ইমান শব্দের অর্থ বিশ্বাস স্থাপন করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, ‘মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তার সবকিছু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করাকে ইমান বলে।’ যিনি ইমান গ্রহণ করেন তাকে মুমিন বলা হয়। দুনিয়াজুড়ে মুসলিম মনীষীরা ইমান ও মুমিনের এই সংজ্ঞাই দিয়ে আসছেন। দর্শনশাস্ত্র মতে, ব্যক্তির বিশ্বাস তার কর্মে প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ ব্যক্তির আচরণ ও কর্ম তার বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। আগুন সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস হলো, এটি সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। হাজার বছর ধরে আগুনের পূজা-অর্চনা করার পরও এক মুহৃর্তের জন্য পুজারিকে শান্তির পরশ দেবে না আগুন। তাই আজ পর্যন্ত কোনো অগ্নিপূজক ভুলেও আগুনের দাহ্য শক্তি পরীক্ষার নামে নিজেকে কিংবা নিজের সম্পদকে তার কাছে সমর্পণ করেনি। এ উদাহরণের পর বলতে চাই, রসুল (সা.) আমাদের কাছে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এসব কিছু বিশ্বাসের সঙ্গে কাজে প্রতিফলিত করতে পারলেই আমরা মুমিন হব। পবিত্র কোরআনও তাই বলছে— ‘ইন্নাল্লাজিনা আমানু ওয়া আমিলুস সালিহাত’ অর্থাৎ যারা বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করে’। ‘আল্লাজিনা ইউমিনুনা বিল গায়বি ওয়া ইউকিমুনাস সালাতি’ অর্থাৎ ‘যারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং বিশ্বাসের ফলস্বরূপ গায়েবের প্রভুর নির্দেশ মোতাবেক সালাত কায়েম করে’। এমনিভাবে পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে বিশ্বাস ও কাজের সমন্বয়কেই ইমান বলেছে। এর বিপরীত যারা চলবে তাদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। একদল যারা বিশ্বাস করবে না, তারা কাফের।
আরেক দল যারা বিশ্বাস করবে কিন্তু সেই বিশ্বাসকে কাজে পরিণত করবে না, তারা মুনাফেক-কপট। এ দুই শ্রেণিই চিরদিনের জন্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তবে মুনাফেক অর্থাৎ যারা শুধু বিশ্বাস করবে কাজে পরিণত করবে না তাদের অবস্থান কাফেরের চেয়েও ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, ‘ইন্নাল মুনাফিকিনি ফিদ দারকিল আসফালি মিনান নার’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয় কপট মুনাফেকদের অবস্থান হবে জাহান্নামের তলদেশে।’
প্রিয় পাঠক, এবার কোরআনের কষ্টিপাথরে মিলিয়ে দেখি, আমরা সত্যিই বিশ্বাসী তথা মুমিন হতে পেরেছি কিনা। তার আগে বলে রাখি, এতদিন যারা ভেবে এসেছেন, তোতা পাখির মতো না বুঝে কিছু ‘কালেমা’ পড়লেই বিশ্বাসী তথা ইমানদার হওয়া যায় তাদের ধারণা কোরআনের আলোকে সম্পূর্ণ ভুল। কোরআন বলেছে আল্লাহর সব নবী, পরকালসহ আরও কিছু বিষয় বিশ্বাস করলে এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করলেই কেবল একজন মানুষ মুমিনের মর্যাদা লাভ করতে পারবে। আল্লাহ বলেছেন, ‘ওহে তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের পাওনা ছেড়ে দাও; যদি তোমরা সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাসী হয়ে থাক।’ সূরা বাকারার ২৭৮নং আয়াত এটি। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় সুদের ভয়াবহতা উল্লেখ করা হয়েছে। একথাও বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা সুদ ছেড়ে না দাও, তবে আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হও’। এত কঠিন হুঁশিয়ারি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের মানুষ কি সুদ থেকে মুক্ত থেকেছে? অনেক মুসলমানই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সুদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাহলে এরা কি কোরআনের সুদ সংক্রান্ত আয়াতগুলো বিশ্বাস করেনি? সহজ উত্তর, না। যদি বিশ্বাসই করত তবে অবশ্যই তারা সুদের সঙ্গে যুক্ত হতো না। অন্তত নিজ অবস্থান থেকে সুদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললেও নিজেকে কমজোর মুমিন পরিচয় দিতে পারত। এ মুসলমানরাই আবার নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ করে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘পাকা অঙ্গীকার নেওয়ার পরও কি তোমরা আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে আর কিছু অংশ করবে অস্বীকার-অমান্য! তোমাদের মধ্যে যারা এমনটি করবে তাদের প্রতিদান এ শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয় যে, দুনিয়ার জীবনে তাদের গ্রাস করবে হীনতা-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। আর কেয়ামতের দিন নিক্ষেপ করা হবে কঠিন আজাবে।’ (সূরা বাকারা : ৮৫)।এবার আসুন জাকাত প্রসঙ্গে। ইসলামের অন্যতম মূল ভিত্তি হলো জাকাত। এদেশের অনেক ধনী মুসলমান বছরে একবার জাকাতের নামে মানবতার সঙ্গে উপহাস করে মাত্র। তাই তো স্বাধীনতার এত বছর পরও এ দেশের পঁচাশি শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। জাকাতের নামে উপহাস করেও নিজেদের মুসলমান দাবি করছে। শুধু মুসলমান ভাবতে পারেননি খলিফাতুর রসুল (সা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার রাষ্ট্রে কেউ যদি জাকাতের একটি উটের রশিও দিতে অস্বীকার করে তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব।’ এ কথা শুনে ওমর (রা.) বললেন, ‘আবু বকর! রসুল কি বলেননি, যে ব্যক্তি আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করবে তার জীবন ও সম্পদ আমাদের জন্য হালাল নয়?’ আবু বকর বললেন, হাঁ। তবে আল্লাহকে বিশ্বাসের দাবিই হলো আল্লাহর দেখানো পথে চলা। প্রিয় পাঠক, বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের কাজের অমিলের মাত্র দুটি উদাহরণ দিলাম। এমনিভাবে আমাদের জীবনের পুরোটাই কোরআন এবং বিশ্বাসের বিপরীত। তারপরও আমরা মুমিন তথা বিশ্বাসী কি! আমাদেরই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু আমিনু’ অর্থাৎ ‘ওহে তোমরা যারা নিজেদের বিশ্বাসী বলে দাবি করছ! তোমরা প্রকৃত বিশ্বাসী হও। যেখানে তোমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে কর্মের বৈপরীত্য থাকবে না।’
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
ww.selimazadi.com