শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

খাদিজার জন্য প্রার্থনা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

খাদিজার জন্য প্রার্থনা

১. এ মাসের অক্টোবরের ৩ তারিখ সোমবার বিকালে আমি খবর পেয়েছি এমসি কলেজে একটি মেয়েকে নির্মমভাবে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা জানতে পেরেছি খবরটি ভুল, মেয়েটি মারা যায়নি তবে বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি খবর জানতে পেরেছি, খাদিজাকে নির্মমভাবে কুপিয়েছে যে ছেলেটি সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের নেতা। ঠিক কী কারণ জানা নেই আমার ভিতরে তীব্র একটি অপরাধ বোধের জন্ম হলো, মনে হলো আমরা নিশ্চয়ই আমাদের ছাত্রদের ঠিক করে মানুষ করতে পারিনি।  তা না হলে কীভাবে আমাদের একজন ছাত্র এরকম নৃশংস একটি ঘটনা ঘটাতে পারে? (তবে অতীতে সে একবার গণপিটুনি খাওয়ার পর আমি তার প্রতি সমবেদনাসূচক বক্তব্য রেখেছিলাম সেই প্রচারণাটি মোটেও সত্যি নয়)!

খাদিজা যে বাসায় থাকে তার পাশেই আমার একজন সহকর্মী থাকে, সে এসে আমাকে ঘটনাটির কথা বলতে বলতে অশ্রুসজল হয়ে উঠতে লাগল। পরদিন মাঝে মাঝেই খবর পেয়েছি খাদিজা মারা গেছে, শেষ পর্যন্ত জেনেছি সে তখনো বেঁচে আছে এবং তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ৭২ ঘণ্টা পার না হলে খাদিজা বেঁচে যাবে কিনা সেটা বলা যাবে না। সারা দেশের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমিও নিঃশ্বাস বন্ধ করে ৭২ ঘণ্টা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, তার জীবনের জন্য প্রার্থনা করতে থাকি। ৭২ ঘণ্টা পার হওয়ার পর আমরা খুব সাবধানে প্রথমবার একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। এরপর থেকে তার সম্পর্কে একটুখানি ভালো সংবাদের জন্য দেশের সবাই মিলে অপেক্ষা করতে থাকি। যখন এটি লিখছি তখন ১৫ দিন পার হয়ে গেছে। খাদিজার শরীরের একটি দিক এখনো অবশ কিন্তু যতদূর জানি তার প্রাণের ঝুঁকিটুকু আর নেই। এখন আমরা সবাই আবার নতুন আশা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি কখন তার জ্ঞান ফিরে আসবে, কখন আপনজনকে চিনতে পারবে, কখন সে আবার তার সত্যিকারের জীবন শুরু করবে। মানুষের শুভ কামনা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে কাউকে খাদিজার মতো করে সেটি পেতে আমি বহুদিন দেখিনি।

২. খাদিজার এই নিষ্ঠুর ঘটনাটির সঙ্গে সঙ্গে দুটি বিষয় হঠাৎ করে আমাদের সবার চোখের সামনে চলে এসেছে। প্রথম ঘটনাটি হচ্ছে এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শীদের এক ধরনের নির্লিপ্ততা। এরকম নির্লিপ্ততা শুধু যে আমাদের দেশে ঘটছে তা নয়, সারা পৃথিবীতেই ঘটছে। দিল্লির রাস্তায় গাড়ি একসিডেন্টে আহত হয়ে একজন মহিলা রাস্তার পাশে পড়ে আছে, তাকে কেউ সাহায্য না করে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে এরকম ঘটনার কথা কিছু দিন আগেই খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্মৃতিটির কথা আমরা কখনো ভুলব না, সেটি হচ্ছে বইমেলার বাইরে যখন অভিজিৎ এবং তার স্ত্রীকে জঙ্গিরা নির্মমভাবে আক্রমণ করেছে, শত শত মানুষ দেখেছে, কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়নি (অনেকেই ছবি তুলেছে), শুধু তাই নয় খুব কাছেই পুলিশ নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে (তাদের অজুহাতটিও যথেষ্ট চমকপ্রদ ছিল— তারা ভেবেছিল ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে মারামারি)।

প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এগোতে না চাওয়ার ব্যাপারটি আমরা একটুখানি বুঝি, কিন্তু যেখানে অসংখ্য মানুষ সেখানে সম্মিলিতভাবে সাহায্যের জন্য ছুটে না গিয়ে শুধু ছবি তুলে দায়িত্ব শেষ করে ফেলার বিষয়টি দেখে কেন জানি নিজেদের খুব অপরাধী মনে হয়। সুদানে দুর্ভিক্ষের সময় একটি ক্ষুধার্ত শিশু হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর তার পেছনে পেছনে একটি শকুন পায়ে পায়ে অগ্রসর হচ্ছে, কখন শিশুটি মারা যাবে এবং কখন শকুনটি তার মৃতদেহটি খাবে সেই আশায়— এ ছবিটি তুলে কেভিন কার্টার নামে একজন ফটোসাংবাদিক পুলিত্জার পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু শিশুটিকে উদ্ধার না করে প্রথমে সেই ছবিটি তোলার জন্য তাকে যেভাবে সমালোচিত হতে হয়েছিল তিনি সম্ভবত তার অপরাধবোধ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন।

আমার মনে হয়, আমাদের এই নির্লিপ্ততা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পথে-ঘাটে কাউকে আক্রান্ত হতে দেখলে আমাদের তাকে ছুটে গিয়ে সাহায্য করতে হবে। আমরা বাঙালিরা কখনো এরকম ছিলাম বলে মনে পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষেরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে একজন আরেকজনকে সাহায্য করেছিল তার কোনো তুলনা নেই। সেই একই দেশের একই মানুষ কেমন করে এখন হঠাৎ এরকম হৃদয়হীন হয়ে গেল আমি বুঝতে পারি না। (আমি অনেকের কাছে এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে চেয়েছি, সত্য মিথ্যা জানি না, অনেকেই বলেছেন এরকম সময় কেউ এগিয়ে যায় না পুলিশের হয়রানির ভয়ে। ঘটনা শেষ হওয়ার পর নাকি পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ একটা ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। যদি এটি সত্যি হয় তাহলে পুলিশের কর্তৃপক্ষের উচিত সবাইকে এ ব্যাপারে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া।)

 

 

৩. খাদিজার ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর দ্বিতীয় যে বিষয়টি উঠে এসেছে সেটি হচ্ছে চাপাতি হাতে আক্রমণকারী বদরুল আলমের পরিচয়। যতবার সংবাদ মাধ্যমে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ততবার তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে। সংবাদ মাধ্যমে একবারও দাবি করেনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানেই চাপাতি হাতে নৃশংস আক্রমণকারী কিংবা নৃশংস আক্রমণকারী মানেই ছাত্রলীগ নেতা। কিন্তু তারপরও আমরা যারা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করেছি। আমাদের থেকে শতগুণ বেশি অস্বস্তি অনুভব করেছে দেশের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রাণপণ চেষ্টা করেছে বোঝানোর জন্য যে বদরুল আলম ছাত্রলীগের কেউ নয়। সবচেয়ে বিচিত্র ছিল একজন নেতা বা কর্মীর ব্যাখ্যা, সেখানে সে লিখেছে— বদরুল আলমের কোপানোর ভঙ্গিটি দেখেই বোঝা যায় সে ছাত্রলীগের কর্মী না। কারণ ছাত্রলীগ এভাবে কোপাতে পারে না। এভাবে কোপায় শুধু শিবির— কাজেই বদরুল আলম নিশ্চয়ই একজন শিবিরকর্মী! এ ধরনের বিচিত্র ব্যাখ্যা আমি আমার জীবনে খুব বেশি শুনিনি। সবচেয়ে বড় কথা বদরুল আলমের এ নৃশংসতার গ্লানি তার পরিবারকে যেরকম স্পর্শ করেছে, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়কেও সেভাবে স্পর্শ করেছে ঠিক সেরকম ছাত্রলীগকেও স্পর্শ করেছে। তার পরিবার একবারও বলার চেষ্টা করেনি সে আমাদের সন্তান নয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ও দাবি করেনি সে আমাদের ছাত্র নয় কিন্তু ছাত্রলীগ প্রাণপণ চেষ্টা করেছে বোঝানোর জন্য যে, সে তাদের কর্মী নয়। তার একটি কারণ কী হতে পারে যে একজন মানুষকে দানবে পরিণত করার ব্যাপারে তাদের একটুখানি হলেও দায় রয়েছে?

মাত্র কয়েক দিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একজন নেতা তার দলবল নিয়ে শুধু যে একটা রেস্টুরেন্ট ভাঙচুর করেছে তা নয়, সেই রেস্টুরেন্টের মালিক-কর্মচারীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে। ক্যাম্পাসে আজকাল অহরহ ছিনতাই হচ্ছে। বাইরের ছিচকে সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসে এসে ছিনতাই করবে তাদের সেরকম সাহস নেই— তাই আসলে কারা ছিনতাই করছে সেটি না জানলেও সবাই ধরে নিয়েছে এটা সঠিক বখরা না পাওয়া ছাত্রলীগের ক্ষুব্ধ কর্মীদের কেউ। ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি যে একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে সেটা আর কেউ না জানলেও আমরা খুব ভালো করে জানি। আমাদের ইনস্টিটিউটে একটা ক্যান্টিন চালানোর জন্য সিলেট শহরের কাউকে আমরা রাজি করাতে পারি না— ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির আতঙ্কে তারা এদিকে পা বাড়াতে রাজি নয়। একজন শিক্ষিকাকে ইভটিজিং করা ছাত্রনেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার পরও সে বহাল তবিয়তে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়। আর এ দেশের সব মানুষই নিজের চোখে দেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেমন করে ছাত্রলীগের কর্মীদের ব্যবহার করে শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছিল। ঘটনাটির কথা শুনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ছাত্রলীগ থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কিছু আগাছা উপড়ে ফেলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কিছু ছাত্রলীগ কর্মীকে সাজা দিয়েছিল— কিন্তু তারা সবাই শুধু যে বহাল তবিয়তে আছে তা নয়, ছাত্রলীগের কমিটিতে বিভিন্ন পদে জায়গা করে নিয়েছে। ছাত্রলীগের সেই কমিটির কোনো একজন সহ-সাধারণ সম্পাদক হচ্ছে এই বদরুল আলম।

কাজেই কেউ যদি মনে করতে থাকে ছাত্রলীগের একজন কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে সরাসরি প্রশ্রয় পেয়ে শত অন্যায় করেও কোনো শাস্তি না পাওয়ার ‘ইনডেমনিটি’ পেয়ে ধীরে ধীরে একজন বদরুল আলম হয়ে ওঠার দুঃসাহস পায় তাহলে কি তাকে কোনো দোষ দেওয়া যাবে?

৪. খবরের কাগজে দেখছি চীন বাংলাদেশকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের ভূমিকা দেখে মুগ্ধ হয়েছে, নিজে এসে দুই বিলিয়ন ডলার দিয়ে গেছে। ক্ষুধার সূচকে বাংলাদেশ ভারতের মতো দেশকে পিছিয়ে ফেলে সামনে এসেছে এবং যে বিষয়টি নিয়ে আমি সব সময়েই গর্ব করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শুধু শাস্তি দেওয়া নয়, শাস্তি কার্যকর পর্যন্ত করা হয়েছে। দেশকে নিয়ে এ ধরনের অনেক বিশাল বিশাল অর্জনের তালিকা করা সম্ভব। কিন্তু সরকার কি জানে, এ ধরনের বিশাল বিশাল অর্জনকে বদরুল আলমের মতো একজন সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের কর্মী মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে? আমার ধারণা রামপালে জোর করে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে গিয়ে সরকার এ দেশের মানুষকে যতটা ক্ষুব্ধ করেছে— বদরুল আলম একা দেশের মানুষকে তার থেকে বেশি ক্ষুব্ধ করেছে। যদি তাই হয় তাহলে কেন আমরা এ দেশের মাটিতে এভাবে দানবদের জন্ম হতে দিচ্ছি? কেন তাদের দুধ-কলা দিয়ে পুষে যাচ্ছি?

৫. খাদিজাকে দিয়ে শুরু করেছিলাম তাকে দিয়েই শেষ করি। সে এখন আর লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে নেই, নিজের শরীরকে দিয়েই জীবন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তাকে যখন আঘাত করা হয়েছে তখন নিজের হাত দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে বলে হাতে মারাত্মক আঘাত পেয়েছে, সেই হাতে সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে।  ডাক্তাররা বলেছেন, আরও দুই-এক সপ্তাহ গেলে তারা আরও নিশ্চিতভাবে খাদিজার সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারবেন।  আমরা সারা দেশের মানুষ তার সুস্থ হয়ে ওঠার খবরটির জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছি।

     লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর