঘটিত দুষ্কর্ম বা অন্য কোনো দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত তেমন কথা বলছি না। তবে এ কথা ঠিক যে, সংগঠন ছাত্রলীগ তার কোনো কোনো নেতা-কর্মী ও ক্যাডারের এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এরা ছাত্রলীগের সুনাম নষ্ট করছে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও যুব সংগঠন যুবদলের মধ্যেও একই ধরনের অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বেগম খালেদা জিয়া তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তা-ও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন; বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে তার ছাত্র-যুব সংগঠনের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অনুকরণযোগ্য পদক্ষেপও নিতে পারেননি। বলাই বাহুল্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও ক্যাডারদের মধ্যেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে, জনসম্মুখেই অপকর্ম সংঘটন করে। জোর করে তুলে নেওয়া, সশস্ত্র আক্রমণ বা হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত তারা ঘটায় সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে। মানুষ দূর থেকে দেখে, কিন্তু আক্রান্তকে উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসে না। খাদিজার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। চাপাতির উপর্যুপরি কোপ থেকে তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি কেউ। অনেকে লিখছেন, কেউ কেউ টিভি টকশোতে বলছেন, ‘প্রকাশ্যে এমন হিংস কাজটি করল ছাত্রলীগ নেতা বদরুল, কেউ তাকে বাঁচাতে এলো না তার আর্তচিৎকারের পরও।’ যিনি বা যারা এমন লিখছেন বা বলছেন, তার বা তাদের সামনে এমন ঘটনা ঘটলে তিনি বা তারা কী করতেন? এগিয়ে যেতেন খাদিজাকে রক্ষা করতে? আমার তো মনে হয় যেতেন না। সে সাহস এখন কারও নেই। একটা সময় ছিল, দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে এমন সব অপরাধ করতে সাহস পেত না। কেননা, তারা ছিল গণবিচ্ছিন্ন দুর্বৃত্ত। সমাজকাঠামো ছিল পারস্পরিক মিলনের, বন্ধনের। খারাপ কাজের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ হতো। আইনও এ ব্যাপারে কারও দ্বারা প্রভাবিত হতো না। ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ লক্ষ্য করা যেত। এখন দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ, প্রতিহত করতে মানুষ সাহস করে এগিয়ে যায় না, তার কারণ, এদের সোর্স অব পাওয়ার অনেক শক্তিশালী। এরা অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসক দলের আশ্রিত, লালিত-পালিত। এদের প্রতিরোধ, প্রতিহত করতে গেলে ‘খবর আছে’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এদের সমীহ করে চলতে হয় শাসক দলের লোক বলে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুর্বৃত্তের পক্ষাবলম্বন করে কোনো ভিকটিমকে সাহায্যকারী ভালো মানুষটিকে বা মানুষগুলোকে হেনস্থা করছে। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে সে দলের ক্যাডাররাই এ সুযোগ গ্রহণ করে। খাদিজার ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগের একজন পরিচিত কেউটে। সে ভয়েই প্রথম দিকে কেউ এগিয়ে যায়নি তাকে উদ্ধার করতে। পরে ছাত্রলীগেরই কিছু কর্মী এগিয়ে আসায় সাহস সঞ্চারিত হয় অন্যদের মাঝে এবং দুর্বৃত্ত বদরুলকে আটক করে। দুর্বৃত্ত-দস্যুদের লালন-পালনের সংস্কৃতি চালু করেছে আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলো। এসব দলে এখন রাজনীতি ও আদর্শের চর্চা নেই, এরা সব শুধুই ক্ষমতার কাঙ্গাল। ক্ষমতা ‘দখলের’ জন্য (প্রতিপক্ষকে হঠিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট, সিল মারামারি, কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হল-ছাত্রাবাস দখলের জন্য, টেন্ডারবাক্স পাহারা বা দখলের জন্য) এদের আদর্শবাদী, নীতিবান-নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মীর প্রয়োজন নেই, ভবিষ্যৎ নেতা তৈরিরও প্রয়োজন নেই— নেতা তো হবে নেতা-নেত্রীদের ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতিরা; এদের দরকার লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য কিছু অনুগত লোক। খারাপ কাজে বিপদে পড়লে প্রটেকশনের জন্য দল তাদের ভরসা। দল তাদের নিরাশও করে না। এদের রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ব্যবহার করে দল। একটা প্রমোশনের লোভে, খারাপ জায়গায় বদলির ভয়ে অথবা পানিশমেন্টের আতঙ্কে হুকুম তামিল করা ছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না তাদের। সরকার অদল-বদল হলেও এদের কাজ কিন্তু বদলায় না। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে, দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে খাদিজাদের রক্ষা করতে সাধারণ, শান্তিপ্রিয় মানুষ সাহসী হবে না। কারণ তাদেরও যে বিপদের ভয়। জীবনের ভয়। সন্তান-সন্ততির নিরাপত্তার ভয়। যতদিন বড় বড় রাজনৈতিক দল বাহুবলের পরিবর্তে ফের আদর্শের শক্তিতে বলীয়ান না হবে, স্রেফ ক্ষমতার লিপ্সায় (হয় ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অথবা ক্ষমতা দখলের জন্য) পেশিবাজ মাস্তানদের, ‘বদরুলদের’ পৃষ্ঠপোষকতা ও লালন করার অপকৌশল পরিহার না করবে, ততদিন বদ চরিত্রের ‘বদরুলদের’ হাত থেকে এই সমাজ-রাষ্ট্রের রক্ষা নেই, নিরাপত্তা নেই ‘খাদিজাদের।’

দুই.

স্বাধীনতার পর পর রেশনের চাল এবং রিলিফের কম্বল নিয়ে আওয়ামী লীগের খুব দুর্নাম হয়েছিল। সেই অপরাধ প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগ এখনো বেরোতে পারছে না। বাংলাদেশ প্রতিদিন ৫ অক্টোবর খবর দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতার স্বজনদের পেটে ১০ টাকা কেজির চাল। খবরে বলা হয়েছে, ‘হতদরিদ্রের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন জেলায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ করছে সরকার। কিন্তু এ চাল পাচ্ছে না হতদরিদ্ররা। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত হতদরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব ইউপি চেয়ারম্যান ও একজন সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির। কিন্তু এ তালিকা প্রণয়ন করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এতে দুস্থতা বিবেচনা না করে শুধু দলীয় বিবেচনায় তালিকা করায় অনেক সচ্ছল পরিবার তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর ফলে রাজনীতি করে না এমন বহু দুস্থ পরিবার ১০ টাকা কেজি দরে চাল কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’ রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গরিবের চাল আওয়ামী লীগ নেতার স্বজনদের পেটে চলে যাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ আছে পত্রিকাটিতে।

হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজি দামের চাল কালোবাজারেও বিক্রি হচ্ছে। এমন একটি খবর ছাপা হয়েছে গত ৫ অক্টোবরের দৈনিক নিউ নেশনে। খবরে আরও বলা হয়েছে, পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে কালোবাজারে বিক্রির জন্য মজুদ করা টনকে টন চাল জব্দ করেছে। শুধু তাই নয়, এই অসাধু কাজে জড়িত থাকার অপরাধে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। গত ৭ সেপ্টেম্বর ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ : ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’ স্লোগান দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ টাকা কেজিতে হতদরিদ্রদের মধ্যে চাল বিক্রির কর্মসূচি উদ্বোধন করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী দলের প্রভাবশালীরা বুঝি এ কর্মসূচি ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল। এই কর্মসূচির চাল বিক্রির জন্য যে নীতিমালা ঘোষণা করা হয়, তা লঙ্ঘন করে চলছে অনৈতিক কার্যকলাপ। হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়ন, ডিলার নিয়োগ কোনো ক্ষেত্রেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। এমনকি সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান কেউ মানছেন না নীতিমালা। অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, প্রভাবশালী লীগ নেতারা স্ব স্ব এলাকায় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের মধ্যে থেকে ডিলার বাছাই না করে দল, অঙ্গ দল ও সহযোগী দলের নেতা-কর্মীদের ডিলার নিয়োগ করছেন। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা বা স্থানীয় প্রশাসন শাসক দলের নেতাদের এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অতীতেও দেখা গেছে, প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই, রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তরা এমন সব অপকর্ম করে থাকে। কোথাও এমন গর্হিত কাজে বাধা দিলে শাসক দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও হুমকির মুখে তা টিকছে না। ফলে গরিবের চাল চলে যাচ্ছে ধনীর ঘরে।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, এই কর্মসূচিতে কোনো ধরনের অনিয়মের বিষয় তার জানা নেই। অর্থাৎ সব কিছু নিয়মমাফিক হচ্ছে। অথচ জাতীয় দৈনিকে খবর বেরিয়েছে যে, যশোরের চৌগাছায় ডিলারদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ডিলারের হাটেবাজারে কোনো দোকান নেই। বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশালের গৌরনদীতে ১০ টাকা কেজির ‘গরিবের চাল’ পাচারকালে ট্রাক আটক করা হয়েছে। চাল বিতরণকে কেন্দ্র করে যশোরের শার্শায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। খুলনায় ডিলার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন স্কুল-কলেজের লীগপন্থি শিক্ষক-কর্মচারী এবং আওয়ামী-যুবলীগ নেতা। ডিলার হয়েছেন ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা ও কলেজ প্রভাষকরা। একই অবস্থা ঠাকুরগাঁও, বরিশাল, যশোর, শরীয়তপুর, বান্দরবান, ময়মনসিংহ, কুমিল্লাসহ দেশের প্রায় সর্বত্র। খাদ্যমন্ত্রী কী করে বললেন সব ঠিকঠাক মতো চলছে তা বোধগম্য নয়। ন্যায্যমূল্যের সরবরাহ ব্যবস্থা এবং রিলিফ বিতরণ নিয়ে আওয়ামী লীগের একটা দুর্নাম আছে সে কথা শুরুতেই বলেছি। প্রধানমন্ত্রী মহৎ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মসূচিটি চালু করেছেন। ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে এই কর্মসূচির আওতায় আনার কথা ছিল। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে তালিকায় ঢুকে পড়ছে শাসকদলীয় অবস্থাপন্নরা। এরা গরিবের হক কেড়ে নিচ্ছে। তাদের জন্য বরাদ্দ করা স্বল্পমূল্যের চাল তারা চালান করছে কালোবাজারে। ১০ টাকা কেজি দরের চাল দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে বিক্রি করে ‘লাল’ হচ্ছে কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তারা এই কর্মসূচিকে ঘিরে ব্যবসার একটা মওকা পেয়েছে। ব্যর্থ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এ কর্মসূচিকে নষ্ট করে দেওয়ার অপরাধে ইতিমধ্যে যে সব দলীয় লোককে আটক করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। অব্যবসায়ী দলীয় যে সব ক্যাডারকে ডিলারশিপ দেওয়া হয়েছে এবং প্রকৃত সুবিধাভোগীর স্থলে যে সব ধনী ও অবস্থাপন্নদের নাম ঢোকানো হয়েছে সব বাতিল করে নতুনভাবে এবং সঠিকভাবে তা করার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

ডিলার নিয়োগ ও হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়নে দলীয় এমপি ও অন্যদের বাদ দেওয়া উচিত।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর