রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পুলিশকে মানবতার রক্ষক হতে হবে

মইনুল হোসেন

পুলিশকে মানবতার রক্ষক হতে হবে

‘একজন মানুষের জীবন যে বাঁচায় সে মানবতাকে রক্ষা করে।’ উপরে উদ্ধৃত এই বাণীটি ইহুদি ও মুসলমানদের সাধারণ ধর্মীয় উত্তরাধিকার এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন টাইম-এর প্রচ্ছদে পবিত্র আল কোরআনের এ বাণী মুদ্রিত হয়েছে।

‘হোয়াইট হেলমেট’ নামের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের স্লোগান হিসেবে গৃহীত হয়েছে এ মহতী বাণীটি এবং সংগঠনটি সিরিয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তারা পুরস্কার পায়নি, তবে সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তাদের সেবামূলক কাজের প্রশংসা করেছে। আমরাও জীবন রক্ষার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছি, তাই টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদটি উক্ত বাণীসহ গেল ১২ অক্টোবরের নিউ নেশনের প্রথম পৃষ্ঠায় পুনর্মুদ্রিত করি।

মুসলমান হিসেবে আমরাও বিশ্বাস করি, আমাদের পুলিশেরও মটো বা স্লোগান হওয়া উচিত মানবতার স্বার্থে আমরা জীবন বাঁচাই। কমিউনিস্ট দেশের পুলিশের কাজের সঙ্গে আমাদের দেশের পুলিশের কাজের তুলনা চলে না। কারণ, স্বাধীন দেশের মানুষ যে অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মান ভোগ করে তার জন্য সেখানে সংগ্রাম করতে গিয়ে মানুষকে পুলিশের হাতে নির্যাতন ভোগ করতে হয়। জর্জিয়া যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজমের জোয়াল থেকে মুক্তি পেল তখন যে কাজটি তাকে জরুরি ভিত্তিতে করতে হয়েছে তা হলো পুলিশের সংস্কার। কমিউনিস্ট পার্টির ডিক্টেটরি শাসনের অধীনে থাকা অবস্থায় শত শত (১৬০০) পুলিশ অফিসারকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য সাজা ভোগ করতে এবং চাকরি হারাতে হয়। সার্বিক অর্থে জর্জিয়া এখনো গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরিত হয়নি, কিন্তু তা সত্ত্বেও জুলুম-পীড়নের মাত্রা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এখন আর কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ একচ্ছত্র অগ্রাধিকার পাচ্ছে না, কারণ পুলিশের চিন্তা-ভাবনায় বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে।

আমাদের এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে জীবন ধারণ করতে হচ্ছে যেখানে সাধারণভাবে একটা ভয়ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। এ ভীতির উৎস সব ধরনের সহিংসতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার, কেবল সন্ত্রাস নয়। এখানে নির্মম মৃৃত্যুর বিভীষিকার পাশাপাশি ঘটে চলছে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের চরম অসহায়ত্ব। এ রকম অবস্থায় জীবনের নিরাপত্তা অথবা মনের শান্তি মেলা সম্ভব নয়। আমাদের সংগ্রাম চালাতে হবে সব ধরনের অপরাধ এবং অনিশ্চয়তার ভয়ভীতির বিরুদ্ধে।

আমাদের চলার পথ নিরাপদ নয়, কারণ অস্ত্রধারী চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। উচ্ছৃঙ্খল তরুণদের হাতে সহজেই নারীরা লাঞ্ছিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে।

সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। আর এর কারণ হচ্ছে পুলিশ জনগণের পুলিশ হিসেবে কাজ করতে পারছে না। বিশেষ একটি গোষ্ঠী ধারণা করছেন পুলিশ তাদের জন্য এবং তাদের কথাই শুনতে হবে, তাদের নির্দেশই মানতে হবে।

আমরা বুঝতে পারছি না কেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আদ্যোপান্ত জানার জন্য সন্ত্রাসীদের জীবন্ত ধরার সর্বোত্তম প্রয়াস চালানো হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশ ছাড়া গোপন গ্রেফতারের কিংবা ক্রসফায়ার কিলিংয়ের কোনো আইনগত অধিকার কারও থাকতে পারে না। পুলিশের তো নয়ই।

 

 

সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল হওয়ার সরকারি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণকে অবশ্যই জানতে হবে কারাইবা সন্ত্রাসী এবং আমরাইবা  কোন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছি? সন্ত্রাসী যে শুধু অন্যেরাই হতে পারে, আমরা হতে পারি না, এমন তো নয়।

জীবন রক্ষাকারী এবং আইনের প্রয়োগকারী হিসেবে পুলিশের অমিলন ভাবমূর্তি রক্ষার ব্যাপারে আমরা আমাদের পুলিশ বাহিনীকে পর্যাপ্ত যত্নশীল ও পরিশ্রমী দেখতে আগ্রহী। কোনোভাবেই পুলিশকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দেখা যাবে না এবং রাজনীতিকীকরণও করা যাবে না। জনগণের বন্ধু হওয়াই পুলিশের জন্য গর্ব।

দেশে এখন আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক ক্ষমতার লড়াই ছাড়া জনকল্যাণমুখী কোনো রাজনীতি নেই। তাই এখন জনগণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনগণের পুলিশ, যারা জনগণের স্বার্থ দেখভাল করবে। স্বাধীন দেশের পুলিশ মানুষের অধিকার রক্ষার শক্তি, জনগণের বন্ধু।  

ভালো পেশাগত ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে তাদের অবশ্যই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের যৌক্তিকতা জনগণের কাছে তুলে ধরার দায়-দায়িত্বের স্মরণ রাখতে হবে। সম্প্রতি বিভিন্ন বাসায় অবস্থানকারী ১২ জন লোককে হত্যা করার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে তাদের বাঁচিয়ে রেখে নিরাপদে গ্রেফতার করা সহজ ছিল। জীবনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে অসহায়ভাবে এতগুলো লোকের মৃত্যু কারও কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না। একে অপরের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে না পারলে কারও জীবনের যে নিরাপত্তা থাকে না তা বুঝতে হবে। 

আমাদের এখনো একটি শাসনতন্ত্র বহাল আছে। সেখানে আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া জীবন কেড়ে নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের যথেষ্ট শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের সাজা দেওয়ার সুযোগ আছে। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার অর্থ, আইনের প্রয়োগকারী হিসেবে পুলিশ অবাধে মানুষ মারতে পারে না।

সন্ত্রাসীদের কাছে জীবনের মূল্য না থাকতে পারে কিন্তু পুলিশ তো আইনের প্রতি, জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য তাদের শাসনতান্ত্রিক এবং নৈতিক উচ্চ অবস্থান বজায় রেখে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। পাকিস্তানিরা আমাদের জীবনের কোনো মূল্য দেয়নি। খেয়াল-খুশিমতো আমাদের হত্যা করেছে। আমরা নিশ্চয়ই তাদের অনুসারী নই। 

সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে আজ গোটা জাতি শামিল। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আইন প্রণেতা, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষ সম্মিলিতভাবে এ লড়াইয়ে তাদের ভূমিকা রেখে চলেছে। এটা কোনোভাবে পুলিশের একক দায়িত্ব নয়।

তবে সহিংসতার অভিব্যক্তি মাত্রেই সন্ত্রাসবাদ নয়। অদূরদর্শী ক্ষমতার লড়াই চালাতে গিয়ে আমরা যেন সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন না করি। কিছু লোকের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আমরা যেন সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই চালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভিতরে পুলিশভীতি ছড়াতে সাহায্য না করি। আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যাতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এখানে অনুপ্রবেশ করতে উৎসাহ না পায়।

আমাদের বিবেচনা যদি ভুলও হয় তবে ভুল হোক, তবুও আমরা সততার সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসের কথা বলব যে, সন্ত্রাসবাদ এখনো আমাদের জন্য তেমন বড় কোনো সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সহনশীলতা থাকলে আমাদের দেশের সন্ত্রাস সহজেই নিঃশেষ করা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন একসঙ্গে শান্তিতে থাকার জন্য উদার ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।

আদতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ ও কোন্দল-কলহের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদ বেড়ে ওঠে। ইরাক ও সিরিয়ার ভয়াবহ সন্ত্রাসী তত্পরতার কারণ খুঁজলেই তা বোঝা যাবে। সঠিক নেতৃত্ব পেলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা কোনো সমস্যাই নয়। সন্ত্রাসী দমনের নামে হত্যা কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় পেলে জনজীবনে নিরাপত্তা আসবে না।

যেহেতু সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে তাই কেউ বলতে পারেন না যে, একমাত্র পুলিশি কার্যক্রম সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য যথেষ্ট। গণতান্ত্রিকবিরোধী রাজনীতি দমনের কৌশল হিসেবে সন্ত্রাস দমনের তত্পরতাকে দেখলে মারাত্মক ভুল হবে। কোনো না কোনো পদ্ধতির সরকারবিরোধী রাজনীতি গড়ে উঠবেই। স্বাভাবিক নিয়মে সরকার পরিবর্তনের ব্যবস্থাই শান্তির পথ।

পুলিশের গোপন গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিশন বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে, এটা একটা শুভ লক্ষণ। আদালতের নির্দেশ ছাড়া গ্রেফতার অবৈধ এবং এর বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতিই সতর্ক করে দিয়েছেন। কোর্টগুলোকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

ভয়ভীতি দাসত্বের লক্ষণ, স্বাধীনতার নয়। ভীতিকে পরাস্ত করে আমাদের স্বাধীনতা ভোগ করতে হবে। দেশে নিরাপত্তা না থাকলে সুবিধাবাদীদের জন্যও নিরাপত্তা থাকবে না। 

আমরা যদি আমাদের জনগণের জীবন নিরাপত্তাহীন ও সন্ত্রস্ত রাখি তাহলে তো আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ছি না বরং সন্ত্রাসবাদকে শক্তিশালী হতে সাহায্য করছি। এমনটি চললে, সময় লাগতে পারে, তবে সন্ত্রাসবাদ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ফিরে আসবে। জাতীয় পর্যায়ে শান্তি ও ঐক্য আনতেই হবে। বর্তমান যুগে সন্ত্রাসী কাজে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়া যে সহজ তা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আইএসআইএস কীভাবে এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়েছে তা তো আমাদের সবার জন্য চিন্তার বিষয় হতে পারে। 

এটা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যদি কোনো স্বাধীন দেশের মানুষ পুলিশকে তাদের বন্ধু হিসেবে না পায়। আইনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে অবশ্যই জনগণ বন্ধু হিসেবে চাইবে, পুলিশকে আপনজন হিসেবে দেখবে।

লেখক :  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর