সোমবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘মিড ডে মিল’ হতে পারে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির আর একটি ধাপ

শাহীন আহমেদ

‘মিড ডে মিল’ হতে পারে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির আর একটি ধাপ

শিশুরা স্কুলে যায় না। গেলেও পড়াশোনায় তাদের মন থাকে না। সরকারের তরফ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে অসংকুলান। ফলে বহু পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে পড়াশোনার প্রতি। রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জ। এ উপজেলার এমন বহু সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ঘুরে ঘুরে দেখেছি। হেঁটেছি পথ থেকে পথে। মানুষের অভাব, দরিদ্রতা তাদের কতটা পিছিয়ে দিতে পারে সচক্ষে অবলোকন করেছি। এই জনপদের অনেক পরিবারের ইচ্ছা সত্ত্বেও সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারছিল না।

আবার শত অভাবের মধ্যে থেকেও যেসব বাবা-মা সন্তানকে স্কুলে পাঠান, তাদের সন্তানেরা পড়াশোনায় ঠিকমতো মন দিতে পারে না। স্কুলের বেঞ্চে গিয়ে বসে ঠিকই, শিক্ষক কি দীক্ষা দিচ্ছেন সেদিকে যেন শিশুদের ভ্রুক্ষেপই নেই। থাকবেই বা কী করে! সে যে আধপেটা কিংবা অনাহারি— ক্ষুধার রাজ্যে যেন পৃথিবী গদ্যময়, সেটাই তো নেপথ্যের করুণ গল্প।

সেই ২০০৮ সালের ঘটনা। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে এসব ছবিই দেখতে হয় আমাকে। তখনই পণ করেছিলাম একদিন এ অবস্থা আর থাকতে দেব না। বদলে দেব পড়াশোনার ধরন। বদলে দেব গ্রামাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলোর দুঃখ-দুর্দশা। ঝরেপড়া শিশুদের আবারও স্কুলমুখী করব। স্কুলে যাওয়া শিশুদেরও পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট করব। এসব চিন্তা মাথায় কেবলই ঘুরপাক খেত।

২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে এ এলাকার মানুষ আমাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেন। সেটিকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করি। শুরু হতে থাকে একটির পর একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকি ঠিক স্বপ্নের পথে। যেসব গ্রামে ঘুরে দেখেছি অবহেলার সাতকাহন, সেখানেই যাই আবারও। কথা বলি সংশ্লিষ্ট পরিবারের কর্তাব্যক্তি, সমাজের অভিভাবক এবং স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের সঙ্গে। সবাই একবাক্যে সমর্থন করেন। মনের জোর আরও বেড়ে যায়।

প্রথম ধাপে পাঁচটি স্কুলকে নিয়ে শুরু হয় স্বপ্নের পথচলা— ‘মিড ডে মিল’। এ কর্মসূচিই বদলে দেওয়ার প্লাটফর্ম তৈরি করে দেয় এলাকাগুলোয়। নির্বাচিত করি পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মিড ডে মিল কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করি স্থানীয় শিক্ষানুরাগী, অভিভাবক এবং শিক্ষকদেরও। তুমুল উৎসাহের মধ্য দিয়ে শুরু থেকেই এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন হতে থাকে।

বলা হয়ে থাকে যে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তাহলে শিক্ষার মেরুদণ্ড কী? নিঃসন্দেহে প্রাথমিক শিক্ষা। একজন শিক্ষার্থী, একটি জাতির স্তম্ভও সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি অঞ্চলের শিক্ষানুরাগীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, সুবিধাবঞ্চিত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মিড ডে মিল কর্মসূচি চালু করার।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সারা দেশে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিয়েছে। মানুষ খুবই খুশি হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ১০ টাকা দরে চাল খাওয়ানোর কথা বলেছিলেন। মানুষ তাকে নির্বাচিতও করেছেন। টানা দুই দফা সরকারে থেকে আওয়ামী লীগ মানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে শিক্ষার বিষয়টিও সম্পৃক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শিক্ষার মান ক্রমাগত হারে বেড়ে চলেছে। সারা দেশে শিক্ষার জবুথবু অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আজ নবদিগন্তে আমরা। তবুও কোথাও এক ধরনের বঞ্চনা রয়ে গেছে। বিশেষ করে তৃণমূলে। একেবারে সেখানে, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছালেও দুঃখ মোচন হয় না।

আমি দুই দফায় কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। আমার নিজস্ব উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন এবং এর ফলে বদলে যাওয়া মানুষ ও জনপদের উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরলে হয়তো সেটি সারা দেশের সুবিধাবঞ্চিত এলাকার প্রয়োজনে কাজে লাগানো যেতে পারে।

কেরানীগঞ্জের কয়েকটি সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় আমি ঘুরেছি নানা সময়ে। ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কাজের একটি প্লাটফর্ম খুঁজে পাই। তার আগে দেখেছি এই এলাকার শিক্ষার মান খুবই নিম্নে। প্রাথমিক স্তরে পাসের হার মাত্র ৫২ শতাংশ। সে তো আছে। তার ওপর আছে ঝরেপড়ার বিষয়। তৃণমূলের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের সন্তানেরা স্কুলের চার দেয়ালই ছুঁতে পারত না। ভিতরে ঢোকার আকাঙ্ক্ষা ওদের ভিতরে জন্মাত না। পরিবেশ, প্রতিবেশই তাদের বাধ্য করে শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকতে।

এমনও অনেক শিশু দেখেছি, যাদের পরনের জামা ছিল মলিন, রোগা শরীর নিয়ে স্কুলে আসত আধপেটা বা একদম খালিপেটে। ওদের মধ্যে ছিল যথেষ্ট পুষ্টিহীনতা। বিদ্যালয়ের বেঞ্চে এসে বসত এবং শিক্ষকের পড়ার প্রতি হাঁ করে তাকিয়ে থাকত বটে, মগজের ভিতরে কিছু ঢুকত না। সেখানেই ওদের আসল শিক্ষার শূন্যতা।

আমি ব্যক্তিগতভাবে পর্যালোচনা এবং একটি জরিপ চালিয়ে নিশ্চিত হই যে ঠিক কী পরিমাণ শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। আরও জানার চেষ্টা করি যে, স্কুলের আওতায় গেলে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী নানা রকমের শূন্যতায় ভোগে। তখন জানা যায়, অভাব কিংবা দরিদ্রতার কারণেই অগণিত শিশু পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ স্থাপন করতে পারে না।

সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে দফায় দফায় বৈঠক করি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক এবং স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের সঙ্গে। সবার পরামর্শ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করি। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা কিংবা দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত না খেয়ে থাকা শিশুরাই সবার থেকে পিছিয়ে থাকে বলে সবার পর্যবেক্ষণে ওঠে আসে।

কেরানীগঞ্জের চর চামারদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাক্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাইনা খালপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর সোনাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে লক্ষ্য করে এগোতে থাকে আমার স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা। সঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষানুরাগী এবং অভিভাবকের দেওয়া পরামর্শ। এ পাঁচটি বিদ্যালয়ে চালু করি ‘মিড ডে মিল’।

এরপর আর পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়া। কিছুদের মধ্যে তালিকায় যুক্ত হবে মোট ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ‘মিড ডে মিল’ বলতে শিশু শিক্ষার্থীদের পেটভরে খাওয়ানোর কর্মসূচি। সেই ২০০৯ সাল থেকে আমি শুরু করেছি। আমার স্বপ্ন অনেক। আশা আছে, কেরানীগঞ্জের যতগুলো সুবিধাবঞ্চিত এলাকা বা বিদ্যাপীঠ রয়েছে, সবগুলোতে এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করব।

খুবই অন্যরকমের অনুভূতি জন্ম নেয় মনের ভিতরে। প্রতিদিন সকালে এ পাঁচটি স্কুলে পরিদর্শনে বের হই। ঘুরে দেখার চেষ্টা করি, শিশুরা আদৌ খুশি কিনা। নাকি, কোথাও ফারাক রয়ে যাচ্ছে। ওদের সঙ্গে বসেই অনেকদিনের ব্রেকফাস্ট হয়েছে। ওরা যা খায়, আমিও তা-ই খাই। কখনো খিচুরি, মাছ-সবজি কিংবা কখনো রুটি-ডিম। সর্বোপরি শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর করতে উপকারী খাবারগুলোই ওদের জন্য নিয়মিত পরিবেশন করা হয়। আর এ মহান কাজে আমি একা নই, শামিল হয়েছেন এলাকার সর্বস্তরের মানুষও। কৃষকেরা আছেন। মায়েরা আছেন। কৃষক বাবারা একেকজনে একেক ধরনের সবজি দিয়ে যান। কেউবা তেলও দিয়ে যান। আর মায়েদের ভূমিকা আর সাজানো। আমি কদিন পরপরই মা সমাবেশ করি। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সব মা উপস্থিত হন। তাদের আগ্রহের ভিত্তিতেই রাঁধুনি নির্বাচন হয়। আর সেটি তাদের মধ্য থেকেই। তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়সূচি নির্ধারণ করে রাঁধেন গোটা স্কুলের সব ছেলেমেয়ের জন্য। এ যেন অন্যরকম অনুভূতি।

শুধু পুষ্টিকর খাবার পরিবেশনই নয়, বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তাও করেছি। উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে উপজেলার সব বিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ পানীয় এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করেছি। শিশুদের শৃঙ্খলা শেখাতে করে দিয়েছি অনেকগুলো কমিটি। তাতে সম্পৃক্ত রয়েছেন শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী। সবার সমন্বয়ে শৃঙ্খলাচর্চা চলছে। মনোবিকাশের ব্যবস্থাও করেছি।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে উপজেলার ১২৮টি বিদ্যালয়ে বিতরণ করেছি কম্পিউটার। প্রতিটি স্কুলের তিনজন শিক্ষককে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছি। ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকদের আরও দক্ষ করে তুলতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে নিবিড় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। EIA (English in Action) এর আওতায় ২৪টি বিদ্যালয়ের তিনজন করে শিক্ষক প্রশিক্ষিত ছিল। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাকি ১০৪টি বিদ্যালয়ে ৩১২ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্পিকারও দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে স্থানীয় উদ্যোগে এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন তো আছেই, সবগুলোর মধ্যে সর্বাধিক কার্যকরী পদক্ষেপ হলো ‘মিড ডে মিল’। গ্রামে গ্রামে এ ধরনের কর্মসূচি চালু করা হলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। কেরানীগঞ্জে ২০০৯ সাল থেকে করা আমার এ কর্মসূচিকে পাইলট প্রকল্প বিবেচনা করা হলে সেটি সারা দেশের ক্ষেত্রে বিরাট এক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর আর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ অটিজমসহ একীভূত শিক্ষা নিশ্চিত করা। এরই আলোকে কেরানীগঞ্জ উপজেলার সব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর উপবৃত্তিসহ ডিভাইজ (হুইল চেয়ার, ক্র্যাচ, চশমা ও শ্রবণ যন্ত্র) প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও প্রতিবছর দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বৃত্তি প্রদান করে থাকি। 

কেরানীগঞ্জের যে পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচি চালু আছে, সেসব এলাকার আশপাশে এখন আর কোনো সুবিধাবঞ্চিত শিশু নেই। কোনো শিশুই এখন আর বিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে থাকছে না। একজন শিশুকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিদ্যালয়ের বেঞ্চে বসতেই ওদের প্রফুল্ল দেখা যায়, যা এ কর্মসূচি গ্রহণের আগে কখনোই দেখা মিলত না।

শুধু প্রাথমিক স্তর নয়, নানাবিধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে কেরানীগঞ্জের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টে গেছে। উন্নত হয়েছে পড়াশোনার মানও। এখন আর অর্ধেকে আটকে নেই পাসের হার। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, কেরানীগঞ্জে বর্তমানে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাসের হারের দিক থেকে ঢাকা জেলা এবং ঢাকা বিভাগে কেরানীগঞ্জ প্রথম। শিক্ষাক্ষেত্রে নানাবিধ উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং অনন্য ভূমিকার অংশ হিসেবে ২০১২ সালে সরকার আমাকে দেশের শ্রেষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সম্মানিত করেন। এরপর থেকে স্থানীয়ভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নে আমি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

একটি বিষয় খুবই ভাবিয়ে তুলত। এ শিশুদেরই বলা হয়ে থাকে আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। এদের পেছনে বৃত্তি-উপবৃত্তি থেকে কত কিছুই করে যাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ টাকা দরে চাল দিয়েছেন সারা দেশে। আমার জানা মতে, প্রতি কেজি চালের পেছনে খরচ হয়েছে ৩৭ টাকা। হিসাব নিকাশ করলে সঠিক তথ্যটা বের হবে। এই ১০ টাকা কেজি দরের চালের কিছু অংশ যদি সারা দেশে সুবিধাবঞ্চিত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ কার্ডের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া যেত তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসত। এটিই হবে জাতির ভবিষ্যতের জন্য আসল বিনিয়োগ।

বিত্তবানদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী স্থানীয়দের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন যে, সবার সংশ্লিষ্টতায় গ্রামে গ্রামে ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচি চালু করা হোক। স্কুলে স্কুলে রান্না হবে। এতে একবেলা খাওয়ার সুযোগ পাবে শিশুরা। সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হবে। বন্ধুসুলভ আচরণের দীক্ষা সেখান থেকেই পাবে খুদে শিক্ষার্থীরা। মিড ডে মিল কর্মসূচি পুরোদমে চালু হলে দেশের কোনো শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতার বাইরে থাকবে না।

প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান যুগোপযোগী। এটি বাস্তবায়ন হলে সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোয় আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে। পাইলট প্রকল্প বিবেচনা করা হলে আমার উপজেলা কেরানীগঞ্জই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

চর চামারদহ, শাক্তা, পাইনা খালপাড়, চর সোনাকান্দা এবং মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিদিনকার ছবিটুকু আপনি কল্পনা করে নিতে পারেন। সেখানে প্রতিটি সকালের সূর্য আলো ছড়ায় নতুন নতুন তেজে। এখানে একদিকে স্কুলের ভিতরে পড়াশোনায় নিবিষ্ট থাকে খুদে শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে স্কুল আঙিনায় চলে রান্নাবান্না। ওই শিক্ষার্থীদের মায়েরা রান্না করেন। বাবারাও সহায়তা করেন। সবাই মিলেমিশে একটা বেলা পেটপুরে খান। তারপরেই বাড়ির পথে যাত্রা। এই হলো এখানকার ‘মিড ডে মিল’।

কেরানীগঞ্জের কয়েকটি জনপদ যেভাবে বদলে গেছে, যেভাবে এখানে আলোর ছোঁয়া লেগেছে, তাতে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে— সারা বাংলাদেশের সব সুবিধাবঞ্চিত স্কুল বা এলাকায় এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে, বদলে যাবে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার অনেককিছু। ঝরেপড়া রোধ হবে। সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত হবে আগামীর ভবিষ্যৎ। দূর হবে শিশুর পুষ্টিহীনতা, সুস্বাস্থ্য বেড়ে ওঠার পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া কমবে। সৃজনশীল মানুষ হিসেবেই আজকের শিশু আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।

লেখক : উপজেলা চেয়ারম্যান, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর